• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি সময়ের দাবি

চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি সময়ের দাবি

প্রতীকী ছবি

মতামত

চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি সময়ের দাবি

  • সাধন সরকার
  • প্রকাশিত ০২ জুন ২০১৮

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা বাড়েনি। ফলে বাড়ছে বেকারত্ব। এ কারণে চাকরিপ্রত্যাশীরা হতাশায় ভুগছেন। তাই সময়ের দাবি, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ৩৫ বছর করা হোক। বর্তমানে সরকারি চাকরির জন্য বয়সসীমা ১৮-৩০ বছর। গড় আয়ু যখন ৪৫ ছিল, তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর। গড় আয়ু যখন ৫০ পার হলো, তখন প্রবেশের বয়স হলো ৩০। বর্তমানে গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর। তারপরেও চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বাড়ানো হয়নি, সেই ৩০-এ থমকে আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গরিব মেধাবী মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের একাডেমিক লেখাপড়া শেষ করতে সেশনজট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রভৃতি কারণে ২৫-২৭ বছর লেগে যায়। অথচ সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির প্রজ্ঞাপনে আবেদন করার বয়স এখনো ২১ বছর। সরকার লাখ লাখ টাকা খরচ করে, ভর্তুকি দিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে সুসন্তান হিসেবে তৈরি করছে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এ বেঁধে রাখার ফলে এসব শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর মেধা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সরকারি নিয়ম অনুসরণ করার ফলে বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানও ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে জনবল নিয়োগ দিচ্ছে না। গড় আয়ুর কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ করা হয়। আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। আবার ‘যুবনীতি-২০১৭’-তে যুবাদের বয়স ১৮-৩৫ রাখা হয়েছে। তাহলে কেন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ রাখা হবে? যতই দিন যাচ্ছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বেকারত্ব এখন এক গভীর ও জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুসারে এ দেশে বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখ বেকার। এদের প্রায় অর্ধেকই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা চাকরিপ্র্রত্যাশী। দেশের নীতিনির্ধারকরা জনসংখ্যাকে জনসম্পদ বলে আত্মতুষ্টি লাভ করলেও বাস্তবে এর বিপরীত অবস্থা দেখা যাচ্ছে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের উপরে হলেও বেকারের সংখ্যা কিছুতেই কমছে  না। অনেকে একে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি বলে উল্লেখ করেছেন। আবার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে উন্নয়নের ছোঁয়া সঠিকভাবে যাচ্ছে কি-না, তা এক বিরাট প্রশ্নের বিষয়। 

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদনমতে, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। কিন্তু এই শিক্ষিত তরুণরা দেশের বোঝা নয়, মূলত সম্পদ। বেকার নারী-পুরুষ হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না। মা-বাবা সাধারণত পড়াশোনা শেষ করা শিক্ষিত সন্তানের পথ চেয়ে বসে থাকেন কখন তারা পরিবারে সচ্ছলতা আনবে ও তাদের মুখে হাসি ফোটাবে। একজন বেকারের নীরব যন্ত্রণা কেউ অনুভব করে না, কেউ বোঝে না তাদের মনের কথা। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সেশনজট, অসঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা, সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে মূলত বেকারত্ব তৈরি হচ্ছে। ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষা হলো দারিদ্র্র্র্য বিমোচনের প্রধান শর্ত। কিন্তু এদেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তা আদৌ শিক্ষিত তরুণদের কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণ করতে ভূমিকা রাখছে কি-না, সেটা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। আর লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ বেকারের যন্ত্রণা বেড়েই যাচ্ছে। দেশে কাজ না পেয়ে বিদেশে কাজের আশায় দু’বেলা-দু’মুঠো ভাতের জন্য এ দেশের তরুণরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ-মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য যাত্রাপথে জীবন দিয়ে দিচ্ছে  কিংবা পৌঁছাতে পারলেও মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। 

উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষিত তরুণদের কাজে লাগাতে দেশের উন্নয়নে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর বিকল্প নেই। এতে করে বেকারত্বের বোঝা কমবে। তরুণরা কাজের সুযোগ না পেয়ে অনেকে মাদকসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। হতাশায় দিশেহারা জীবন কাটাচ্ছে। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে তিন লাখ শূন্য পদ রয়েছে। তাহলে কেন এসব শূন্যপদ পূরণে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে বেকারদের দ্রুত কর্মসংস্থানে নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা দরকার। দেশে এখন বেকারত্বের হার প্রায় ৫ শতাংশের কাছাকাছি। বেকাররা দেশের অভিশাপ নয়, তারাও সুযোগ পেলে সম্পদে পরিণত হতে পারে। নীতিনির্ধারকদের সেই সুযোগ তৈরি করতে হবে। অন্যথায় বড় ধরনের জনশক্তি অপচয় হবে। পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত রাষ্ট্রে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০-এর উপরে। উদাহরণস্বরূপ পাশের দেশ ভারতে ৩৫ বছর (রাজ্যভেদে এর বেশিও আছে), যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ৫৯ বছর, ফ্রান্স ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ৪০ বছর, শ্রীলঙ্কায় ৪৫ বছর, মালয়েশিয়ায় ৩৫ বছর। সারা বিশ্ব তাদের শিক্ষিত সন্তানদের কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা ৩০-এর দেয়াল তুলে দিয়েছি চাকরিপ্রত্যাশীদের ওপর। বেকার চাকরিপ্রার্থীরা তাদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ চায়। তারা তাদের মেধা কাজে লাগিয়ে দেশকে কিছু দিতে চায়। অভিজ্ঞতায় বলে, প্রায় সব চাকরির সার্কুলার থেকে শুরু করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে দুই-তিন বছর লেগে যাচ্ছে। কচ্ছপগতির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চাকরিপ্রত্যাশীদের বয়স দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে, ফলে তারা হতাশায় ভুগছেন। একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করতে করতে এবং চাকরির পড়াশোনা শুরু করতে করতে বয়স ৩০ পার হচ্ছে। ফলে চাকরিপ্রার্থীরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাচ্ছেন না।

২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ প্রণীত ১৭টি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) অর্জন, সর্বোপরি উন্নত বাংলাদেশ গড়তে সব শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই তরুণ জনগোষ্ঠীর যুক্তিসঙ্গত, যুগোপযোগী ও সময়ের দাবি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করা হোক। এতে করে চাকরিপ্রার্থীরা হয়তো নিজেকে তৈরির এবং মেধা কাজে লাগানোর আরো বেশি সুযোগ পাবে। লাখ লাখ তরুণের বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে তরুণদের বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়া অপরিহার্য।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads