• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
শেখ হাসিনা : যেতে হবে আরো বহুদূর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

শেখ হাসিনা : যেতে হবে আরো বহুদূর

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ০৬ জুন ২০১৮

গত ১৭ মে ছিল জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। এ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারা গণভবনে প্রিয় নেত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘৩৭ বছর হয়ে গেছে, একটি দলের সভাপতি হিসেবে ৩৭ বছরের বেশি থাকা বোধহয় সমীচীন হবে না।’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে জননেত্রী তার অবসর গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। বোধগম্য কারণেই উপস্থিত নেতাকর্মীরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে চিৎকার করে না না উচ্চারণ করেন। এর মধ্যেও জননেত্রী হাসিমুখে ‘সাঁইত্রিশ বছর হয়ে গেছে’- কথাটি পুনর্ব্যক্ত করেন। এরপর এ নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা তেমন না হলেও চায়ের টেবিলে বিষয়টি উঠে আসছে। একটি দলের সভাপতি হিসেবে টানা সাঁইত্রিশ বছর থাকা সত্যিই কি খুব বেশি! এদিকে সম্প্রতি বিরান্নব্বই বছর বয়সে মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত হওয়ার পর একজন নেতার বয়স কত হওয়া উচিত, তা নিয়েও লোকে আলোচনা করছে।    

কে নেতা হবেন, নেতার কোনো বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া উচিত কি-না, এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আসলে বিষয়গুলো সবসময়, সবার জন্য একই রকম নয়। কখনো কখনো কোনো কোনো নেতা অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। আর যখন কেউ কোনো দল, দেশ বা জাতির জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠেন, তখন সময়সীমার প্রশ্নটি গৌণ হয়ে যায়। কিউবার মহান নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো তার সাহস, সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছান, যাতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অবিকল্প নেতা। তিনি পার্টিপ্রধান ছিলেন টানা পঞ্চাশ বছর। যথাক্রমে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট পদাভিষিক্ত ছিলেন ঊনপঞ্চাশ বছর। বিরাশি বছর বয়সেও ক্যাস্ট্রো রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ক্ষমতায় আছেন ১২ বছর। তার বয়সও কম হয়নি— ৬৩ বছর। নেলসন ম্যান্ডেলা ৭৬ বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করেন। দেশের মানুষের জন্য তিনি যা করতে চেয়েছিলেন, যে জন্য জীবনের ২৭টি বছর কাটিয়েছেন কারা প্রকোষ্ঠে, সেই কাজের ভিত্তি ম্যান্ডেলা রচনা করতে পেরেছিলেন তার শাসনামলেই। তিনি বর্ণবিদ্বেষে  ক্ষতবিক্ষত দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠা করলেন রেইনবো সোসাইটি— রঙধনু সমাজ। তিনি সুনিশ্চিত করেন সংখ্যালঘু ২০ শতাংশ বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গের পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার। 

নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি যে কোনো বয়স কিংবা সময়সীমার মধ্যে বাঁধা নয়, সেটা আবারো প্রমাণ করলেন মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ। বিরান্নব্বই বছর বয়সে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যারা কেবল বয়সের ফ্রেমে নেতৃত্বের দক্ষতার বিচার করেন, তারা এতে খানিকটা বেশিই বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যার মধ্যে সত্যিকারের নেতার গুণাবলি রয়েছে তিনি যেকোনো বয়সেই সেটা প্রমাণ করে দিতে পারেন। এই মাহাথির সতেরো বছর ক্ষমতায় ছিলেন না। সতেরো বছর আগে টানা বাইশ বছর তিনি ছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯১ সালে মাহাথির মোহাম্মদ  ঘোষণা করেন ২০২০ সালের মধ্যে মালয়েশিয়াকে শিল্পোন্নত স্বয়ংসম্পূর্ণ এক অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে তোলার অভিলক্ষ্য। মাহাথির যে অভিযাত্রা শুরু করেন, সেটাই দেশটিকে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত করেছে। মাহাথির যখন এই কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন, তখন তিনি এক পরিণত বয়সের রাষ্ট্রনেতা। তখন তিনি পা দিয়েছেন ৬৬ বছরে। আবারো মালয়েশিয়ার মানুষ তাকে সময়ের অপরিহার্য কাণ্ডারি বিবেচনা করে তার হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দিয়েছেন।

মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সে ছিল আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন এক সময়। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শাহাদাত বরণ করার পর বোধগম্য কারণেই আওয়ামী লীগের শতসহস্র নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী দিশাহারা হয়ে পড়েন। সামরিক স্বৈরাচারের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি তরঙ্গসংকুল সমুদ্রে ঘুরপাক খাচ্ছিল, ঠিক তখন তরুণী গৃহবধূ শেখ হাসিনা কাঁধে তুলে নিলেন দলের সভাপতির দায়িত্বভার। তারপর দীর্ঘ অমসৃণ পথ পেরিয়ে, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে আবারো তার সুসংহত ভিত্তির ওপর দাঁড় করালেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তার ব্যক্তিত্ব, দূরদর্শিতা এবং ত্যাগ-সুন্দর রণকৌশল আওয়ামী লীগকে আবার নিয়ে আসে ক্ষমতার পাদপীঠে। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এবং তার আদর্শে বলীয়ান আওয়ামী লীগ পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ একুশ বছর উত্তপ্ত ও কণ্টকিত পথ পাড়ি দিয়ে সরকার গঠন করল বঙ্গবন্ধুরই রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। ১৯৯৬ সালের সেই সরকার স্বল্প সময়ের ব্যবধানে যা যা অর্জন করেছে, বাস্তবিকই তা অসামান্য। সরকার গঠনের দ্বিতীয় বর্ষে এসে সম্পাদিত হয় গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি। একই বছরের ডিসেম্বরের দুই তারিখে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি। এর আগে একুশ বছরে পাহাড়-জনপদ পরিণত হয়েছিল মৃত্যু উপত্যকায়। নির্বাসিত হয়েছিল শান্তির পারাবাত। শেখ হাসিনা ফিরিয়ে আনলেন সেই অশান্ত জনপদে শান্তির বাতাবরণ। কেবল এই একটি অর্জনের জন্যই শেখ হাসিনা পেতে পারতেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে পুনরায়। সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অর্জন করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাসংগরিষ্ঠতা। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করার পর থেকে টানা সাত বছর আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে হয়েছে টালমাটাল পরিস্থিতি। একদিকে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোকে নিঃশেষ করে দেওয়ার চক্রান্ত; অন্যদিকে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য একের পর এক ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আওয়ামী লীগকে সামনে অগ্রসর হতে হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে কেবল শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বের জন্য।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সংকল্প ঘোষণা করেছিল দিনবদলের। ঘোষণা করেছিল ভিশন-২১। দিন সত্যিই বদলে গেছে। দারিদ্র্যলাঞ্ছিত বাংলাদেশ আজ বহুলাংশে দারিদ্র্যের ভারমুক্ত। দারিদ্র্যের হার অনেক নেমে এসেছে। বাংলাদেশ এখন আর স্বল্পোন্নত নয়, উন্নয়নশীল একটি দেশ। উন্নয়নশীল দেশ বলতে মধ্যম আয়ের দেশ বোঝায়। এদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। উন্নত হয়েছে জীবনমান। বলার অপেক্ষা রাখে না, বঙ্গবন্ধুতনয়ার নেতৃত্বের দৃঢ়তায় এই অর্জন সম্ভব করেছে। বাংলাদেশের দৃষ্টি এখন ২০৪১ সালের দিকে। একচল্লিশের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হয়ে উঠতে চায়। এই অভিলক্ষ্য ঘোষণা করেছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

যে অভিলক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা অর্জন করতে হবে। এ কোনো ব্যক্তিগত অভিলাষের বিষয় নয়। এটা জাতীয় আকাঙ্ক্ষা। জাতিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। এটা সম্ভব করতে হলে দরকার নেতৃত্বের অবিচলতা ও ধারাবাহিকতা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজন তো রয়েছেই। যে দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছে, যারা একুশ বছর পর ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনরায় বিকশিত ও সংহত করেছে,  যে নেতার দক্ষ নেতৃত্বে এবং যে দলের সাংগঠনিক দৃঢ়বন্ধন জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তির পথ প্রসারিত করেছে- সেই নেতা এবং সেই দলকেই বাস্তবায়ন করতে হবে ৪১-এর স্বপ্ন। প্রশ্ন উঠতে পারে, জননেত্রীর তখন বয়স কত হবে? অথবা নেত্রী নিজেই যখন নতুন নেতৃত্বের কথা ভাবতে বলেন, তখন অনুরাগী ও চিন্তাশীলরা বিচলিতবোধ করেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, মহৎ অর্জনের পথে বয়স কোনো বাধা নয়। ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ম্যান্ডেলা, মাহাথির মোহাম্মদ তার প্রমাণ। একজন সফল নেতা কত বছর দল ও দেশের নেতৃত্ব দিলেন, সেটা বিচার্য নয়। বিচার্য হলো জাতির জন্য তিনি কী করেছেন এবং কী করতে চান! দেশ-জাতির জন্য মহৎ যা কিছু তিনি অর্জন করতে চান, তাকেই তা করতে দিতে হবে। ইতোমধ্যে সাফল্যের যে পথরেখা অঙ্কিত হয়েছে, সেই পথ ধরে ৪১-এ পৌঁছাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। এই নেত্রীকে যেতে হবে আরো বহুদূর।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads