• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
মাদকের বেড়াজালে পথশিশু

রাজধানীতে রয়েছে তিন লাখেরও বেশি পথশিশু

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

মাদকের বেড়াজালে পথশিশু

  • প্রকাশিত ০৬ জুন ২০১৮

সম্প্রতি খবরের কাগজের এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানা গেছে, ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ বাংলাদেশ’ (আইসিডিডিআরবি) ও বেসরকারি সংস্থা ‘মোস্ট অ্যাট রিস্ক অ্যাডোলেসেন্ট’ (এমএআরএ)-এর তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশের মোট পথশিশুর সংখ্যা ৪ লাখ ৪৫ হাজার। এর মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে তিন লাখেরও বেশি পথশিশু। এর একটা অংশ (৪৪ শতাংশ) মাদকাসক্ত এবং মাদক বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। ৩৫ শতাংশ পথশিশু পিকেটিং এবং বোমাবাজির সঙ্গে জড়িত। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, যদিও হালে পিকেটিং ও বোমাবাজদের তৎপরতা নেই, তবে সামনে ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওরা তৎপর হতে পারে। আসলে কথাটা এভাবে নয়; বলা উচিত ওদের ব্যবহার করতে পারে কেউ কেউ। আর এ জন্য আগাম সাবধানতার প্রয়োজন বোধ করছি আমরা। বাকি ২১ শতাংশ পথশিশু ছিনতাই ও আন্ডারগ্রাউন্ডের সন্ত্রাসীদের সোর্স হিসেবে কাজ করে এবং অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়। জড়িত হচ্ছে ছিঁচকে চুরিসহ নানান কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও।

অপরদিকে ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’ এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, রাজধানীর ৮৫ শতাংশ পথশিশু কোনো না কোনো ধরনের মাদক গ্রহণের সঙ্গে জড়িত। আরেক পরিসংখ্যানে সংস্থাটি জানিয়েছে, রাজধানীতে মাদকসেবীদের ২২৯টি স্পট রয়েছে। সেই তথ্য মোতাবেক জানা যায়, রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, চাঁনখারপুল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম চত্বর, কমলাপুর রেলস্টেশন, সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাস টার্মিনালসহ অন্যান্য স্থানে অবাধে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ঘুমের ওষুধসহ নানা ধরনের মাদক গ্রহণ করছে পথশিশুরা। উল্লেখ্য, বর্ণিত স্থানের হেরফের হতে পারে; কিংবা সংখ্যাও।

সমীক্ষায় জানা যায়, পথশিশুরা মাদকাসক্ত হওয়ার মূল কারণ অভিভাবকত্বহীনতা। এ ছাড়াও দরিদ্র হওয়ার অজুহাতে পথশিশুদের নামতে হয় উপার্জনের পথে। উপার্জনের হাতেখড়ি হয় পুরনো কাগজপত্র এবং বোতল বা প্লাস্টিকসামগ্রী সংগ্রহের মাধ্যমে। ফেলে দেওয়া নানা সামগ্রী কুড়াতে গিয়ে এরা প্রথমে নেশার রাজ্যে পা রাখে। দেখা যায় ভাঙাড়ি দ্রব্যাদি কুড়াতে গিয়ে সাক্ষাৎ মেলে কোনো মাদকসেবীর সঙ্গে। ওরা মাদক গ্রহণের পর অবশিষ্ট অংশটুকু বাড়িয়ে দেয় শিশুটির দিকে। আবার অনেক মাদক ব্যবসায়ী আছে এদের খুঁজে বের করে একটু-আধটু নেশাজাতীয় সামগ্রী হাতে ধরিয়ে দেয়, শিখিয়ে দেয় ব্যবহার পদ্ধতিও। ব্যস্ উৎসুক শিশুদের শুরু হয়ে গেল নেশার রাজ্যে পদচারণা। নেশায় তাড়িত হয়ে শিশুরা তখন মাদক ব্যবসায়ীর কথায় উঠবস করতে আরম্ভ করে। এ সুযোগে ওদের ময়লা-আবর্জনার ব্যাগে নেশাজাতীয় দ্রবাদি ঢুকিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে দিতে হুকুম করা হয়। হুকুম তামিল করতে করতে একদিন পথশিশুরা হয়ে ওঠে তুখোড় নেশারু। যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ খোলা থাকে না ওদের।

সমীক্ষায় জানা যায়, পথশিশুদের পরেই রাজধানীতে মাদকাসক্ত হচ্ছে বেশি ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা। পৈতৃক অনেক অর্থকড়ি নাশের মোক্ষমস্থান হিসেবে বেছে নেয় এরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসকে। অন্যান্য স্থানের তুলনায় ক্যাম্পাস থাকে খানিকটা নিরাপদ। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা খুব একটা বিরক্ত করার সুযোগ পায় না ক্যাম্পাসে। ফলে ওরা বেপরোয়াভাবে নেশায় আসক্ত হচ্ছে খুব সহজে। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদেও। হালে যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারির কারণে জঙ্গিবাদে জড়ানোর সুযোগ তেমন একটা হচ্ছে না, তবে তারা মাদকে জড়িয়ে পড়ছে অবাধে।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধু ছাত্রই নয়, ছাত্রীরাও সামান তালে এগিয়ে আছে। এদের বেশিরভাগই ইয়াবাসেবীর দলভুক্ত। কেউ কেউ গাঁজা, হেরোইনসহ নানান জাতীয় নেশার চর্চাও করে। সেসব নেশাসামগ্রীর রয়েছে আবার আজব আজব নাম। যেসব নাম মুখে নিতেও অরুচি লাগে।

ইংলিশ মিডিয়ামের চিত্রটি তুলে ধরার পেছনে আমাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই। নেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজকে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ও। এ নিবন্ধন লেখার মূল উদ্দেশ্যটি হচ্ছে অভিভাবকদের সচেতন করা। কারণ আমাদের অভিভাবকরা এখন অনেকটাই সন্তাননির্ভর হয়ে পড়েছেন। সন্তানের কথায় উঠবস করাকে আভিজাত্য হিসেবে দেখছেন। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা সন্তানের হাতে তুলে দিতে না পারলে যেন তাদের স্বস্তি নেই। হাত নিশপিশ করে। এ ধরনের মহান অভিভাবকদের কল্যাণেই ‘ঐশী’র জন্ম হয়েছে। এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ঐশীকে হন্তারক হতে সাহায্য করেছে তার নিজের মা-বাবাই। সুতরাং বোধ করছি এ বিষয়ে আর তেমন কিছু বলার নেই আমাদের, কারণ খুব বেশি দিনের ঘটনা নয় সেটি; যা এখনো বিচারাধীন। শুধু এটুকুই বলার আছে, মর্মন্তুদ এ ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় দেশে তার প্রতি সচেষ্ট হবেন বাবা-মায়েরা। সন্তানকে অবশ্যই নজরদারির আওতায় রাখতে হবে। ওদের সব আবদারে সাড়া না দিয়ে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিতে হবে। তাতে বোধকরি উভয়ের কল্যাণ বয়ে আসবে। একটু সচেষ্ট হলেই আমরা বিষয়টিকে আয়ত্তে নিতে পারি। শুধু প্রয়োজন খানিকটা আন্তরিকতার। আমাদের সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক। মাদকদ্রব্য নির্মূলে সচেষ্টও। জঙ্গি দমনে সরকার যেমন সফল হয়েছে, তেমনি মাদক নির্মূলেও দৃষ্টান্ত রাখবে। দৃষ্টান্ত রাখবে পথশিশুদের মাদকের করালগ্রাস থেকে মুক্ত করতে। আমাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে, যে শিশু আজকে মাদকে আসক্ত সে শিশু কিন্তু দেশের সম্পদ নয়; বরং বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কাজেই বিষয়টি মাথায় নিয়ে পথশিশুদের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। মাদকমুক্ত পরিবেশের আওতায় এনে ওদের গড়ে তুলতে হবে এবং শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থাও করতে হবে।

আলম শাইন

বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ

alamshine@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads