• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
মাদকবিরোধী অভিযান

কৌতূহলী যুবসমাজ ইয়াবা সেবনে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে

আর্ট : রাকিব

মতামত

মাদকবিরোধী অভিযান

  • প্রকাশিত ০৭ জুন ২০১৮

কয়েক বছর আগে, এক শুভাকাঙ্ক্ষী আইনজীবীর সঙ্গে কথা হয়েছিল, তিনি তার আইন পেশার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘এক গরু চুরির অপরাধে অভিযুক্ত আসামির মামলা পরিচালনা করছিলেন তিনি। বিচার চলাকালীন এই আসামির জামিন হয়। জামিনের পর আইনজীবী তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, একটি গরু চুরি করলে কত আয় হয়? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, তিনশ টাকা। আইনজীবী আশ্চর্য! একটি গরুর মূল্য তিনশ টাকা? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, না। পুলিশ থেকে শুরু করে গ্রামের চৌকিদার, টাউট-বাটপাড়, মেম্বার-চেয়ারম্যানদের ভাগ-বাটোয়ারা দেওয়ার পর তার তিনশ টাকা থাকে। আইনজীবী তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তুমি গরু চুরি ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজ করে খাও। বিবাদী বলেছিলেন, ‘উপায় নাই।’ কোথাও চুরি হলেই পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে। আমি চুরি করি নাই বলে পুলিশকে চাঁদা দিতে পারি নাই। চাঁদা দিইনি বলেই আমি আজ গরুচোর হয়েছি, গ্রেফতার হয়েছি, জেলহাজতে ঢুকেছি। যদি চুরি করতাম, চাঁদাও দিতে পারতাম, তবে আর আমাকে হাজতে আসতে হতো না। এখন বুঝুন, আমরা কোথায় আছি কীভাবে আছি?

পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে মূল আলোচনায় যাচ্ছি। দুর্গম পাহাড়ে পণ্য বহনের জন্য ঘোড়ার গাড়ি কিংবা ঘোড়াকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই ঘোড়া যাতে ক্লান্ত এবং দুর্বল হয়ে না পড়ে এবং ঘোড়ার ৮০ বছরের সব শক্তি চুষে টেনে বিশ বছরের মধ্যে এনে এই ঘোড়ার কৃত্রিম শক্তি বৃদ্ধির জন্য আবিষ্কার ‘ইয়াবা’ নামক মরণ ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেটের উৎপত্তিস্থল মিয়ানমার। যে ট্যাবলেট এখন বাংলাদেশে গ্রাম-গঞ্জে, শহর-বন্দরে সহজপ্রাপ্য পণ্য হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে। কৌতূহলী যুবসমাজ এই ইয়াবা সেবনে আসক্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। ফেনসিডিল নামক তরল মেডিসিনটি সর্দি কাশির সিরাপ হিসেবে ব্যবহূত হয়। যে সিরাপটি অতিমাত্রায় সেবন করলেই সেবনকারী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। যার অবাধ উৎপাদন হতো ভারতে। বাংলাদেশের পশ্চিম, উত্তর এবং পূর্ব সীমান্ত হয়ে অবাধে এটি চোরাপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করত। ইয়াবা উৎপাদনকারী দেশ মিয়ানমার সরকার বৈদেশিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ইয়াবা পাচার শুরু করে। ওই দেশের টার্গেট ভারত, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থাৎ সমুদ্র সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় ইয়াবা সহজেই বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ইয়াবার ট্রানজিট পথ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহূত হওয়ায় দেশের কেউ কেউ অল্প টাকার পুঁজিতে, অতি দ্রুত কোটিপতি হওয়ার লোভে ইয়াবা ফেনসিডিল ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে ৭৭ লাখ জন-মানুষ মাদকের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে মাদকের ৫০ হাজার গডফাদার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে। মদ, আফিম, ভাং, গাঁজা, প্যাথেডিনের মতো মাদক আগেও দেশে ছিল। সম্প্রতি ইয়াবা এবং ফেনসিডিলের মতো মরণ নেশা দেশের যুবসমাজে শৌখিন নেশায় পরিণত হয়েছে। সমাজ-রাষ্ট্র এই নেশার রাজ্যে তলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি র্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদানকালে মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন। তার বক্তব্যের পরই গত ৪ মে থেকে র্যাব, ১৮ মে থেকে পুলিশ মাদকবিরোধী অভিযানে নামে। ১৫ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ১৩০ জন ব্যক্তি মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার, মামলা হয়েছে ৮ হাজারের মতো। এই অভিযানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনমানুষ অত্যন্ত খুশি। তবে মানবাধিকার কর্মীরা এ ধরনের হত্যা মেনে নিতে পারছেন না। কারণ ‘আত্মপক্ষ সমর্থনপূর্বক লাখ অপরাধী বেঁচে গেলেও যেমন বিচারের ব্যত্যয় ঘটে না, তেমনি কোনো অপরাধীর বিনাবিচারে সাজা হোক এমনটা মানবতায় সমর্থন করে না। বেঁচে থাকার অধিকার সবারই রয়েছে।’

মাদকবিরোধী শক্ত অবস্থানে শুধু কি বাংলাদেশ সরকারই? না, এর আগে ১৯৭১ সালের ১৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে মাদকবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ওই ঘোষণায় তৎকালীন মাদকনির্ভর কলম্বিয়া, ব্রাজিল, মার্কিন সীমান্তবর্তী মেক্সিকোসহ পুরো দক্ষিণ-আমেরিকায় মাদকাসক্ত ৪ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এর মধ্যে কলম্বিয়ায় মারা যায় প্রায় ৬০ হাজার মাদাকসক্ত। মাদকের ভয়াবহ ছোবলে যখন ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের যুবসমাজ ধ্বংসের চরমপ্রান্তে অবতীর্ণ হয়েছিল, ঠিক ওই সময় অর্থাৎ ২০১৬ সালের ১ জুলাই ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তে মাদকবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণায় ওই দেশে ২০১৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মারা যায় প্রায় ৪ হাজার; আত্মসমর্পণ করে ১৩ লাখ। থাইল্যান্ডে মারা যায় ১০ হাজার। বলতে চাচ্ছি না, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মাদক অপরাধীদের মেরে ফেলা হোক। বরং আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার করা হোক। বাংলাদেশের মাদকবিরোধী অভিযানে কিছু বিষয়ে আরো কিছু সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমত, যারা মাদক ব্যবসায় জড়িত হওয়ায় মামলায় জড়িয়ে পড়েছে, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত, অভিযান চলাকালীন ঘুষবাণিজ্য চলছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা। তৃতীয়ত, সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এই গ্রেফতার অভিযানে ঘুষবাণিজ্য হিসেবে ফায়দা নিচ্ছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা। চতুর্থত, মাদকবিরোধী র্যাবের অভিযান শুরু হলো ৪ মে। পুলিশ বাহিনী অভিযান শুরু করল ১৮ মে। এখনো অভিযানে নামেনি সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবি। এক্ষেত্রে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির যৌথ এবং পরিকল্পিত সাঁড়াশি অভিযান সরকার চালাতে পারে। লেখাটি প্রস্তুত করার আগে ছোটখাটো একজন মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছি, মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসা কেন করছেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে, আমার আজকের লেখাটির প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। আমরা বিশ্বাস করি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে সম্ভব দেশকে মাদকমুক্ত করা। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, অপরাধীর তিন ধরনের সাজা নিশ্চিত করা দরকার- ক. অর্থনৈতিক, খ. মানসিক, গ. শারীরিক। তাই বলে এই নয়, জটিল পরিস্থিতিতে অঢেল কিছু পাওয়ার প্রতিযোগিতা। এই প্রশ্নের অন্তরালে ওই যে গল্পটি। এক চালাক শিয়াল কুমিরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল। শিয়াল বন্ধু কুমিরের আস্তানায় বেড়াতে গিয়ে দেখতে পেল, তার আস্তানায় কচি কচি অনেক কুমিরছানা। সে আর লোভ সামলাতে পারল না। কুমিরকে শিয়াল বলল, বন্ধু তোমার সন্তানদের কেন লেখাপড়া শেখাচ্ছ না? কুমির বলল, কোথায় শেখাব? শিয়াল বলল, আমার আস্তানায় তো পাঠশালা রয়েছে, সেখানে পাঠাও। কুমির রাজি হলো, সহজ সরল কুমির, তার সব সন্তানকে শিয়ালের পাঠশালায় পাঠাল। শিয়াল সুযোগ বুঝে যা করার তা-ই করল। শেষমেশ কুমির বুঝতে পারল, তার সঙ্গে শিয়াল প্রতারণা করেছে, তার সন্তানদের খেয়ে ফেলেছে। ক্ষুব্ধ কুমির সুযোগ খুঁজছে, কবে তাকে পাকড়ানো যায়। একদিন সমুদ্রতীরে শিয়াল আহার খুঁজতে গেলে কুমির শিয়ালের একটি ঠ্যাং কামড়ে ধরল। শিয়াল বুঝতে পেরে বলছে, এ কী করছ তুমি, তুমি তো ঠ্যাং রেখে আমার লাঠি ধরেছ। এমনটি বলামাত্র কুমির যেই না ঠ্যাং ছেড়ে দিল, শিয়াল ভোঁ-দৌড়।

সরকার যখন দেশের সাধারণ জনমানুষকে রক্ষার্থে প্রশংসনীয় অভিযান চালাচ্ছে, ঠিক ওই মুহূর্তে কোনো শিয়াল-কুমিরের নাটক চলুক, এটা জাতি কিছুতেই আশা করে না।

রহিম আবদুর রহিম

শিক্ষক ও নাট্যকার

rahimabdurrahim@hotmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads