• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
বাজেট নিয়ে কিছু কথা

অনেকেই এই বাজেটকে গতানুগতিক বলছেন

আর্ট : রাকিব

মতামত

বাজেট নিয়ে কিছু কথা

  • প্রকাশিত ০৯ জুন ২০১৮

জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করা হয়েছে। এই বাজেট চার লাখ চৌষট্টি হাজার পাঁচশ’ তিয়াত্তর কোটি টাকার। রাজস্ব সূত্রে অভ্যন্তরীণ আয় ও ঋণ, সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক থেকে আরম্ভ করে বাইরের বিভিন্ন অর্থসংস্থা থেকে অভীষ্ট ঋণের টাকা যোগ করে এই বিরাট অঙ্কের প্রস্তাবিত বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের এক বছরের হিসাব এতে প্রকাশ করা হয়েছে। চলমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও আগেকার বাজেট সম্পর্কেও নানা কথা এতে আছে।

প্রস্তাবিত এই বাজেট নিয়ে সরকারি লোকেরা জোর গলায় বলে চলছেন যে, বাজেট শিক্ষাবান্ধব, বাজেট জনবান্ধব, বাজেট ব্যবসাবান্ধব, বাজেট উন্নয়নবান্ধব ইত্যাদি, ইত্যাদি। যেসব দল সরকারের বাইরে আছে, যারা বিভিন্ন সিভিল সোসাইটিতে আছেন, তারা নানাভাবে প্রস্তাবিত এই বাজেট সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলছেন। অনেকেই এই বাজেটকে গতানুগতিক বলছেন। বলছেন যে, এতে নতুন কিছুই নেই। রাষ্ট্র, জাতি ও জনগণের জীবনে এত সমস্যা, সেগুলো নিয়ে সরকারের কোনো চিন্তাই নেই। অনেকেই বলছেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সরকার নির্বাচনকে সামনে নিয়ে জনসাধারণকে খুশি করার জন্য বাজেট দিয়েছে। সরকার পক্ষের লোকেরা বলছেন যে, এই বাজেট সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের যোগ্য এবং এটা অবশ্যই বাস্তবায়িত করা হবে। সরকারের বাইরে যাদের অবস্থান তারা বলছেন, এই বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়; এত ঋণ সরকার জোগাড় করতে পারবে না, ঋণ নিয়ে সরকার কাজও করতে পারবে না, এটি বাস্তবায়িত হবে না- লোক দেখানো নানা ব্যাপার এতে আছে। এই বাজেট সম্পূর্ণ দুর্নীতিবান্ধব। এই নিয়ে লুটেরাদের লুটপাটের সুযোগ বাড়বে। এই নিয়ে কী কী জিনিসের দাম এতে বাড়বে- সেগুলো দেখানো হচ্ছে। সমাজের কোন কোন গ্রুপ কোন কোন দিক দিয়ে সুবিধা লাভ করবে, কোন কোন গ্রুপ কিছুটা অসুবিধায় পড়বে- এসব ব্যাখ্যা করে বলা হচ্ছে। প্রচারমাধ্যম এসব নিয়ে ভীষণভাবে ব্যস্ত এবং সরকারের পক্ষেই প্রচার চালাচ্ছে। বাজেট এলে অর্থনীতিবিদদের সুদিন দেখা দেয়, তারা জনসমক্ষে অনেক কথা বলার সুযোগ পান। জনগণের পক্ষে সুন্দর সুন্দর কথা বলে তারা জনপ্রিয় হতে চান। বিভিন্ন চাপ সৃষ্টিকারী গ্রুপ তৎপর থাকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাজেটের বরাদ্দ বাড়িয়ে নিতে। বাজেট নিয়ে প্রতিবছর এই রকমই হয়ে থাকে।

কিছুদিন অর্থনীতিবিদরা খুব সুবিধা ভোগ করেন, সাংবাদিকদের কাছে তাদের বাজারদর অনেক বেড়ে যায়। পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও কিছুদিন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা খুব হইচই করতেন। রাজনীতিতে সক্রিয় সরকারপক্ষ আর সরকারবিরোধীপক্ষ বিপরীতধর্মী সব কথা বলত। তর্ক-বিতর্কের দ্বারা বিশেষ কোনো পরিবর্তন হতো না। বাংলাদেশ যখন মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ, বহুত্ববাদ, উদারতাবাদ ইত্যাদি নিয়ে চলতে আরম্ভ করেছে, তখন থেকে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই। কথিত দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীরাই এসব ঠিক করে নিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক সবচেয়ে সক্রিয় আছে। পরিকল্পনাকে অর্থহীন করে দেখা হয়েছে। যত দিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তত দিন কিছু সংখ্যক অর্থনীতিবিদ এবং কোনো কোনো দলের রাজনীতিবিদ সরকার ঘোষিত বাজেটকে গরিবমারা বাজেট বলে নিন্দা করা হতো এবং গরিবদের প্রতি সীমাহীন দরদ প্রকাশ করা হতো। তাতে যে গরিবদের বিশেষ উপকার হতো, তা নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের (১৯৯১) এবং মার্কসবাদ আবেদনহীন হয়ে পড়ার পর গরিবদের প্রতি লোক দেখানো সেই দরদ আর নেই। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন উৎপাদন ও সম্পদ আগের তুলনায় দ্রুততর গতিতে বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে বৈষম্য, অন্যায়-অবিচার, অপরাধ-প্রবণতা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস। বছরের পর বছর ধরে, দশকের পর দশক ধরে চলমান অবস্থা অপরিবর্তিত রেখে, বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী উন্নয়ন সাধন করে, প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির মধ্যেও মানবীয় দুরবস্থা দূর করা যাবে না। অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে বিরাট অঙ্কের টাকার যে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে মানুষের দুর্গতি কমবে? সমাজে মানুষের মানবিক গুণাবলি বাড়বে? একদিকে অল্পসংখ্যক জালেম, অপরদিকে বিপুলসংখ্যক মজলুম- এই মানবপরিস্থিতির কোনো উন্নয়ন কি সম্ভব? সরকারি অর্থনীতিবিদরা, সরকারবিরোধী অর্থনীতিবিদরা ‘মানবউন্নয়ন’, ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন’ ইত্যাদি যত করেই প্রদর্শন করুন না কেন, মানবিক গুণাবলির, মনুষত্বের, মানুষের নৈতিক চেতনার উন্নতি ঘটবে না। রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত আছে অন্যায় ও জুলুমের ওপর। বাজেট বাড়িয়ে, অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে না। জাতীয় শিক্ষানীতি ও চলমান শিক্ষা ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাবিরোধী, জ্ঞানবিরোধী, গণবিরোধী। শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বস্তরে পরীক্ষানীতি ও পরীক্ষা ব্যবস্থা জিজ্ঞাসাবিমুখ, শিক্ষাবিমুখ, জ্ঞানবিমুখ মানুষ তৈরি করেছে। উৎপাদন ও সম্পদ বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে অন্যায়-অবিচার, সভ্যতাবিরোধী সংস্কৃতিবিরোধী কার্যক্রম। কেবল বাংলাদেশে নয়, প্রায় পৃথিবী জুড়েই চলছে এই অবস্থা।

অর্থনীতিবিদদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা বুঝতে হবে। বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণত তাদের বিবেচনা মাথাপিছু গড় আয়, মোট জাতীয় আয় ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে। নৈতিক বিবেচনা, ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তাদের চিন্তায় অল্পই স্থান পায়। তাদের চিন্তা নিয়ে সমাজের নিচের স্তরের শতকরা নব্বইভাগ মানুষের কল্যাণ অল্পই হয়। তাদের চিন্তায় মজলুম গুরুত্ব পায় না, জালেম গুরুত্ব ও মর্যাদা লাভ করে।

বাংলাদেশের সমাজে নর-নারীর মৌলিক প্রবণতা কী? কিছু ধনিক-বণিককে পুঁজিপতি বলে তিরস্কার করা হয়। পুঁজিপতিদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার ও সমাজের সব অনাচারের জন্য তিরস্কার করা হয়। কিন্তু ধনতান্ত্রিক মানসিকতা তো সমাজের একেবারে নিচের স্তরের লোকদের ছাড়া নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত নির্বিশেষে সবার মধ্যেই সক্রিয় আছে। অর্থসম্পদ চাই, আরো অর্থসম্পদ চাই। ধন লিপ্সা ও ধনতান্ত্রিক মানসিকতার পাশাপাশি আছে ক্ষমতা লিপ্সা। ক্ষমতা হলে ধনসম্পদ করা সহজ হয়। তাই ক্ষমতা চাই, আরো ক্ষমতা, আরো ক্ষমতা, আরো ক্ষমতা। ধনসম্পদ ও ক্ষমতা কেন চাই? চাই ভোগ লিপ্সাকে- ভোগের বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য। যারা শান্তিপ্রিয়, আরামপ্রিয়, ধনসম্পদ ও ক্ষমতার প্রতি উদাসীন, তারা কোনো সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অবস্থানে টিকতে পারেন না- তাদের পক্ষে কোনোক্রমে অস্তিত্ব রক্ষা করে চলাও অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সমাজের সব স্তরে নর-নারীর কেন্দ্রীয় প্রবণতা ‘ধনতান্ত্রিক-ক্ষমতাতান্ত্রিক ভোগবাদী’। ক্ষমতার প্রশ্নে অধিকাংশ লোক ক্ষমতাদম্ভী স্বৈরাচারী লোকদের সমর্থন দিয়ে তাদের আশ্রয়ে নিরাপদ থাকতে চায়। তারা স্বেচ্ছাচারী, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। স্বৈরাচার কেবল স্বৈরাচারী দ্বারা সৃষ্টি হয় না, অনুসারীদের দ্বারাও সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশে এবং দুনিয়াব্যাপী নর-নারীর কেন্দ্রীয় প্রবণতা (central motive) পরিবর্তন করতে হবে। চলমান প্রবণতা নিয়ে চলতে থাকলে মানবপ্রজাতি টিকতে পারবে না। মানবজাতিকে নিজের অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধির প্রয়োজনেই নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হতে হবে; প্রত্যেক জাতির মধ্যে এবং গোটা মানবজাতিতে উন্নত চরিত্রের নৈতিক শক্তিসম্পন্ন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। জবরদস্তিপরায়ণ, জুলুমবাজ, ভাঁওতাবাজ, প্রতারণাপ্রবণ নেতৃত্ব নিয়ে কোনো জাতি, গোটা মানব প্রজাতি রক্ষা পাবে না।

বার্ষিক বাজেট যেহেতু মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেজন্য এ নিয়ে লোকে জানতে আগ্রহী হয়। নিজের নিজের আয়-ব্যয়ের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করে। প্রস্তাবিত বাজেট মনে হয় সমাজের উচ্চশ্রেণির লোকদের জন্য প্রীতিকর হয়েছে।

অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশে নতুন চিন্তা দরকার। সুষ্ঠু অর্থনীতির দিকে যাত্রা করতে হলে তার পূর্বশর্ত হিসেবে সর্বজনীন গণতন্ত্র দরকার। সর্বজনীন গণতন্ত্রের প্রকৃতি ও রূপ উদ্ভাবন করে তা বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক নেতা, দল ও জনসম্পৃক্ত নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে।

অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা, সেই সঙ্গে দশ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা। স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি- দুই ধরনের পরিকল্পনাই অপরিহার্য।

রাষ্ট্রে জনগণের গণতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য কর ও রাজস্ব ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করে জনহিতকর ও দুর্নীতিমুক্ত রূপ দিতে হবে। অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল অফিসকে পুনর্গঠিত করে সংবিধানের আওতায় স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে এবং উক্ত অফিসের মাধ্যমে রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় সম্পর্কে দেশবাসীকে পরিচ্ছন্ন ধারণা দিতে হবে। অর্থনীতিকে উৎপাদনবান্ধব রূপ দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে সব নাগরিকের কর্মসংস্থান ও সম্মানজনক জীবিকা নিশ্চিত করতে হবে। জনসংখ্যা পরিকল্পনা অবলম্বন করতে হবে। পর্যায়ক্রমে ধনী-গরিবের বৈষম্য কমাতে হবে। প্রকৃতিসৃষ্ট বৈষম্যের অতিরিক্ত সব বৈষম্য পর্যায়ক্রমে দূর করতে হবে। রাষ্ট্রের সব অঞ্চলের ও সব জনগোষ্ঠীর সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। বন্ধুত্বমূলক ঐক্যের কিংবা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের নীতি অবলম্বন করতে হবে। বহুত্বে কিংবা বৈচিত্র্য এবং ঐক্য দুটোতেই যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ধারায় ডিজিটাল পদ্ধতি প্রসারিত করতে হবে। ইন্টারনেটের সদ্ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং অপব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করতে হবে। পঞ্চম শ্রেণির ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বিলুপ্ত করতে হবে। কথিত সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির জায়গায় সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরীক্ষা পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউনেস্কো ও ইউনিসেফের নীতি অন্ধভাবে গ্রহণ করা থেকে বিরত হতে হবে। জাতির আত্মনির্ভরতা ধাপে ধাপে অর্জন করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্র ও জাতিকে সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর করে তুলতে হবে। বাজেটেও এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হতে পারে।

আবুল কাসেম ফজলুল হক

বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads