• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
জীবনের মূল্য

প্রত্যেক মানুষই নিজ জীবনকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে থাকে

আর্ট : রাকিব

মতামত

জীবনের মূল্য

  • প্রকাশিত ০৯ জুন ২০১৮

প্রত্যেক মানুষের জীবনই অমূল্য। এ নিয়ে দ্বিমত-বিতর্কের অবকাশ নেই। প্রত্যেক মানুষই নিজ জীবনকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সেটা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি বাস্তবিকও। কোন মানুষ নিজের জীবনকে মূল্যহীন এবং ভালো না বাসে একমাত্র মানসিক রোগী ছাড়া। নিজের জীবনকে নিরাপদ ও সুরক্ষায় সবাই কমবেশি তৎপর থাকে। কিন্তু বাস্তবতার কষাঘাতে সেটা সবার ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। আমাদের মোট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠদের ক্ষেত্রে যে সম্ভব হয় না সেটা তো আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করে থাকি। যে জীবন অমূল্য— সে জীবন বাঁচাতেই বেছে নিতে বাধ্য হয় অনিরাপদ-ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। আমাদের শ্রেণি বিভাজিত সমাজে শ্রেণিভেদে মানুষের জীবনের বৈপরীত্য নিশ্চয় রয়েছে। যার মূলে শ্রেণি অবস্থান এবং ওই শ্রেণিগত অবস্থানের কারণেই জীবিকার প্রয়োজনে মেহনতিরা বাধ্য হয় অনিরাপদ-ঝুঁকিপূর্ণ পেশা গ্রহণে। এ কারণে নানা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর ঘটনা অহরহ ঘটে। এই দুর্ঘটনাকে কেবল দুর্ঘটনা বিবেচনা করেই দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবার উপায় নেই; যেমন রাষ্ট্রের, সরকারের, তেমনি শিল্পপতি-বণিক মুনাফাভোগীর। অহরহ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় নিরপরাধ শ্রমিকদের অপমৃত্যুর জন্য সংশ্লিষ্টদের বিচার-শাস্তি তো পরের কথা, দায়ীদের ক্ষেত্রে সর্বত্রই ঘটে চরম নীরবতা পালন। দুর্ঘটনা এড়াতে নেওয়া হয় না কোনোই পদক্ষেপ। মুনাফাবাজদের মুনাফা প্রাপ্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ ওই সকল পেশায় প্রাণ বিসর্জন দিতেই যেন জন্ম নিয়েছে অসহায় মেহনতি শ্রমিকেরা।

নির্মাণ, শিল্প, গার্মেন্টস, শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে উন্নয়নের মহাযজ্ঞে প্রাণ হারায় সর্বাধিক শ্রমিক। পুঁজিবাদী উন্নয়নে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া শ্রমিকদের জীবন হারানোকে স্রেফ দুর্ঘটনা অবহিত করে দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যায় ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজিবাদী উন্নতি ও উন্নয়নের মুনাফাবাজ চক্র। এই চক্র আমাদের শাসক শ্রেণির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই মানুষের অস্বাভাবিক অপমৃত্যু রোধকল্পে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। জীবনরক্ষায় একমাত্র মজুরিপ্রাপ্তিতে অনিরাপদ-ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যুক্ত শ্রমিকরা অকাতরে জীবন বিসর্জন দিয়ে থাকে। তাদের জীবনকে সঙ্গত কারণে অমূল্য ভাবার অবকাশ থাকে কী করে! আমাদের মুনাফালোভীরা তাদের নির্মাণ, শিল্প-কারখানা, গার্মেন্টস শিল্প, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড হতে নানামুখী পুঁজিবাদী উন্নতি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অপরিহার্য জনশক্তি শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে আগাগোড়াই উদাসীন। তারা মুনাফা ব্যতীত কিছু বোঝে না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে অবদান রাখা গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও দেখা যায় মালিকপক্ষের চরম দায়িত্বহীনতা। রানা প্লাজা, তাজিন গার্মেন্টসহ অসংখ্য গার্মেন্টে প্রাকৃতিক নয়, মানবসৃষ্ট দায়িত্বহীনতায় প্রাণ দিতে হয়েছে অগণিত শ্রমিককে। যারা ওই মুনাফাবাজদের মুনাফা লাভের প্রধান হাতিয়ার, সেই শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে মুনাফাভোগীরা ন্যূনতম নিরাপত্তা দিতে পারেনি। বিপরীতে ঠেলে দিয়েছে দুর্ঘটনা নামক মৃত্যুর মুখে। মুনাফাবাজদের মুনাফার বলির পাঁঠা অগণিত শ্রমিকের মৃত্যুতেও রাষ্ট্র-সরকার নির্বিকার-নির্লিপ্ত থেকেছে আগাগোড়া। এই নীরবতাই ওই মালিকপক্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে শাসক শ্রেণির যুক্ততা-অবস্থান নিশ্চিত করেছে। ওই যে বলেছি আমাদের শাসক শ্রেণির অবিচ্ছেদ্য অংশ আমাদের মুনাফাভোগীরা, এটা তারই দৃষ্টান্ত। সাধারণ চোখে দুইপক্ষ মনে হলেও বাস্তবে দুইপক্ষ কিন্তু একপক্ষই বটে। এরাই স্বাধীন দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। রাষ্ট্রে, সরকারে, বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে, অর্থনৈতিক শোষণে এই সংখ্যালঘু শ্রেণিই শাসন-শোষণ চালিয়ে এসেছে স্বাধীনতার ৪৭ বছর ধরে।

আমাদের কৃষকরা কৃষিপণ্য উৎপাদনে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। অথচ কৃষকরা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বরাবরই বঞ্চিত। বিকল্প কর্মসংস্থান নেই বলেই নিরুপায় কৃষকরা আধপেটা খাবার খেয়ে দেশবাসীর খাদ্য চাহিদা পূরণ করে। মাঠের ফসলের মূল্য আর ভোক্তাদের যে মূল্য দিতে হয়, তার সঙ্গে বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টিতে যুক্ত মধ্যস্বত্বভোগীচক্র, যারা কৃষিপণ্য থেকে বিনাশ্রমে নানা উপায়ে মুনাফা লাভ করলেও উৎপাদক কৃষকেরা থাকে বঞ্চিত। শীত, গরম, বর্ষা গায়ে নিয়ে কৃষক অত্যধিক কায়িক পরিশ্রম করেও উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না। অনিয়ম-অতিপরিশ্রমে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে নানা মরণব্যাধির মুখে পড়তে হয় কৃষকদের। ফসলের মাঠে কর্মরত কৃষকদের বজ্রপাতে প্রাণ হারানোর ঘটনাও প্রায়ই ঘটে। কৃষকদের জীবিকা যে ঝুঁকিমুক্ত সেটা কিন্তু বলা যাবে না। তাদের জীবনও জীবিকার তাগিদে নিরাপদ নয়।

বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সীমাহীন দৌরাত্ম্য আমাদের দেশেও প্রবলভাবে বিস্তার লাভ করেছে। আমাদের শাসক গোষ্ঠী ওই পুঁজিবাদের অনুসারী বলেই আমাদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারসমূহ একে একে খর্ব হয়েছে। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বভুক্ত দেশের সকল মানুষের চিকিৎসাসেবাকে পর্যন্ত পুঁজির মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসার এই বাণিজ্যিকীকরণে বিলাসবহুল অত্যাধুনিক বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে সাধারণের চিকিৎসাসেবা নেওয়া অসম্ভব। মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়সাপেক্ষ চিকিৎসাসেবা বিত্তবানদের জন্যই নির্ধারিত, বড়জোর মধ্যবিত্তদের পক্ষে টেনেটুনে সম্ভব হয়। দেশের সিংহভাগ মানুষের রোগ-ব্যাধি নিরাময়ে সরকারি হাসপাতালই একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেখানে অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার কারণে রোগীদের অনেকটা বিনা চিকিৎসায় সময় অতিবাহিত করে মৃত্যুকে বরণ করতে হয়। রোগীর ভর্তি হতে চিকিৎসা গ্রহণের নানা ধরনের প্রক্রিয়ায় বহুবিধ প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হয় সরকারি হাসপাতালসমূহের অসাধু চক্রকে উপঢৌকন দিয়ে। ওষুধপত্র, পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যন্ত রোগীদের নিজ খরচায় সম্পন্ন করতে হয়। এমতাবস্থায় মানুষ নিরুপায় হয়ে ঝাড়-ফুঁক, পড়াপানি, বিভিন্ন ধরনের ওঝার শরণাপন্ন হয়ে স্বল্প পয়সায় রোগ নিরাময়ের অবৈজ্ঞানিক-অবাস্তব পরিস্থিতির শিকার হতে বাধ্য হয়। এবং বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে। যার বা যাদের অর্থ আছে তারাই জীবন বাঁচাতে ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা ক্রয় করতে পারে। আর যাদের নেই তাদের বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়। এটাই দেশের এখনকার বাস্তবতা। সমষ্টিগতদের জীবন বিদ্যমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাধীনে মূল্যহীন। তাই জীবন অমূল্য বলা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে শ্রেণি বিভাজনে সকল মানুষের জীবন অমূল্য নয়। মানুষের জীবন অমূল্য কিংবা মূল্যহীন সেটা শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শ্রেণি বৈষম্যের ন্যায় বিভাজিত এবং নির্ধারিত। এই সত্যটি অপ্রাসঙ্গিক তো নয়ই, বরং আমাদের বিদ্যমান সমাজে অতিমাত্রায় জাজ্বল্যমান। প্রশ্ন থাকে, সকল মানুষের জীবন অমূল্য সেটার বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব? সম্ভব তো অবশ্যই। তবে উদারবাদী কিংবা এনজিওদের সংস্কারের কর্মসূচিতে সম্ভব হবে না। সমাজ কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে যতই সংস্কার করা হোক না কেন, ভিত শক্ত-পোক্ত না হলে কোনো স্থাপনা টিকতে পারে না। ঠিক তেমনি পুরো সমাজ কাঠামোকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে বিদ্যমান কাঠামোকে ভেঙে। সমাজ কাঠামোর এই ভাঙা-গড়ার মধ্যে যেমন সকল মানুষের জীবন অমূল্য হয়ে উঠবে, পাশাপাশি সকল মানুষের অধিকার ও সুযোগের সমতাও প্রতিষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া বিকল্প ভাবনার যে অবকাশ নেই।

মযহারুল ইসলাম বাবলা

নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads