• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করতে এ দেশের লেগেছে অনেকদিন

আর্ট : রাকিব

মতামত

উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ১১ জুন ২০১৮

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যে অর্থনীতি আমরা পেলাম তা একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি। সেই অর্থনীতি নিয়ে পথ চলা শুরু হলো। কিন্তু সেই ভঙ্গুর অর্থনীতির ওপর আবারো ছোবল হানল ১৯৭৪-এর মন্বন্তর। আর ঠিক যখনই দেশ গড়ার, অর্থনীতি পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে তখনই ঘটল ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। হত্যাযজ্ঞ, ক্যু, ক্ষমতা দখল, স্বৈরাচারী শাসনে উপর্যুপরি বিধ্বস্ত হতে থাকল দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি।

গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করতে এ দেশের লেগেছে অনেকদিন। বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এসে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। আমরা দারিদ্র্য ৫০% কমিয়ে  এনেছি। গত ১০ বছর ধরে গ্রোথ রেট ৬%-এর উপরে রয়েছে। জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, গড় আয়ু আর মাথাপিছু আয় বেড়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে হলে জাতিসংঘের তিনটি স্ট্র্যাটেজি পূরণ করতে হয়। মাথাপিছু গড় আয় থাকতে হয় ১২৪২ ডলারের উপরে। মানবসম্পদ ৬৬-এর বেশি হতে হবে। আর অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব ৩২-এর নিচে হতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে মাথাপিছু গড় আয় ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ১৬১০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মানবসম্পদ ৭২-এর উপরে আর অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব ২৪.৮। জাতিসংঘ প্রতি তিন বছর পর পর একটি রিভিউ করে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি রিভিউয়ের ফলাফলের ভিত্তিতে মার্চের ১৫ তারিখে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্য হয়েছে বলে জাতিসংঘ বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেনকে জানিয়েছে।

আমরা যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছি কিন্তু এখনো ঘোষণা হয়নি। ঘোষণা হবে ২০২৪ সালে। সেই পর্যন্ত বাংলাদেশকে এই স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখতে হবে।

আমরা বিভিন্ন খাতে প্রভূত উন্নতি করেছি। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। উড়াল সেতুতে ছেয়ে গেছে রাজধানী। মেট্রোরেল চালু হতে যাচ্ছে। নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমাদের বিভিন্ন খাতে অনেক অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। সেই খাতগুলোকে চিহ্নিত করে এখন আমাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা উচিত।

আমাদের বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০৪১ সাল পর্যন্ত এই খাতে সরকারকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। বিদ্যুৎ সরকারই সরবরাহ করে নিজ টাকায়। এ ক্ষেত্রে ফাইন্যান্সিংয়ের আরো উৎস সন্ধান করা দরকার। বিকল্প পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ এনে খরচ কমানোর চিন্তা করা দরকার। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এমন খসড়া গাইডলাইন তৈরি করা যেতে পারে যাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও পরিবহনের জন্য প্রাইভেট সেক্টরকে ইনভলভড করা যায়। তবে এ কাজ সহজ হবে না। বিশ্বাসযোগ্য ও সস্তা বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজন এমন পাওয়ার মার্কেট যেটার ওপর কোনো রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না। প্রাকৃতিকভাবে ফ্লো হবে। একজনকে কম দেওয়া হবে, একজনকে বেশি- এমন কোনো ব্যাপার থাকবে না। প্রতিযোগিতামূলক বাজার হবে, মনোপলি থাকবে না। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেট থেকে যাতে সুবিধা পাওয়া যায় সে দিকটাও দেখতে হবে। মার্কেটের সাপ্লাই ডিমান্ড অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। প্রায়ই আমরা শুনি সঠিকভাবে বিদ্যুৎ পায় না বলে কোম্পানিগুলো উৎপাদন করতে পারে না। এমন হলে দেশের সামগ্রিক উৎপাদন কমে যাবে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর মানে এগ্রিকালচার, কনস্ট্রাকশন, ফিশারিজ ক্ষেত্রে ২১% বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। এসব খাতে প্রতিনিয়ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। আবাসিক খাতে বিদ্যুৎ লাগে সবচেয়ে বেশি। হসপিটাল-হোস্টেলেও বিদ্যুৎ লাগে। কাজেই বিদ্যুৎকে সস্তা, সহজলভ্য ও নির্ভরযোগ্য করে মানুষের নাগালের মধ্যে আনা প্রয়োজন।

আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর। একসময় পাটকে বলা হতো বাংলার সোনালি আঁশ। গত শতকের প্রথম দু-তিন দশকে পূর্ব বঙ্গের পাট কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। বৈশ্বিক কারণে সে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। এখন আরএমজি বাংলাদেশের বৃহত্তম রফতানিযোগ্য খাত। ৮৫% বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় এ খাত থেকে। ৪ মিলিয়ন মানুষ কাজ করে এ খাতে যার ৮০ ভাগ নারী। রফতানিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। প্রথম স্থানে আছে চীন। স্বল্পশিক্ষিত অবহেলিত নারীরা এখন এ সেক্টরে কাজ করে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশগ্রহণ করছে। নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে। নারীর ক্ষমতায়নের একটি বড় ধাপ এটি।

আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় খাত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স।

এরপরও আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য আরো কয়েকটি খাতের ওপর দ্রুত নজর দেওয়া দরকার। দরকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতগুলোর উন্নয়ন। শুধু পোশাক রফতানিকারী শিল্প বা প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের ওপর নির্ভর করে থাকা ঠিক হবে না। এ খাত দুটিতে যেকোনো সময় ধস নামতে পারে। রানা প্লাজার কথা আমরা মনে করতে পারি। আমদানিকারী দেশগুলো আমদানি বন্ধ করে দিতে পারে। কোটার ব্যাপারটা তো মাঝেমধ্যে ঘটেই। তাই বিভিন্ন দেশে পোশাক শিল্পের নতুন বাজার অন্বেষণ করা প্রয়োজন। তাদের চাহিদা ও রুচি অনুযায়ী মানসম্মত পোশাক তৈরি করা প্রয়োজন। প্রয়োজন পোশাককর্মীদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান, তাদের কর্মপরিবেশ উন্নত করা, নতুন নতুন সেক্টরের দিকে নজর দেওয়া। লেদার, ফ্রোজেন ফুড, ফার্মাসিউটিক্যালস প্রডিউস করার জন্য যাতে আমরা সাহায্য (ভর্তুকি) পাই সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। এ ছাড়া ঘরে ঘরে নির্মিত পাটপণ্য যাতে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সে ব্যবস্থা করা।

নতুন নতুন চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে জনশক্তি রফতানির সেক্টরটিকে মূল স্রোতে আনা দরকার। মধ্যপ্রাচ্য ওমানসহ যেসব দেশে লোক পাঠানো হয়, পাঠানোর সময় খেয়াল করা দরকার যেন তারা প্রপার চ্যানেলে যান, যেন প্রতারিত না হন, কাজের নিশ্চয়তা নিয়ে যান।

একসময় চিংড়ি আমাদের রফতানির বড় খাত ছিল। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল হেলথ স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করা হচ্ছে না এই যুক্তি এনে ইউএন চিংড়ি রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা যাতে উঠে যায় এবং ইন্টারন্যাশনাল হেলথ স্টান্ডার্ড সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয় সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। চিংড়িকর্মীদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং নিয়মসম্মতভাবে চিংড়ি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

দেশের একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা বেকারত্ব। একদিকে যেমন দেশের উন্নতি হচ্ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিকে বেকারত্ব বাড়ছে। এর মূল কারণ ক্রিয়েটিভ আর ননকনভেনশনাল কাজের দিকে মানুষ ঝুঁকছে না। গতানুগতিক পড়াশুনা করছে, তারপর চাকরি খুঁজছে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের দিকে আরো নজর দেওয়া দরকার। অন্যদিকে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, লবিং কমাতে হবে। এসব কারণে অযোগ্য চাকরি পায়, মেধাবী বঞ্চিত হয়।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি, যানজট উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে আটকে দিচ্ছে প্রতি পদে। ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে চলছে না। একের পর এক প্রাইভেট ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। সেসব ব্যাংকে অল্প বেতনে কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে সঞ্চয়পত্র ও বন্ড বিক্রির ফলে ব্যাংকে এখন তারল্য সঙ্কট প্রকট। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকের দুর্নীতির পর মানুষ এখন ব্যাংকের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। একই ঘটনা ঘটছে একের পর এক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক আর ইউনিভার্সিটির অনুমোদন দেওয়ায়। হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে না, টেস্টের নামে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নেওয়া হচ্ছে, ডাক্তার-নার্স মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ সবারই রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। মানুষ ছুটছে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, ভারত। সেই সুযোগে ভারত সরকার মেডিকেল ভিসা চালু করেছে। মানুষের ভোগান্তির সীমা-পরিসীমা নেই। এ দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। হার বাড়া আর প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া এক কথা নয়। পিঁপড়ের মতো ছাত্ররা বের হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু প্রতিযোগিতায় টিকছে না। চাকরির বাজারে মার খাচ্ছে ক্রমাগত।

আর একটি কথা, শিক্ষার হার বেড়েছে বলে পিয়নের চাকরিতে এসএসসি-এইচএসসি পাস চাওয়া ঠিক না। এ দেশে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে, কিন্তু অনেক মানুষ আছে যারা বিনা বেতনেও ছেলেমেয়ে পড়াতে পারে না। তাদের ঘরে কাজ করতে হয়, শিশুবয়সেই উপার্জন করতে হয়। তাদের কাছে প্রতিটি বছরের শ্রমমূল্য আছে। তাই তারা যতটুকু পড়তে পারে ততটুকুর ভিত্তিতে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার।

একের পর এক সোশ্যাল ইকোনমিক জোন সৃষ্টি হচ্ছে। সাসটেনেবল ইকোনমিক গোল অর্জন করতে হলে ১০০টা জোনের ওপর নজর না দিয়ে ১০টা ভালো জোনের ওপর নজর দেওয়া দরকার।

দেশে প্রতিবছর ৭২০ বিলিয়ন টাকা খরচ হয় পদ্মা ব্রিজ, সরকার আর অফিস আদালতের জন্য। এই খরচ ১% দক্ষতার সঙ্গে করতে পারলে খরচ ৭ বিলিয়ন কমে যেত। ইলেকট্রনিক গভর্মেন্ট প্রকিওরমেন্টে প্রতিটি কেনাকাটার ওপর ৬৬৩ টাকা লাভ হতে পারে। দেশের ভবিষ্যৎ ভালো করতে হলে টেকনোলজি আয়ত্ত করতে হবে। ইনফরমেশন টেকনোলজি দুর্নীতি কমায়।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট অনুযায়ী ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশে নন ওয়ার্কিং এজের মানুষ থেকে ওয়ার্কিং এজের মানুষ বেড়েছে। এই ওয়ার্কিং এজ ১৫-৬৪। বর্তমানে দেশের ৬৫%-এর বেশি জনসংখ্যা ওয়ার্কিং এজের। এটা উন্নয়নের জন্য একটি বিশাল সুবিধা। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে ইনকাম ও জিডিপি বাড়ানো দরকার। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে সেটা হচ্ছে না। আমরা এই জনশক্তিকে কাজে লাগাতে পারছি না, চাকরি দিতে পারছি না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে প্রচুর বিনিয়োগ করা দরকার।

শেষ কথা এটাই যে, হিউমান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট, গুড গভরনেন্স কালচার, ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বশীল, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক সরকারের ওপর নির্ভর করে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন।

লেখক : কথাশিল্পী, কলাম লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads