• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
বিদেশে নির্যাতনের শিকার নারীকর্মী এবং প্রতিকার

নারী শ্রমিকরা গড়ে ৯০ ভাগ টাকা দেশে পাঠান

আর্ট : রাকিব

মতামত

বিদেশে নির্যাতনের শিকার নারীকর্মী এবং প্রতিকার

  • প্রকাশিত ১১ জুন ২০১৮

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭৮৯ বাংলাদেশি শ্রম অভিবাসী রয়েছেন। এর মধ্যে ৭ লাখ ২৭৮ জনই নারী। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নারী গেছেন সৌদি আরবে। প্রবাসী নারীকর্মীর ৩০ শতাংশই এখন সৌদিতে। সেখানে এখন ২ লাখ ৪ হাজার ৭২৯ নারী শ্রমিক রয়েছেন। এর পরই ১ লাখ ২৯ হাজার ৮০২ জন জর্দানে, ১ লাখ ২৬ হাজার ১ জন আরব আমিরাতে, লেবাননে ১ লাখ ৪ হাজার ২০৭ জন এবং ওমানে ৬৪ হাজার ৬০২ নারী শ্রমিক রয়েছেন। এসব নারী অভিবাসী ওইসব দেশে গৃহকর্মীর পাশাপাশি হাসপাতাল ও পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন কল-কারখানায় কাজ করেন। পুরুষ কর্মীদের বিদেশে যাওয়া পরিবার ও সমাজ ভালোভাবে গ্রহণ করলেও নারীদের বেলায় সচরাচর তেমনটি ঘটে না। তারা নানা সমস্যা মোকাবেলা করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছেন। অপরদিকে সংখ্যায় বিশ ভাগের এক ভাগ হলেও পুরুষ কর্মীর তুলনায় নারীরাই বেশি অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন। যেখানে বেশিরভাগ পুরুষ শ্রমিক গড়ে ৫০ ভাগ টাকা প্রেরণ করেন, সেখানে নারী শ্রমিকরা গড়ে ৯০ ভাগ টাকা দেশে পাঠান বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।

দুঃখের বিষয়, বিদেশে অবস্থানরত নারী শ্রমিকদের অধিকাংশই যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এই হার অনেক বেশি। একটু ভালো থাকার আশায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ করতে গিয়ে মূল্যটা তাদের কম দিতে হচ্ছে না। নির্যাতনের শিকার কয়েক নারী জানান, বিদেশে অবস্থানকালে তাদের বৈদ্যুতিক শক, সিগারেটের আগুন দিয়ে ছ্যাঁকাসহ অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। পিপাসা পেলে বাথরুমের পানি ও ক্ষুধা পেলে বাসিপচা খাবার খেতেন। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের লিবিয়ায় প্রেরণ বন্ধ থাকলেও সেখানেও নারী শ্রমিকদের পাঠানো হচ্ছে।

কোনো রকম চিন্তা-ভাবনা না করে বিদেশে নারী শ্রমিক প্রেরণের ফলে তাদের বড় অংশকেই নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। শারীরিক নির্যাতন, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না দেওয়া, কর্ম-ঘণ্টা বেশি এবং ফোন ব্যবহারের সুযোগ না দেওয়া তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশি নারীকর্মীদের পূর্ণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কূটনীতি মোটেই শক্তিশালী নয়। জিরো মাইগ্রেশনে নারী শ্রমিকরা এখন বিদেশ যেতে পারছেন। কিন্তু প্রত্যেক নারীকর্মী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দালালি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এরপর বিদেশে গিয়ে যৌনসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে অবগত থাকলেও অজ্ঞাত কারণে পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সৌদি ও ওমানের গৃহকর্তাদের এক বিরাট অংশ বন্দি নারী শ্রমিকদের ওপর নিয়মিত যৌন ও শারীরিক নির্যাতন চালায়। কিন্তু তাদের পরিত্রাণের উপায় নেই। বিশেষ করে বাহরাইনের মতো দেশ যেখানে লেবার অ্যাটাচে নেই, সেখানে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের বিপদে পড়তে হচ্ছে বেশি। তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েও এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। অন্যদিকে লেবার উইংগুলোতে নারী কর্মকর্তা কম থাকায় নারীরা তাদের সমস্যার কথা ঠিকভাবে বলতেও পারেন না। ওমানের অনেক বাড়িতে বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা বন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশ প্রবাসী গৃহ-শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে অধিক সচেতন। তাদের চুক্তিপত্রে যথেষ্ট কঠোরতা দেখানো হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব ও জর্দানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী শ্রমিক পাঠানোর হার বেড়েছে। কিন্তু তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে চুক্তিপত্রে কিছুই থাকছে না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজের চাপ খুব বেশি। সেখানে প্রতিটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় একেকজন গৃহকর্মীকে রাত-দিনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়।

বিদেশের মাটিতে বিপুলসংখ্যক নারীকর্মী কাজ করলেও তাদের সমস্যার সমাধান কিংবা সহযোগিতার জন্য নেই কোনো তেমন শেল্টার হোম, দ্রুত সহযোগিতা পাওয়ার জন্য নেই হটলাইন। অনেক দেশেই বাংলাদেশি নারীকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে সহযোগিতা চাইলেও পাচ্ছেন না। অনেক নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশ করতে বা প্রতিকার পেতে লজ্জাবোধ করেন। পত্রপত্রিকায় যা প্রকাশ হচ্ছে বাস্তবে নারী নিগ্রহ বা নারী নির্যাতনের হার তার চেয়ে অনেক বেশি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ভাষা। কর্মীর সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা বা ইংরেজি না জানার কারণে মালিক-কর্মী ভুল বোঝাবুঝি বেশি হচ্ছে।

সরকারি হিসাবে, গত ৪০ বছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের এই অর্থ পাঠিয়েছেন ১৬১টি দেশে থাকা প্রায় ১ কোটি ৪ লাখ প্রবাসী। যার মধ্যে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী নারী শ্রমিকও রয়েছেন। কয়েকটি পদক্ষেপ নিলে বিদেশে আমাদের নারীকর্মীদের নির্যাতনের হার কমে যাবে বলে ধারণা করা যায়। জনশক্তি প্রেরণের সময় নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে চুক্তি করতে হবে। ভাষা সমস্যা সমাধানের জন্য কর্মী প্রেরণের আগে সংশ্লিষ্ট দেশের এবং ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে। চুক্তিতে উল্লেখিত কাজের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ প্রদান করে কর্মী প্রেরণ করতে হবে। অদক্ষ কর্মী প্রেরণ বন্ধ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। বিদেশে যেখানে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা বিপুলসংখ্যায় কাজ করছেন সেখানকার দূতাবাসগুলোতে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাহলে নারী শ্রমিকরা নির্দ্বিধায় ও খোলাখুলি তাদের সমস্যার কথা বলতে পারবেন। এতে প্রয়োজনীয় ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে সুবিধা হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নারীকর্মীর পরিচয় গোপন রাখা বাঞ্ছনীয়। কেননা এর ফলে নির্যাতিত অন্য নারীকর্মীরা পরবর্তী সময়ে নিঃসঙ্কোচে তাদের সমস্যার কথা শেয়ার করতে পারবেন। 

আবু আফজাল মোহা. সালেহ

উপপরিচালক, বিআরডিবি

abuafzalsaleh@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads