• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
যিনি হৃদয়কে উজ্জীবিত করেন

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ছবি : সংরক্ষিত

মতামত

স্যারের জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

যিনি হৃদয়কে উজ্জীবিত করেন

  • প্রকাশিত ২৩ জুন ২০১৮

বাংলা ভাষায় ‘অশীতিপর’ শব্দটি অভিধানের সাদামাটা ব্যাখ্যায় খুব নিরীহ শোনায় : ‘ঊনআশির পর যে সংখ্যা; আশির ওপর বা অধিক,’ কিন্তু কারো বয়স বর্ণনায় এর অভিঘাতটা বিকট। অশীতিপরেরা বৃদ্ধই হন এবং লোলচর্ম; তাদের চলৎশক্তি স্তিমিত, মানসিক কর্মক্ষমতা লোপ পাওয়ার পথে ইত্যাদি। অনেক মানুষের ক্ষেত্রে এসব সত্য বলেই এই শব্দের ব্যবহার্যতায় নেতির ছায়াটা বেশি। কিন্তু কোনো কোনো মানুষ আছেন, যাদের কাছে এই বর্ণনাটি নেতির ধার হারায়। কারণ, তারা চিন্তার সক্রিয়তা, মনের তারুণ্য আর চরিত্রের দৃঢ়তাকে ধরে রাখেন যৌবনের শক্তি দিয়ে। তাদের দৃষ্টিতে অস্পষ্টতা নেই, বিশ্বাসের কথাগুলো উচ্চারণে জড়তা নেই; তারা আলো ছড়াতে ছড়াতে যে পথে হাঁটেন, তাতে পা রাখতে অনেক তরুণও দ্বিধায় পড়েন। তেমন একজন মানুষ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আজ তিনি ৮৩তম জন্মদিনে পা রাখলেন, অশীতিপর হলেন। কিন্তু অশীতিপর কথাটি তাকে দেখে লজ্জা পাবে, অভিধানের নিরাপদ জগতে আশ্রয় নেবে। অধ্যাপক চৌধুরীকে সাড়ে চার বছর শ্রেণিকক্ষে পেয়েছি শিক্ষক হিসেবে, তারপর থেকে এখন পর্যন্ত পেয়েছি সহকর্মী হিসেবে; না, কথাটাতে একটু অহমিকা ঠাঁই নিল; কথাটা এভাবে বলি : তারপর থেকে তিনি আমাকে সহকর্মী হিসেবে গ্রহণ করে নিলেন। তার হাত ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে ঢুকেছিলাম, সেই ১৯৭৪-এর হেমন্তে। এখনো তিনি আমার শিক্ষক, পথপ্রদর্শক। শ্রেণিকক্ষে তাকে দেখে বুঝেছিলাম, শিক্ষক হিসেবে তিনি যে উচ্চতায় আসীন, যেখানে পৌঁছাতে হলে এক জীবনের সাধনার প্রয়োজন। সেই সাধনা এখনো আমার অব্যাহত।

অধ্যাপক চৌধুরী সেই শিক্ষক, যিনি শুধু শ্রেণিকক্ষে পড়ান না, যদিও ওই পড়ানোতে মনের জানালাগুলো খুলে যায়— যিনি বাইরের পৃথিবীতেও দৃষ্টি দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তিনি নীতিবাগিশ না হয়েও নৈতিকতার পাঠগুলো দিয়ে যান; তিনি তার শিক্ষার্থীদের কতগুলো আদর্শের সন্ধান দেন, যাদের সঙ্গে আছে উদার মানবিকতা আর অগ্রসর চিন্তার অবিচ্ছিন্ন সংযোগ। অধ্যাপক চৌধুরী শেখান মানুষের অধিকারের প্রশ্নে সক্রিয়তার কথা। স্মরণ করিয়ে দেন মাটি আর মানুষের কাছে আমাদের ঋণের কথা। তিনি সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতি, ক্ষমতা আর শ্রেণিচেতনার আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বোঝান, জ্ঞানসাধনার সঙ্গে প্রায়োগিকতার হিতকরী প্রয়োজনীয়তার সম্পর্কটি ব্যাখ্যা করেন। একজন তরুণ শিক্ষার্থী খুব পরিষ্কার বুঝতে পারে, সাহিত্য ও সমাজপাঠে তার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং লৌকিক আচারগুলোকে তার দৃষ্টিতে রাখতে হবে। অধ্যাপক চৌধুরী যখন আধুনিক সাহিত্য পড়াতেন, আমাদের সামনে পশ্চিমকেন্দ্রিক বিশ্বের আধুনিকতার বিকার বিক্ষোভের জগৎটি যেমন ধরা দিত, আমাদের নিজস্ব আধুনিক চিন্তার সূত্রগুলো তেমনি খুলে যেত।

অধ্যাপক চৌধুরী জীবনের শুরু থেকেই শিক্ষকতার সঙ্গে লেখালেখির একটি সক্রিয় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। কত বিচিত্র বিষয়ে তিনি লিখেছেন— তার লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও বইয়ের সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন। কিন্তু প্রতিটি লেখাই তার প্রজ্ঞা, মনস্বিতা আর ধীশক্তিতে উজ্জ্বল। তার দেখার দৃষ্টি তীক্ষ, তার বর্ণনার ভাষা জাদুকরী। যেকোনো কঠিন বিষয় তিনি একজন তরুণ শিক্ষার্থীর অনুধাবনের ভেতরে নিয়ে আসতে পারেন। সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ, বাঙালির আত্মপরিচয় ও জ্ঞানচর্চা, বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ ও বিকাশ, শিক্ষা, দর্শন ও রাজনীতি, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এবং বিশ্বায়নের বিপদ, আধিপত্যবাদ ও গণতন্ত্র চিন্তা, ইহজাগতিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা, নারীবাদ ও নারী প্রগতি, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ ও পরিবেশ সক্রিয়তা, মানবাধিকার ও বিচার— খুব কম বিষয়ই আছে, যার ওপর তার অধিকার তিনি প্রতিষ্ঠা করেননি। মূল যে ভুবনে তিনি বিচরণ করেন, সাহিত্য; সেখানে তিনি অনেক তাত্ত্বিক আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। সেসব আলোচনাকে ঘিরে সম্পর্কিত অনেক বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু তত্ত্বের শৃঙ্খলিত চিন্তাকে তিনি সযত্নে পরিহার করেছেন।

সাহিত্যের অশুভ চিন্তা নিয়ে লিখেছেন, উত্তর-উপনিবেশ পঠনে নানান লেখক ও কাজকে ব্যাখ্যা করেছেন, নব্য ইতিহাসবিদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শেকসপিয়র অথবা বঙ্কিমচন্দ্রকে ব্যাখ্যা করেছেন, নিম্নবর্গীয় ইতিহাসবিদের অবস্থান থেকে সাহিত্যের অবহেলিত চরিত্রদের পাঠ করেছেন, কিন্তু কোনো তাত্ত্বিকতার সাদাকালো ছকে ফেলে তার চিন্তাকে সাজাননি। তিনি অনেক তত্ত্বকে নিজের মতো করে ব্যবহার করেছেন, অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে, তার নানান বিশ্লেষণী চিন্তার সূত্রগুলো ধরে ধরে এগোলে এসব তত্ত্বের একটা সারাৎসার দাঁড় করানো যায়। যুগের চিন্তা যারা সূক্ষ্মভাবে ধারণ করেন এবং যাদের চিন্তা গতিশীল, তাদের লেখায় একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি নিজ থেকেই তৈরি হয়, যার আলোকে তাদের পড়াটা সহজ হয়।

অধ্যাপক চৌধুরী যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন তা গণমুখী, অন্তর্ভুক্তিমূলক, যা দরিদ্র ও মেহনতি মানুষ, কৃষক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দায়বদ্ধ; তিনি যে শিক্ষাদর্শনে বিশ্বাস করেন তা সর্বজনীন, বিজ্ঞানমনস্ক ও বৈষম্যহীন; যে সমাজ কল্পনা করেন, তা শ্রেণি আর পুঁজির শাসন এবং ধর্ম-বর্ণভিত্তিক বিভাজনকে প্রতিরোধ করে সব মানুষের একটি অভিন্ন ঠিকানা হয়ে দাঁড়ায়; যে সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেন তা জীবনমুখী এবং শিকড় সন্ধানী। তার এসব বিশ্বাসকে তিনি তার অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন, এ জন্য তাদের সাহিত্যপাঠ চিন্তামুক্তির এক বড় উপায় হিসেবে দেখা দেয়। এই কাজটি করতে পারেন খুব কম শিক্ষক ও চিন্তাবিদ। অধ্যাপক চৌধুরী সাহিত্য সম্পাদক ও অনুবাদক হিসেবে সফল; তিনি সৃজনশীল লেখায়ও উৎকর্ষ দেখিয়েছেন। যে মানুষ তার সান্নিধ্যে এসেছে, সে ঋদ্ধ হয়েছে। ৮৩তম জন্মদিনে পা দেওয়া এই শিক্ষাগুরু ও জীবন-দার্শনিককে অভিবাদন। স্যার, আপনার জন্মদিনে কামনা করি, আপনি সুস্থ শরীর ও সচল মন নিয়ে আরো দীর্ঘদিন আমাদের পথ দেখাবেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

কথাসাহিত্যিক। সাবেক অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads