• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
মাদক ও মাদকবিরোধী অভিযান

মানুষ নেশার জন্য যা ব্যবহার করে সেটাই মাদক

আর্ট : রাকিব

মতামত

মাদক ও মাদকবিরোধী অভিযান

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ০২ জুলাই ২০১৮

আমাদের দেশে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়। হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর জঙ্গি দমনের অভিযান জোরদার করা হয়, যা এখনো চলমান। মাঝে মাঝেই কোনো কোনো বাড়ি ঘিরে ফেলে জঙ্গি দমন অভিযানের খবর পাওয়া যায়। এমনকি আত্মঘাতী বোমাসমেত মহিলা জঙ্গিও ধরা পড়ে। সারা দেশে এত জঙ্গি ছিল ভেবে বিস্মিত হতে হয়।

মশক নিধন অভিযান, কুকুর নিধন অভিযান, ভিক্ষুক বিতাড়ন অভিযান থেকে শুরু করে নানা ধরনের অভিযান দেখতে আমরা অভ্যস্ত। কিছুদিন ধরে চলছে মাদকবিরোধী অভিযান। ব্যাপরটা শুভ। কিন্তু মনে মনে ভাবি, এই অভিযানে মাদক ব্যবহার কতটা কমবে? যদি শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, তাহলে তো অবশ্যই ভীষণ খুশির খবর। মাদকবিহীন সমাজ কে না চায়! আমরা জানি, যেকোনো অভিযানের পেছনেই ব্যয় হয় রাষ্ট্রের অগুনতি টাকা। কতটা খরচ হলো আর ফল কতটা এলো সেটাও বিবেচনার বিষয়।

মাদক এমন এক জিনিস, যা মানুষের মধ্যে আসক্তি তৈরি করে ধীরে ধীরে মানুষকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায়। মানুষ নেশার জন্য যা ব্যবহার করে সেটাই মাদক। সেটি হতে পারে ইনজেকশন, ধূমপান বা যেকোনো দ্রব্য। বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্যের মধ্যে আছে হেরোইন, কোকেন, ইয়াবা, আফিম, মারিজুয়ানা, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিয়ার, কেটামিন, স্পিরিট, বিভিন্ন রকম ঘুমের ওষুধ থেকে শুরু করে জুতোয় লাগানোর আঠা পর্যন্ত। মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষ ধীরে ধীরে মাদকের প্রতি হয়ে পড়ে নির্ভরশীল, যাকে বলা যায় আসক্তি। আমাদের সমাজে মাদক গ্রহণের সংখ্যা কম নয়। মাদকাসক্তরা সাধারণত তন্দ্রাচ্ছন্ন, ভাবালু, মেজাজের পরিবর্তন, রক্তচাপ ইত্যাদি রোগে ভোগে। তা ছাড়া তারা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়, চোখের দৃষ্টিও হারিয়ে ফেলে। এ ছাড়াও আছে শারীরিক-মানসিক নানা রোগ।

আলোচনাটি শুরু হলো মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে। র্যাবের ভাষ্যমতে, এই অভিযান শুরু হয়েছে ৪ মে থেকে। এর আগে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করে নিরাপত্তা বাহিনী। যার স্লোগান ছিল ‘চলো যাই যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে।’ ২৫ জুন ২০১৮ মাদকবিরোধী দিবস উপলক্ষে সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘যত দিন মাদক নির্মূল না হবে, তত দিন এ অভিযান চলবে।’ তিনি বলেন, অন্তত ২২ হাজার লোককে এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে। এ অভিযানে বেশকিছু লোক নিহত হয়েছে বলেও জানা যায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ অভিযানে সত্যিই কি মাদক নির্মূল হবে? আমরা জানি, এ ধরনের অভিযান বিশ্বে নতুন নয়। আমেরিকা এই অভিযান শুরু করেছে সত্তরের দশক থেকে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেখানেই এই ধরনের অভিযান চলেছে সেখানেই সাময়িকভাবে মাদকের প্রভাব কমেছে; এটা শুভ লক্ষণ। পাশাপাশি আবার মাদকের দামও বেড়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্থায়ী কোনো সমাধান হয় না। কলম্বিয়ায় ২৬ বছর ধরে এই অভিযান চলছে। সেখানে এ পর্যন্ত ৯.৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। অথচ কোকেনের চাষ কমেনি, বরং বেড়েছে। সে দেশের প্রায় পাঁচ বিলিয়ন হেক্টর জমি কোকেন সম্রাটরা দখল করে রেখেছে। আফগানিস্তানে আমেরিকার ড্রোন উপেক্ষা করেও কোকেনের চাষ বেড়েছে। ২০০৮ সালে যেখানে ছিল মাত্র ২০০ টন, বর্তমানে সেখানে বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ১০ হাজার টন।

মাদকের এই প্রভাব যুবসমাজকে অজগরের মতো গিলে ফেলে। যে একবার মাদকাসক্ত হয় মাদক থেকে বেরিয়ে আসা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। মাদকাসক্ত লোককে মাদকের লোভ দেখিয়ে যেকোনো অন্যায় কাজ করানো সম্ভব হয়। মাদক না পেলে তারা পাগলের মতো হয়ে যায়, হিংস্র হয়, এমনকি আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ আমরা ঐশীর কথা স্মরণ করতে পারি। মাদকাসক্ত ঐশী নিজ হাতে তার পিতা-মাতাকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয়নি।

মানুষ মাদক গ্রহণ করে সহজ আনন্দ লাভের আশায়। নতুন অভিজ্ঞতা লাভের প্রয়াসে এবং পারিবারিক পরিমণ্ডলে মাদকের ব্যবহার থাকলে কৈশোর ও যৌবনে বেপরোয়া মনোভাব দেখা যায়। তার ওপর যেকোনো ধরনের হতাশায় সে নিমজ্জিত হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় অকৃতকার্য, বেকারত্ব, হাতে টাকা না থাকা এমন বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। সাধারণত দেখা যায়, ব্রকেন ফ্যামিলির ছেলেমেয়েরা বেশি মাদকাসক্ত হয়। তা ছাড়া একবার যদি কেউ কৌতূহল মেটাতে বা বন্ধুদের কুসঙ্গে পড়ে মাদক নেয়, ধীরে ধীরে সে মাদাকাসক্ত হয়ে পড়ে। মাদকের জাদু থেকে সে আর বেরিয়ে আসতে পারে না।

অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, মাদক ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য শিক্ষালয়গুলো। সেখানে মাদক ছড়িয়ে দিতে পারলে মাদকসেবী হিসেবে বহু নতুন মুখ পাওয়া যাবে। ব্যবসার স্বার্থেই মাদক ব্যবসায়ীরা কোমলমতি ছেলেমেয়েদের টার্গেট করে শিক্ষাঙ্গনে ধীরে ধীরে মাদক ছড়িয়ে দেয়।

মাদকের একটি প্রধান কারণ হচ্ছে বেকারত্ব। দেশে লাখ লাখ লোক বেকার। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ প্রণীত ১৭টি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) অর্জন ও সর্বোপরি উন্নত বাংলাদেশ গড়তে এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদকের অভিশাপ থেকে রক্ষা ও কর্মক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। তাদের কাজে যুক্ত করার জন্য অবশ্যই নীতিনির্ধারকদের গ্রহণ করতে হবে নতুন নতুন পরিকল্পনা ও দায়িত্ব। তরুণ জনগোষ্ঠীকে যুক্তিসঙ্গত, যুগোপযোগী ও সময়ের দাবি অনুযায়ী যদি মাদকের হিংস্র থাবা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়, তাহলে অবশ্যই তার সুফল পাবে জাতি ও দেশ। এতে কর্মক্ষম লাখ লাখ তরুণকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত করা যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে এসব তরুণকেই প্রয়োজন পড়বে সবচেয়ে বেশি।

আসলে যারা বেকার, ঘরে-বাইরে তাদের কোনো সম্ভ্রম নেই। সর্বক্ষণ তারা পরিবারের গঞ্জনা শুনতে থাকে। আত্মবিশ্বাস নেমে আসে তলানিতে। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হলে এর ফল বা লাভ কতটুকু পাওয়া যাবে তা ভেবে দেখার বিষয়। আমরা ক্রমাগত আধুনিক হচ্ছি। যৌথ পরিবার ভেঙে পড়েছে, একক পরিবারে বাবা-মা ব্যস্ত। তাদের সময় নেই সন্তানদের সময় দেওয়ার। আর একটি শ্রেণি আছে যারা সত্যিই এতিম। এদের টার্গেট করে মাদক ব্যবসায়ীরা। স্নেহ-মায়া বঞ্চিত এসব ছেলেমেয়ে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ে মাদকের করালগ্রাসে। কাজেই বাবা-মা যদি সচেতন না হন, পাড়া-প্রতিবেশী যদি সচেতন না হন, শিক্ষালয়গুলো যদি সচেতন না হয়, কিছুতেই মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। এখন দেশে সুষ্ঠুু বিনোদনের কোনো সুযোগ নেই, খেলার মাঠ নেই, স্কুল-কলেজে আগের মতো সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হয় না, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে দেখার মতো সিনেমা তৈরি হয় কম, ভালো বইয়ের প্রচণ্ড অভাব। বিনোদনবিহীন এসব ছেলেমেয়ে একা একা থেকে জড়িয়ে পড়ে নেশায়। স্কুল-কলেজগুলোতে আগের সেই পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের পক্ষে নিতে হবে পদক্ষেপ। পাশাপাশি শিক্ষকদেরও সচেতন হতে হবে। তাদের ব্যবসায়িক মনোভাব পরিহার করতে হবে। কোচিং ব্যবসায়ী নয়, তাদের হতে হবে প্রকৃত শিক্ষক, বন্ধু। এই পদক্ষেপগুলো নিতে পারলে মাদকবিরোধী অভিযানের চেয়ে ফল কম তো হবেই না, বরং বেশি পাওয়া যাবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম সচিব

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads