• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
নয়া উদারবাদী পুরুষতান্ত্রিকতা

জুম ও কৃষি হলো প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের শ্রম ও অভিজ্ঞতার এক জটিল মিথষ্ক্রিয়া।

প্রতীকী ছবি

মতামত

নয়া উদারবাদী পুরুষতান্ত্রিকতা

  • প্রকাশিত ০৩ জুলাই ২০১৮

প্রায় ১০ হাজার বছর আগে জুমিয়া ও কৃষকরাই ভিন্ন জলবায়ু ও সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে বৈচিত্র্যময় অগণিত শস্য ফসলের বুনো জাতকে আবাদি জাতে পরিণত করেছিলেন। আন্দিজ অঞ্চলের কৃষকরা প্রায় ৩ হাজার আলুর জাত, পাপুয়া নিউগিনির কৃষকরা প্রায় ৫ হাজার মিষ্টি আলুর জাত এবং ভারতীয় উপমহাদেশের কৃষকরা হাজার হাজার ধান জাত উদ্ভাবন করেছিলেন। গোলার্ধব্যাপী নারী-কৃষকরাই আবাদি জাতের বীজ মজুত, বিস্তারের কৌশল ও ধারা বংশ থেকে বংশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। বীজ বংশ রক্ষায় নারীর এ অবিস্মরণীয় ভূমিকাকে আমল না দিলেও দুনিয়ার জুম-কৃষি ও খাদ্য-ভূগোল ডানা মেলেছে নারীর বীজরক্ষার কোলজুড়েই। কিন্তু কে ধারণা করেছিল বীজসম্পদকেও পুঁজিবাজারের পণ্য করা হবে? নারীর বীজভান্ডারের মজুত নিঃস্ব করে বীজের নিয়ন্ত্রক ও মালিক হয়ে উঠবে দশাসই সব বহুজাতিক কোম্পানি?

 

জুম ও কৃষি হলো প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের শ্রম ও অভিজ্ঞতার এক জটিল মিথষ্ক্রিয়া। কৃষি ও জুমের ঠিকুজি হলো বীজপ্রাণসম্পদ। যুগ যুগ ধরে নারী-কৃষকরাই কৃষি ও জুমের এ ঠিকুজি গণনাবিচার করলেও পণ্যবিশ্বায়নের এ যুগে বীজ-ঠিকুজি নিয়ন্ত্রণ করছে করপোরেট কৃষি-বিষ ও বীজ কোম্পানিগুলো। ষাটের দশকে তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে কৃষকের এ বীজ-ঠিকুজি দখলের বৈশ্বিক বাণিজ্য-রাজনীতি শুরু হয়েছিল। মাত্র পঞ্চাশ বছরে আজ আর গ্রামের কোনো কিষানী বা জুমপাহাড়ের আদিবাসী জুমিয়া নারী দেশের বীজসম্পদের মালিক নয়। বীজসম্পদ এখন কোক-পেপসি কি মশার কয়েলের মতো বাজারে কেনাবেচার পণ্য। কোম্পানির মর্জিমাফিক এখন একেক বীজের একেক নাম, একেক বীজের একেক দাম। বীজকে পণ্যে পরিণত করার ভেতর দিয়ে নারী-কৃষকের সামাজিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বীজের মতো সামাজিক সম্পদের রক্ষক থেকে নারী ও পুরুষ সব লিঙ্গের কৃষককেই বীজের প্রশ্নহীন ক্রেতা ও বীজ-দাসে পরিণত করা হয়েছে। বীজসহ জনসম্পদ দখলের এই নয়া উদারবাদী পুরুষতান্ত্রিক সহিংসতাগুলোকে বৈধতা দেওয়ার ভেতর দিয়েই টিকে থাকছে বাংলাদেশের মতো কৃষিভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র। তাই দেখা যাচ্ছে, দেশের আইন কি নীতি সবকিছুকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে সিনজেনটা, কারগিল, বায়ার ক্রপ সায়েন্স কি মনসান্টোর কোম্পানিগুলোই আজ বাংলাদেশের বীজসম্পদের একতরফা দখল নিয়ে বাণিজ্য চাঙা রেখেছে।

 

২.

নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের প্রশ্নে বরাবর নারীর জুম-কৃষি অধিকারের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। এই বহুজাতিক পণ্য ব্যবস্থায় নারীর ওপর সবচেয়ে মারদাঙ্গা নির্যাতনই করপোরেট নির্যাতন। জুম-কৃষির মতো নারীর নিজস্ব স্বনির্ভর জীবিকা ও প্রতিবেশ থেকে নারীকে উচ্ছেদ করে, নারীর বীজ সংরক্ষণের ধারাবাহিক চর্চাকে বিপন্ন করে যখন মনসান্টো, সিনজেনটা, বায়ার ক্রপ সায়েন্স, এসিআইসহ করপোরেট কোম্পানির প্যাকেটে প্যাকেটে বন্দি হয়ে যায় নারীর শস্য ফসলের বীজভান্ডার। নারীর ঔষধি জ্ঞান ও উদ্ভিদ পেটেন্ট করে যখন ফাইজার কোম্পানির ব্যবসা চাঙা হয়, আদিবাসী নারীদের কাপড়ের ডিজাইন যখন হয়ে ওঠে করপোরেট ফ্যাশন ব্যবসা, নারীর ওপর যখন চেপে বসে কোকাকোলা-পেপসি-ম্যাকডোনালসের মনোপলি বাজার, তখন ‘নির্যাতন’ বিষয়টিকে আর কেবল একধরনের ব্যাখ্যা হিসেবে ভাবা যায় না। আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা পরামর্শক দল (সিজিআইএআর), আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইরি), বিশ্বব্যাংক, তথাকথিত সবুজ বিপ্লবসহ নানান করপোরেট মদত যখন নারীর নিজস্ব খাদ্য সার্বভৌম ব্যবস্থাকে উল্টে-পাল্টে দিয়ে নারীকে করে তুলল ব্যবস্থার ‘পণ্য পুতুল’, তখন বদলকারী ব্যবস্থার কৌশলকে কখনোই নারীর ওপর ‘নির্যাতন-নিপীড়ন-সহিংসতা’ হিসেবে দেখা হয়নি, দেখা হয়েছে উন্নয়ন হিসেবেই। নারীর ওপর করপোরেট সহিংসতাগুলোকে আড়াল করার ভেতর দিয়ে কি বারবার ব্যবস্থার পুরুষতান্ত্রিক উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রের পৌরুষকে আরো চাঙা ও অবধারিত করে তোলে না? নারীর ওপর নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার প্রশ্নহীন এ লাগাতার করপোরেট সহিংসতা টিকে আছে অনিবার্য পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো এবং এর পরিবেশক অধিপতি রাষ্ট্রের জোরেই। নারীর ওপর অনুচ্চারিত এ পুরুষতান্ত্রিকতাকেই আজকে আমরা ‘নয়া উদারবাদী পুরুষতান্ত্রিকতা’ হিসেবে পাঠ করছি।

 

নারীর ওপর নির্যাতন এবং সহিংসতাকে অধিকাংশ সময়ই শুধু শারীরিক নিপীড়ন-ধর্ষণ-আঘাত এবং বাল্যবিয়ে বা যৌতুক দিয়েই পাঠ করানোর ব্যবস্থা থাকে। জাতিসংঘের নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদের (১৯৯২) ৭৯৮ পৃষ্ঠার দলিলের প্রস্তাবনা অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বসনিয়া এবং হারজেগোভেনিয়ায় বিশেষ করে মুসলিম নারীর ওপর ব্যাপক সংঘটিত ও পদ্ধতিগত ধর্ষণের খবরে মর্মাহত। কিন্তু নারীর আপন বিরাজমানতার সংসার ও স্থানীয় পরিসরনির্ভর কাঠামো যখন করপোরেট কোম্পানির বাণিজ্য-আঘাতে চুরমার হয়ে যায়, তখন সেসব আঘাতকে নারীর প্রতি সহিংসতা হিসেবে দেখানো হয় না বা দেখানোর কোনো প্রচলন তৈরি হয় না। এর মানে এই নয় যে, নারীর ওপর সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক আঘাত এবং সহিংসতাকে আমরা কোনোভাবে ‘পাশ’ কাটিয়ে যাচ্ছি। একেবারে খোলামেলাভাবে বললে বলা যায়, যখন পাহাড়-টিলা-সমতলের নারীর কৃষি বা জুমের ভেতর ঢুকে পড়ে মনসান্টো বা সিনজেনটা কোম্পানির কৃষিবাণিজ্য অথবা নারীর যুগান্তরের প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর জ্ঞানপরিসরকে ধাক্কা মেরে যখন চালু হয় করপোরেট পণ্য বাজার, তখন সেই বলপ্রয়োগকে আমরা সহিংসতা হিসেবেই পাঠ করতে আগ্রহী এবং তা বিপন্ন করে তোলে নারীর আপন অস্তিত্ব। নারীর সমঅধিকার বা নারী উন্নয়নের সব প্রেক্ষিতেই এই সহিংসতা আড়ালের চেয়েও আড়ালে, প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর বাহাসের ময়দানে থেকে যাচ্ছে। তথাকথিত নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার এ সহিংস ধারাকে ‘নয়া উদারবাদী পুরুষতান্ত্রিকতা’ হিসেবে প্রথম আমাদের নজরে আসে বাংলাদেশের রাজশাহী ও চুয়াডাঙ্গায় হাইব্রিড টমেটো এবং ভুট্টা বীজ কিনে নিঃস্ব ও প্রতারিত হওয়া কৃষকদের ক্ষেত্রে। যখন দেখা গেল সিনজেনটার এসব হাইব্রিড বীজ কিনে বাংলার কৃষকের জমি থাকল ফসলহীন এবং কৃষকরা হলেন প্রতারিত। 

 

সিনজেনটা প্রথম থেকেই বীজ-প্রতারণার বিষয়টি নয়া উদারবাদী পুরুষতান্ত্রিক কায়দায় ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল নানাভাবে। কৃষক, গণমাধ্যম, জনপ্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক সংগঠন, গবেষক, লেখক, কৃষি অফিস, আদালত থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সর্বত্রই বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচিত হওয়ায় ওই কোম্পানির চাতুরি ধোপে টেকেনি। কৃষকদের আন্দোলনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে সিনজেনটার মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বীজসম্পদের ‘ব্যবসা’ করে, কিন্তু কৃষকরা বীজকে বারবার কৃষির বংশরক্ষার এক ‘সামাজিক মালিকানার সম্পদ’ হিসেবে দেখতে চায়। বীজ সংরক্ষণের যাবতীয় দায়দায়িত্ব রাষ্ট্র যখন কৃষক-নারীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে করপোরেট কোম্পানির কাছে দাসখত দেয়, তখন বীজবাণিজ্যের এই নয়া কৌশলকে নারীর ওপর পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচার হিসেবেই আজ পাঠ করতে হয়। লিঙ্গীয় ন্যায়বিচারের সুরক্ষায় নয়া উদারবাদী পুরুষতান্ত্রিকতা ও নারীর ওপর সব ধরনের পুরুষতান্ত্রিক করপোরেট সহিংসতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা জরুরি। ‘নারী-অধিকার’ কি ‘নারী-পুরুষের সমঅধিকার’ নিয়ে গলাফাটানো নাগরিক আওয়াজেও কখনোই এ ধরনের করপোরেট সহিংসতাকে পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন হিসেবে দেখা হয় না। এটি চলতি নাগরিক আন্দোলনের এক ‘হেজিমোনাইড দশা’ হলেও আজ বাংলার নারীর সুরক্ষায় সব ধরনের করপোরেট প্রতারণার বিরুদ্ধেই দাঁড়ানো বাঞ্ছনীয়। অথচ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে আমরা বার বার ব্যর্থ হয়েছি। বিশ্বজুড়ে আজ নয়া উদারবাদী করপোরেট পুরুষতান্ত্রিক দাসত্ব পরিলক্ষিত হতে দেখি। কিন্তু আমরা এও মনে করি, একদিন সব মিথ্যাচার, প্রতারণা, পুরুষতান্ত্রিকতা ও দাসখতের বিরুদ্ধে জনগণই রচনা করবে বাংলার নারী-কৃষকের কৃষি খাতের দুর্বিনীত ইশতেহার।

পাভেল পার্থ

গবেষক, পরিবেশবিদ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads