• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ট্রাম্প-উনের বৈঠকে নতুন ইতিহাসের সূচনা

ট্রাম্প-উনের বৈঠকে নতুন ইতিহাসের সূচনা

ছবি : ইন্টারনেট

মতামত

ট্রাম্প-উনের বৈঠকে নতুন ইতিহাসের সূচনা

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ০৩ জুলাই ২০১৮

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সারা বিশ্বের যে কয়টি স্থানে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে কোরীয় উপদ্বীপ। আমরা জানি, ১৯৫০-৫৩ সাল পর্যন্ত দুই কোরিয়া যুদ্ধ চালিয়ে একটি যুদ্ধবিরতিতে যায়, তবে শত্রুতা থেমে ছিল না। তাদের মধ্যে বিরাজ করছিল যুদ্ধপরিস্থিতি, একে অপরের প্রপাগান্ডা ছাড়াও সুযোগ পেলেই ক্ষয়ক্ষতি করা, বিভিন্নভাবে ভীতি প্রদর্শন করা ছিল সাধারণ বিষয়। দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশ আমেরিকা এবং উত্তর কোরিয়ার পক্ষে ইদানীং গোটা বিশ্বে প্রভাব সৃষ্টিকারী দেশ চীন কাজ করে আসছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা, উত্তর কোরিয়াকে ভীতি প্রদর্শন ও কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য ৩২ হাজার সেনা মোতায়েন করে রেখেছে এবং প্রতিবছর নিয়মিত যুদ্ধ মহড়া চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে গত এপ্রিলের (২০১৮) শেষভাগে দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তবর্তী গ্রাম পানমুনজমে ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতা মুন জে ইন। দুই দফা বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় তারা ৬৮ বছরের যুদ্ধের ইতি টানার ও কোরীয় উপদ্বীপকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার ঘোষণা দেন।

তারই ধারাবাহিকতায় সিঙ্গাপুরের সেন্টোসা দ্বীপের বিলাসবহুল কেপেল্লা হোটেলে ১২ জুন যা ঘটল, তার পুরোটাই নতুন ইতিহাস। বেশ কিছুদিন ধরে হুমকি-ধমকি ও বাগ্যুদ্ধের পর ওইদিন প্রথমবারের মতো বৈঠকে বসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং-উন। এটি ছিল দীর্ঘদিনের বৈরী দুই দেশের শীর্ষ দুই নেতার প্রথম সরাসরি শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব। এরপর ট্রাম্প-কিম একান্ত বৈঠক। দুই দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠক। দুই নেতার চুক্তি স্বাক্ষর। এই আলোচনা ও চুক্তি শুধু কোরীয় উপদ্বীপে নয়, পুরো বিশ্বেই ছড়িয়ে দিয়েছে শান্তির বারতা। দুই নেতার কথাতেই বোঝা গেল সাত দশকের জমাট বরফ গলতে শুরু করেছে। কাটতে শুরু করেছে পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কা। দুই নেতার যৌথ বিবৃতিতেও এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এতে কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করা এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এ ছাড়া ট্রাম্প উত্তর কোরিয়াকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই বৈঠককে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এটি কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার পথে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো জোট, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান ও রাশিয়ার কাছ থেকেও সাধুবাদ জানানো হয়েছে। সিঙ্গাপুরের সেই ঐতিহাসিক বৈঠকের পর ট্রাম্প তার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার দারুণ লাগছে। আমি অসাধারণ সাফল্যের প্রত্যাশা করছি। আমাদের মধ্যে যে দারুণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে, সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’ কিম বলেন, ‘আজকের এ অবস্থায় আসতে আমরা অনেক কিছু করেছি। অতীতের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। আমরা সেগুলো জয় করে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছি। বিশ্ব বড় একটা পরিবর্তন দেখবে।’ চুক্তি স্বাক্ষরের পর ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার নেতাকে বলেন, ‘আমরা আবার দেখা করব। আমরা আরো বহুবার সাক্ষাৎ করব।’ দুই নেতার প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি পদক্ষেপ বিশ্ব অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অবলোকন করছে।

বৈরিতা থেকে বন্ধুত্বের দিকে এই দুই নেতার এগিয়ে যাওয়া। অতীতের সব তিক্ততা ভুলে একমঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও কিম জং-উন ঘোষণা দিয়েছেন এখন থেকে তারা একমঞ্চে চলবেন। অব্যাহত থাকবে সহযোগিতা।

ট্রাম্প কিমকে একজন নবীন, মেধাবী ও বুদ্ধিমান নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাদের এই বৈঠক সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আরো স্মরণ করিয়ে দেয় রোনাল্ড রিগানের সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের ১৯৮৬ সালের রিকজাভিকের শীর্ষ সম্মেলনের কথা। ২০০৪ ও ২০০৫ সালেও দেশ দুটির মধ্যে বৈঠক হয়েছিল তবে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বৈঠক ইতিহাসে এই প্রথম। কাজেই এটি সর্বোচ্চ গুরুত্বের দাবিদার।

 

চারটি বিষয়কে সামনে রেখে এই যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার শান্তি-সমৃদ্ধির জন্য দুই দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সহযোগিতার ভিত্তিতে। নতুন ‘ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া’ সম্পর্ক স্থাপনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। দ্বিতীয়ত, কোরীয় উপদ্বীপে দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র ও পিপিআরকে যৌথ উদ্যোগ নেবে। ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিলের পানমুনজম ঘোষণা পুনঃনিশ্চিত করে কোরীয় উপদ্বীপকে পুরোপুরি অস্ত্রমুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করতে ডিপিআরকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। তৃতীয়ত, উত্তর কোরিয়াকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। চতুর্থত, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক মহড়া বন্ধের প্রতিশ্রুতি। এটি খুবই ব্যয়বহুল এবং উসকানিমূলক। এ থেকেও সরে আসার ঘোষণা দিলেন ট্রাম্প।

 

ট্রাম্প কোরিয়া যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানের আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, আমরা এখন আশা করতে পারি যে, এই যুদ্ধ শিগগির শেষ হবে। তিনি বলেন, কিম তাকে বলেছেন, তারা নিজেদের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর বড় একটি স্থাপনা এরই মধ্যে ধ্বংস করেছেন। পিয়ংইয়ংয়ের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আপাতত বহাল থাকবে, পরে তা তুলে নেওয়া হতে পারে। এই বৈঠক সম্পর্কে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াংই বলেন, বড় কথা হলো দুই নেতা একসঙ্গে বসেছেন, বৈঠক করেছেন- এর একটি গুরুত্ব আছে, ইতিবাচক দিকও আছে। এটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। উত্তর কোরিয়ার গুরু চীন কোনো ধরনের উত্তেজনাকর কথা না বলে সবকিছুই শান্তির পক্ষে বলেছেন।

 

তবে কোনো কোনো কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অন্যভাবেও মন্তব্য করেছেন। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, ট্রাম্প গণমাধ্যমের নজরে থাকতে পছন্দ করেন। তিনি গণমাধ্যমে খবর হিসেবে থাকতে চান। প্রতিদিনই টুইট করে তিনি আলোচনার ইস্যু হতে চান। সে ক্ষেত্রে এটি অস্বাভাবিক নয় যে, এখানেও তিনি এ ধরনের সুযোগগুলো ব্যবহার করবেন না।

যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, কাজটি অত্যন্ত কঠিন তবে অসম্ভব নয়। আর দুই নেতা যেহেতু তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন, তাই বিষয়টি শান্তির দিকে এগোবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

 

পজিটিভ ধারণার আরো একটি কারণ হচ্ছে, দক্ষিণ কোরিয়ার শীতকালীন অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়ার খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ। কিমের এই সিদ্ধান্ত সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিল। তিনি হয়তো অনেক আগে থেকেই শান্তি স্থাপনের হিসাব কষে আসছিলেন, বাইরে থেকে যদিও তা বোঝা যায়নি। কারণ যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়, যুদ্ধ জনগণের কল্যাণ নিয়ে আসে না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাগ্যুদ্ধের মধ্যেই ট্রাম্প হঠাৎ শীর্ষ বৈঠকের প্রস্তাব দিলে কিম অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বিনাশর্তে তাতে রাজি হয়ে যান। তিনি এই সুযোগটিই হয়তো খুঁজছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকেই দুই কোরিয়ার এক হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা বলে মনে করেন। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, কোরীয় যুদ্ধের পর সই হওয়া ত্রিপক্ষীয় চুক্তির বিশেষ বিধান ভঙ্গ করে ১৯৫৮ সাল থেকেই দক্ষিণ কোরিয়ায় কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন আছে। তাই ট্রাম্পের সেনা প্রত্যাহার ও যৌথ মহড়া বন্ধের ঘোষণাকে গোটা বিশ্ব স্বাগত জানায়। এজন্য যদিও আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। তারপরেও আশাহত হতে চায় না কোরীয় উপদ্বীপের জনগণ।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads