• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
প্রশান্তির বর্ষা ও জলজট

প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণ ক্রমেই বদলে যাচ্ছে

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

প্রশান্তির বর্ষা ও জলজট

  • প্রকাশিত ০৪ জুলাই ২০১৮

ঋতু-প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মানুসারে প্রতি বছরান্তে বর্ষার আগমন ঘটে। বর্ষার আগমন প্রকৃতি ও প্রাণিকুলে অনাবিল প্রশান্তির বার্তা নিয়ে আসে। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ থেকে বর্ষা তার শীতল স্পর্শে আমাদের সজীব করে তোলে। ষড়ঋতুর আমাদের ভূখণ্ডের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ঋতুটি হচ্ছে গ্রীষ্ম। গ্রীষ্মের উত্তাপের নিষ্ঠুরতা থেকে রক্ষায় বর্ষা আমাদের প্রাণবন্ত শীতল স্পর্শে রাঙিয়ে দেয়। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ প্রকৃতিকে পর্যন্ত অতিষ্ঠ করে তোলে। সর্বত্র পানির সঙ্কট দেখা দেয়। খাল-বিল, নদ-নদী, ডোবা-পুকুর শুকিয়ে যায়। মাটির নিচের পানির স্তরও অনেক নিচে নেমে যায়। অপর্যাপ্ত পানির কারণে পানির জন্য প্রতি গ্রীষ্মে আমাদের নাকাল হতে হয়। জনজীবন হয়ে পড়ে সঙ্গিন। তবে এটাও স্বীকার্য যে, আমাদের তথাকথিত উন্নয়ন ও উন্নতির তাণ্ডবে খাল-বিল, ডোবা-পুকুর এমনকি নদী পর্যন্ত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে উন্নয়ন নামক পুঁজিবাদী তৎপরতায় গড়ে উঠেছে বিশালাকার স্থাপনা-অট্টালিকা। মনুষ্য সৃষ্ট পুঁজিবাদী এই উন্নয়নে প্রকৃতির বিনাশ যেভাবে ঘটছে, তাতে প্রকৃতির স্বাভাবিকতা নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রকৃতির নিষ্ঠুর অনাচারের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে। পুঁজিবাদী উন্নয়নের পরাকাষ্ঠে প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সন্তান মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা এখন চরম সঙ্কটের মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনে গ্রীষ্মের তীব্রতা বৃদ্ধিতে পুঁজিবাদী তৎপরতাকে অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়। উত্তপ্ত গ্রীষ্মের উপস্থিতি সে কারণে বছরজুড়েই নানাভাবে দৃশ্যমান। প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণ ক্রমেই বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে ঋতুবৈচিত্র্য পর্যন্ত। প্রকৃতির নিষ্ঠুর ও বৈরী আচরণের শিকার হতে হচ্ছে আমাদের অর্থাৎ গরিব বিশ্বকে।

জলবায়ু পরিবর্তনের মূলে পুঁজিবাদী বিশ্ব সম্পূর্ণরূপে দায়ী। জ্বালানি পুড়িয়ে, বরফ গলিয়ে, সমুদ্রকে স্ফীত করে, প্রকৃতিবিরোধী পুঁজিবাদী অপতৎপরতায় প্রকৃতিও কিন্তু বসে নেই। নানা উপায়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। প্রচণ্ড ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, টর্নেডো, আইলা-সুনামি নানা নামে নানাভাবে প্রকৃতি উত্ত্যক্তের বদলা নিচ্ছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের মাশুল দিচ্ছে নিরপরাধ গরিব বিশ্বের অসহায় মানুষ। গ্রীষ্মের তীব্র উত্তপ্ততা কেবল গ্রীষ্মে আর সীমাবদ্ধ নেই। সব ঋতুতে গ্রীষ্ম প্রায় স্থায়ী আসন নিয়ে বসেছে। অত্যন্ত সঙ্গত কারণে গ্রীষ্মকে আমরা প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করে থাকি। প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের ওপর গ্রীষ্মের নিপীড়নমূলক আচরণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। অথচ এই গ্রীষ্মকালেই নানা সুস্বাদু রসালো ফলের আবির্ভাব ঘটে। আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, জামরুল, তালের শাঁস, তরমুজ, লিচুসহ নানা ফল গ্রীষ্মেই আমরা পেয়ে থাকি। শিক্ষার্থীদের গ্রীষ্মের ছুটির সংস্কৃতি বহু আগে থেকেই দেশে বলবৎ রয়েছে। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষায় এই ছুটি প্রবর্তিত হয়ে থাকবে। যেটা আম-কাঁঠালের ছুটি হিসেবেও সমাজে অধিক প্রচলিত। আগে সর্বাধিক মাসাধিককালের এই ছুটি শিক্ষার্থীরা ভোগ করলেও এখন লম্বা সেই ছুটি প্রায় শিক্ষাঙ্গনে সংকুচিত করা হয়েছে। আমাদের সাহিত্যেও গ্রীষ্মের ছুটির অজস্র বর্ণনা রয়েছে।

পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় বায়ুদূষণে-জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের ঋতুবৈচিত্র্যও বদলে যাচ্ছে। দুই মাস মেয়াদের গ্রীষ্ম বছরজুড়ে নানা উপায়ে আমাদের ওপর ভর করেছে। শীতকাল পর্যন্ত সংকুচিত হয়েছে গ্রীষ্মের দাপটের কাছে। সব ঋতুর ওপর গ্রীষ্মের প্রভাব লক্ষ করা যায়। আমাদের শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সংখ্যালঘুদের আবাসে, কর্মস্থলে এমনকি গাড়িতে শীতাতপ যন্ত্র থাকায় গ্রীষ্মের অসহনীয় কষ্টের মুখে তাদের পড়তে হয় না। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের গ্রীষ্মের অনাচারের চরম মাশুল দিতে হয়। প্রকৃতিজুড়ে গ্রীষ্মের নানা প্রভাব-কুফল লক্ষণীয়। নদীর নাব্য হ্রাস, বৃক্ষের সতেজ-সবুজ আভা ধূলিকণার আচ্ছাদনে ধূসর হয়ে যায়। কৃষিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অগণিত মানুষকে খোলা আকাশের নিচে কঠোর কায়িক পরিশ্রমে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। গ্রীষ্মের অসহনীয় দাবদাহে তাদের পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ। আক্রান্ত হতে হয় নানা রোগে। বাতাসে ধূলিকণা ভর করে। শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। সব বিবেচনায় গ্রীষ্ম ঋতু আমাদের জন্য সীমাহীন দুর্ভোগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত। গ্রীষ্মের ইতির তুলনায় নেতির দিকটি অধিক বলেই ছয় ঋতুর গ্রীষ্মকে আমরা আমাদের প্রতিপক্ষ ঋতু বলে গণ্য করে থাকি। গ্রীষ্ম আমাদের জন্য একধরনের প্রাকৃতিক নিপীড়নই বটে।

গ্রীষ্মের উত্তপ্ত তাণ্ডব প্রতিহতেই যেন আগমন ঘটে বর্ষার। গ্রীষ্মের অনাচার ধুয়ে-মুছে প্রশান্তির বারতা নিয়ে হাজির হয় বর্ষা। প্রকৃতি ও প্রাণিকুল বর্ষার শীতল স্পর্শে নবজীবন লাভ করে। সর্বত্র প্রশান্তি ফিরে আসে। গ্রীষ্মের পর বর্ষার আগমন ঘটে বলেই বর্ষা অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। বর্ষার পানিতে শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা-পুকুর থৈ থৈ পানিতে ভরে যায়। কৃষিনির্ভর আমাদের দেশে বর্ষাকাল কৃষিতে যুগান্তকারী অবদান রেখে এসেছে। বর্ষায় কৃষকের মুখেও আনন্দের হাসি ফোটে। কৃষিতে বর্ষার অসামান্য অবদান কৃষিপণ্য উৎপাদনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রীষ্মের পর বর্ষার স্থলে অন্য ঋতুর আগমন ঘটলে সেটা মোটেও তাৎপর্যপূর্ণ হতো না। গ্রীষ্ম আমাদের শুকিয়ে মারে। কিন্তু বর্ষা আমাদের শীতল-সতেজ এবং প্রাণবন্ত করে বলেই চাতকের মতো বর্ষার আগমনের প্রতীক্ষা আমরা করি। বর্ষায় আমরা তীব্র উত্তাপ-দাবদাহ থেকে মুক্ত হয়ে নবজীবন লাভ করি। বর্ষার স্নিগ্ধ শীতল পরশে প্রকৃতি এবং প্রাণিকুলে ফিরে আসে অনাবিল প্রশান্তির বারতা।

বর্ষার হরেক ইতির পাশাপাশি নেতি যে নেই, তা কিন্তু নয়। রাতের বর্ষা যেমন কেড়ে নেয় সাধারণের ঘুম, দিনের ভারী বর্ষা তেমনি কেড়ে নেয় সাধারণের জীবিকা। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীর্ণ আবাসে ঢুকে পড়ে বর্ষার লাগামহীন পানি। এতে তাদের দুর্দশার মুখে পড়তে হয়। তেমনি থেমে যায় সাধারণের জীবিকাও। আমাদের শহরগুলোতে একসময় থাকলেও এখন নেই নদী সংযোগ খালসমূহ। সবই ভরাট করে গড়ে উঠেছে নানা স্থাপনা। এতে ভারী বর্ষণের পানি নির্গত হওয়ার উপায় থাকে না। শহরের রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি ডুবে যায়। চরম জলাবদ্ধতায় জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে। রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ প্রায় শহরে প্রতি বর্ষায় বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হয়। অথচ এই জলাবদ্ধতা নিরসনে রাষ্ট্র, সরকার-স্থানীয় সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে এসেছে। স্থায়ী সমাধানের পথে এখনো অগ্রসর হওয়া যায়নি। সংস্কারমূলক পদক্ষেপে এর থেকে রক্ষার উপায় নেই। স্থায়ী সমাধানের একমাত্র পথটি হচ্ছে বিলুপ্ত এবং কালভার্টে রূপান্তরিত নদী সংযোগ খালগুলোকে পূর্বাবস্থায় সক্রিয় করে তোলা। মনুষ্য সৃষ্ট স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ-অপসারণে শহরের মানুষদের এই দুর্ভোগ-দুর্দশা থেকে স্থায়ী পরিত্রাণের একমাত্র উপায় বলেই মান্য করা যায়।

প্রকৃতিবিরোধী অপকীর্তির মূলে মুনাফা। পুঁজিবাদী অর্থনীতি মুনাফা ভিন্ন কিছু বোঝে না। সেই মুনাফা অর্জন আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাই বৃষ্টির পানিতে শহর ডুবে যাওয়ার ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেওয়া হয়। ভারী বর্ষণে ঢাকা শহর প্লাবিত হওয়ার কারণে বেশ ক’বছর আগে সরকার রাষ্ট্রীয় ছুটি পর্যন্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল। সমস্যা সমাধানের মূল পথ এড়িয়ে সংস্কারের নানা পথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো হাঁটছে সত্য, তবে এতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে না। সমস্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাবে।

আমাদের দেশ নদীমাতৃক। নদী ও পানি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উত্তপ্ত গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহের পর বর্ষা নিশ্চয়ই আমাদের জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে তোলে। দান করে নবজীবন। বর্ষায় সৃষ্ট সমস্যাগুলো মনুষ্য সৃষ্ট বিধায় সেগুলোর স্থায়ী নিরসন অসম্ভব নয়। তবে এতে রাষ্ট্র ও সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের প্রয়োজন। কেননা সমস্যাগুলো যাদের লোভ-লালসায় সৃষ্ট, তারা সমাজেরই কথিত ক্ষমতাবান। তাদের মুনাফার পথ বন্ধ করে শহরকে বর্ষার জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা সহজ হয়তো হবে না। তবে অসাধ্য নিশ্চয়ই নয়। প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সন্তান প্রাণিকুলকে বর্ষা নিষ্ঠুর গ্রীষ্মের আগ্রাসন থেকে রক্ষায় স্নিগ্ধ-সজীব, শীতল-নির্মল জীবন দান করে। সঙ্গত কারণেই বর্ষা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়ই কেবল নয়, অপরিহার্যও বটে।

মযহারুল ইসলাম বাবলা

নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads