• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
স্বপ্নের স্কুল কার্যক্রম

‘আমার স্বপ্ন, আমার স্কুল’- এই স্লোগানেই মূলত স্বপ্নের স্কুল পরিচালিত হয়ে আসছে

আর্ট : রাকিব

মতামত

স্বপ্নের স্কুল কার্যক্রম

  • প্রকাশিত ০৬ জুলাই ২০১৮

শিশুদের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় প্রাথমিক শিক্ষায়। এই শুরুটাই শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনের সিঁড়ি হয়ে কাজ করে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তুলতে সরকার নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘স্বপ্নের স্কুল’ কার্যক্রম। একসময় এমন ধারণা প্রচলিত ছিল যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা সাদামাটা ও জরাজীর্ণ; কিন্তু এখন সেই দিন আর নেই। আজ প্রতিটি বিদ্যালয় যেকোনো মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো। আর শিশুদের জন্য অনেক কিছুই। আগে বিদ্যালয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে শিশুরা বিদ্যালয়বিমুখ থাকত, অনেক শিশু পরস্ফুিটিত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ত; তার পরিবর্তে এখন বিদ্যালয়গুলো শিশুদের কাছে স্বপ্নের মতো। বিদ্যালয়গুলোকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে শিশুরা স্কুলকেই সবচেয়ে বেশি আনন্দের জায়গা মনে করে। বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার একেবারেই কমে গেছে। আর এ সবকিছুর মূল কৃতিত্ব বর্তমান সরকারের।

‘আমার স্বপ্ন, আমার স্কুল’- এই স্লোগানেই মূলত স্বপ্নের স্কুল পরিচালিত হয়ে আসছে। এ উদ্যোগের আওতায় বছরের প্রথম দিন শিশুদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার সময় স্কুল ম্যানেজিং কমিটির উদ্যোগে আয়োজন করা হয় ‘শিশুবরণ’ অনুষ্ঠান। যেখানে গতানুগতিক শিক্ষায় শিশুদের বেঁধে দেওয়া কিছু পাঠ নেওয়ার জন্য বিদ্যালয়ে যেতে হতো, আজ সেখানে শিক্ষাজীবনের প্রথম দিনটি তাদের কাটে উৎসব আনন্দের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ প্রথম থেকেই বিদ্যালয়ের প্রতি তাদের একটি ইতিবাচক ধ্যানধারণা তৈরি হতে থাকে। স্বপ্নের স্কুল কার্যক্রমে সৃজনশীল কাজে শিশুদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রকাশ করা হয় শ্রেণিভিত্তিক ‘দেয়ালিকা’। যেখানে একটি শিশুর লেখা ছাপার মাধ্যমে তার মেধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে শিশুরা পড়ালেখা চর্চায় উৎসাহ বোধ করে, পাশাপাশি সৃজনশীল কাজের প্রতিও আগ্রহী হয়ে ওঠে।

যেসব বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত কক্ষ রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সাজানো হয়েছে ‘উপকরণ কক্ষ’। এই উপকরণগুলোর মধ্যে রয়েছে পোস্টার পেপার, ভিপ কার্ড, গাছপালার অংশ বিশেষ, ফল, ফুল, রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া ইত্যাদি। এগুলো ব্যবহার করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করায় শিশুরা ক্লাসের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। শিশুদের বর্ণপরিচয়ের জন্য রয়েছে সংশ্লিষ্ট বস্তু বা ছবি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যথাসময়ে হাজিরা নিশ্চিত করতে ‘বায়োমেট্রিক হাজিরা’ ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব কাজের ব্যয় নির্বাহ করছেন শিক্ষক, অভিভাবক এবং স্থানীয় বিত্তশালী ব্যক্তিরা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণমূলক কাজের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে ছাত্রছাত্রীদের এবং সেই সঙ্গে তাদের মায়েদেরও উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ‘খুদে ডাক্তার’, ‘স্মাইল প্রোগ্রাম’, ‘সেরা মা’ এবং ‘সেরা ছাত্রছাত্রী’ নির্বাচনের ব্যবস্থা রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলার জন্য তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি শ্রেণি থেকে পাঁচজন করে মোট ১৫ জনের একটি দল গড়া হয়। তারা অন্যান্য শিক্ষার্থীর ওজন মেপে দেয় ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। তাদের ‘খুদে ডাক্তার’ বলা হয়। ছোট্ট এক শিশুকে ‘ডাক্তার’ খ্যাতিতে ভূষিত করা তার জন্য প্রেরণার বিষয়। ‘স্মাইল প্রোগ্রাম’-এ ভালো কাজের পুরস্কারস্বরূপ প্রদান করা হয় ‘স্মাইল কার্ড’। নখ কাটা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ফুল বাগানের পরিচর্যাসহ বিভিন্ন ভালো কাজে শিক্ষার্থীদের প্রতীকী এসব ‘স্মাইল কার্ড’ প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রতি তিন মাস পরপর যে বেশি কার্ড পাবে, তাকে সেরা ছাত্র নির্বাচন করা হয়। ‘সেরা মা’ নির্বাচনের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের কার্যক্রমের প্রতি মায়েদের আগ্রহ বেড়ে গেছে। তারা তাদের বাচ্চার প্রতি আরো বেশি যত্নবান হয়েছেন। তা ছাড়া ছাত্রছাত্রীদের সার্বিক কার্যক্রম বিবেচনা করে প্রতিবছর ‘সেরা ছাত্রছাত্রী’ নির্বাচন করা হয়। ফলে ছাত্রছাত্রীরা তাদের সৃজনশীলতা নিয়ে আরো বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আর এভাবেই আমাদের প্রজন্মকে সত্যিকারের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে।

স্বপ্নের স্কুল কার্যক্রমে প্রতিটি বিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় রঙে রঙিন করা হয়েছে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে রয়েছে সুদৃশ্য ফটক, রয়েছে ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা তৈরি বাগান। বিদ্যালয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পড়ালেখা এবং সৃজনশীলতার আদর্শ একটি পরিবেশ আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করে দিচ্ছে ‘স্বপ্নের স্কুল’ কার্যক্রম।

বিয়ানীবাজার সিলেট জেলার একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা হলেও এখানে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ‘স্বপ্নের স্কুল’ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। উপজেলার প্রতিটি বিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় রঙে রাঙানো হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য মানসম্পন্ন পোশাক তৈরি করায় তা অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। স্বপ্নের স্কুল কার্যক্রমের আওতায় বছরের প্রথম দিন ‘শিশু বরণ’ অনুষ্ঠানসহ অনেক স্কুলে স্কুলব্যাগ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে ‘স্কুল গার্ডেনিং’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আকর্ষণীয় ফটক বিদ্যালয়ের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। শিশুর শারীরিক, মানসিক শাস্তি বন্ধের নির্দেশনা প্রদান করে মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক একটি নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, যা ‘স্বপ্নের স্কুল’ বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিদ্যালয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে।

বিভিন্ন প্রতিযোগিতা (হাতের সুন্দর লেখা, সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা, জাতীয় দিবসসমূহে প্রতিযোগিতা, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ড কাপ প্রতিযোগিতা, শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা এবং আন্তঃপ্রাথমিক বিদ্যালয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা) আয়োজনের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় এবং বিদ্যালয়কে তারা স্বপ্নের স্থান মনে করে। সেরা অভিভাবক নির্বাচন করার ফলে বিদ্যালয়ের সঙ্গে অভিভাবকদের যোগসূত্র বৃদ্ধি পায় এবং তারা বিদ্যালয়কে স্বপ্নের বিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করে। এ উপজেলার প্রতিটি বিদ্যালয়ে অন্তত একটি শ্রেণিকে মডেল শ্রেণিতে উপনীত করা হয়েছে। ফলে এ শ্রেণির সব কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের কাছে মডেল। এ উপজেলার প্রায় শতভাগ বিদ্যালয়ে একটি করে পৃথক উপকরণ কক্ষের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আকর্ষণীয় এ উপকরণ ব্যবহার করে শিক্ষকরা আনন্দদায়ক পরিবেশে পাঠকে উপস্থাপন করেন। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।

আজ আমাদের ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিদ্যালয় অত্যন্ত পছন্দের একটি জায়গা। বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলায় বিপ্লব সাধিত হয়েছে। সেই সঙ্গে পাসের হার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ঝরে পড়ার হারও কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। যেখানে সারা দেশে ঝরে পড়ার হার কমে ১৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, সেখানে এ উপজেলায় তা ১.৮২ শতাংশ। বিয়ানীবাজারের মতো প্রত্যন্ত উপজেলায় এ হারই প্রমাণ করে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকার কতটা সফল।

জাতীয় অগ্রগতির প্রধান হাতিয়ার শিক্ষা। আর এ হাতিয়ারকে পুঁজি করেই উন্নত সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গৃহীত স্বপ্নের স্কুল কার্যক্রম আমাদেরও স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

কাজী আরিফুর রহমান

উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বিয়ানীবাজার, সিলেট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads