• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
গোলমেলে ফুটবল

বাংলাদেশ আজো বিশ্বকাপ ফুটবলে উপস্থিত হতে পারেনি

আর্ট : রাকিব

মতামত

গোলমেলে ফুটবল

  • সালেহ মাহমুদ রিয়াদ
  • প্রকাশিত ০৮ জুলাই ২০১৮

পবিত্র মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার পরপরই বিশ্বজুড়ে ফুটবল সাধনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে ঈদের অব্যবহিত পরই বিশ্ব ফুটবল ক্রীড়ার মহাসংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমরা বঙ্গদেশবাসী এখন প্রায় সকলেই ফুটবল খেলায় মেতে উঠেছি। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ফুটপথ ছেড়ে ফুটবলে চলে আসছি। আমাদের এইরূপ ছড়াছড়িতে ফুটবলের কতখানি সুবিধা হয়েছে তা জানি না, তবে ফুটপথের কিছুটা উপকার নিশ্চয়ই হয়েছে। গণপদ চাপের কিঞ্চিত লাঘব হয়েছে ওর দেহের ওপর থেকে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আমরা টেলিভিশনের সামনে ভীষণ ভঙ্গিতে ভীষণতর প্রত্যাশা নিয়ে বসে থাকি। লঙ্কা আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর বিভীষণের যেমন বিরাট উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল, আমাদের সকলের ভাবখানি হয় ঠিক বিভীষণের মতোই।

বাংলাদেশ আজো বিশ্বকাপ ফুটবলে উপস্থিত হতে পারেনি। বহুদিন ধরে আমরা ‘কোয়ালিফাইং’ লেভেলে খেলছি বটে তবে এখনো ‘কোয়ালিফাই’ করতে পারিনি। অচিরেই পারব বলে সবাই আশা করছেন। এশিয়ার কয়েকটি দেশ আমাদের একেবারে ফাইফর্দ করে ছাড়ছে, নইলে কবেই আমরা রোনালদোর মুখের উপর ঠাস ঠাস গোল করে ছাড়তাম। একজন বিশেষজ্ঞ বললেন, আমাদের ইউরোপের সঙ্গে খেলতে দিলে নিশ্চয়ই বিশ্বকাপ ধরার সুযোগ পেতাম। আমাদের মান বিচারে এশিয়ার নাকি কোনো যোগ্যতাই নেই।

ভয়াবহ সিদ্ধান্ত; আমরা এ-রূপ সিদ্ধান্ত নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করার সাহস রাখি না। আপাতত সাহস সঞ্চয় করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বকাপ শুরুর প্রথম রাউন্ড থেকেই আমরা চিৎকার ও হাহাকার এই উভয় প্রকার দৈহিক ও মানসিক অনুশীলনে রত রয়েছি। কেউ কেউ অবশ্য হস্তপদ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। মেসি পেনাল্টি মিস করলে আর্জেন্টিনার বিপুলসংখ্যক বাঙালি সমর্থক ‘কীভাবে পেনাল্টি মারিতে হয়, তার প্রায়োগিক প্রদর্শন করেছেন। সকলেই তাঁদের সুকৌশল শর্ট মেসির উদ্দেশে নিক্ষেপ করেছেন। এই দলের অনেকেই শর্টমারাজনিত পদভঙ্গের জন্য হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছেন। আমরা এঁদের আশু পদভঙ্গমুক্তি কামনা করি। মেসি মহাশয় সংবাদটি অবগত হয়েছেন কি-না আমরা জানি না।

বিশ্বকাপের অনেক ভালো ভালো দিক থাকলেও এর কয়েকটি ‘অশুতশক্তি’র কথা অবশ্যই বলা প্রয়োজন। যেমন, এই কাপ নিয়ে কে কার বাড়ি যাবে সেই মীমাংসা তো মাঠে হবে কিন্তু এই কাপ চায়ের কাপে এমন ঝড় তুলছে যে, ইতোমধ্যে অসংখ্য কাপ ভেঙে গেছে। হ্যাঁ, স্বীকার করছি যে, খেলার জন্য চায়ের বিক্রি বেড়েছে; সেটা অর্থনীতির জন্য ভালো তবে কাপ ছাড়াও হাত-পা ইত্যাদি ভেঙেচুরে গেলে সার্বিক সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য একেবারেই ভালো সংবাদ নয়। এসবের চেয়ে মারাত্মক সংবাদ হলো, বাংলার গৃহে গৃহে আজ বিশ্বকাপের লাথিগুঁতোর মতোই লাথিগুঁতো শুরু হয়েছে। ঘরে ঘরে অশান্তির কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। গৃহস্বামী যদি ব্রাজিলের সমর্থক হন তো গৃহকর্ত্রী আর্জেন্টিনার ঘোর সমর্থক। ভাই যদি পর্তুগালের সাপোর্টার তো বোন জার্মানির জন্য আত্মবলিদান করতে প্রস্তুত। ভাবি জাপানের সমর্থনে এমনকি কুংফু শিক্ষা শুরু করেছেন তো ননদ মেক্সিকোর জার্সি গায়ে জড়িয়ে নিদ্রা যান। অনেকের মুখে সমর্থিত দেশগুলোর জাতীয় পতাকা বা মানচিত্রের নিপুণ উপস্থিতি।

কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীদের সমর্থনের মাত্রা আরো একক সরেস। তারা প্রিয় দলগুলোর জার্সি গায়ে দিয়ে ঘুরছেন। সেদিন দেখি আমাদের পাড়ার একটি ছেলে চারটি দেশের জার্সির ডিজাইন দিয়ে এক বিচিত্র পোশাক বানিয়েছে। দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম চার দলের চার রকমের জার্সি কেন, বাপু? ছেলেটি বলল, সে চারটি দলের সমর্থক। তাই বক্ষে তার আর্জেন্টিনা, পিটে বয়ে নিয়ে চলেছে পর্তুগাল, ডানপাশে জার্মানি আর বামদিকে নাইজেরিয়া... বড়ই আশ্চর্য কম্বিনেশন। আমি বললাম- তো বাপু, তোমার পায়ে বল দেখি না। অতিশয় দুঃখিত হয়ে সে জানাল যে, নাইজেরিয়ার মুসার মতো একটা শর্ট মেরে সে ইতোমধ্যেই চারটি জানালার কাচ ভেঙে খান খান করে ছেড়েছে। জানালার কাচ গুঁড়িয়ে যাওয়ায় খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না। তবে কাচভঙ্গজনিত প্রবল শব্দে ভবনের অপরাপর বাসিন্দারা অতিশয় বিরূপ হয়েছেন। ফলে ছেলেটির মা ওকে বল দিচ্ছেন না।

ঘরে ঘরে দলাদলি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সমর্থনের একটা সাধারণ স্বভাব হলো একই পরিবার বা গোষ্ঠীর মোটামুটি সবাই একটি দল সমর্থন করে। বিশ্বকাপে সে পরিস্থিতি একেবারেই নেই। একই পরিবারের চারজন কমপক্ষে চারটি দলের সমর্থক। সুতরাং টেলিভিশনের পর্দায় একদলের বিরুদ্ধে অপরদলের জীবন-মরণ লড়াই আর পর্দার সামনে তুমুল সমর্থক যুদ্ধ।

আর সে কী ক্রীড়া বিশ্লেষণ! জাপানের স্ট্রাইকারের বল জালে কেন জড়ায় না... ওর পা বেশি লম্বা; জার্মানি বিরোধীদের গোলপোস্টের সামনে এলেই নেতিয়ে পড়্ েকেন? শর্টপাসের খেলায় বিজ্ঞানটাই জানে না। আরো কত কী! সেগুলো এতই ক্রীড়া যুক্তিসম্মত যে, যে কেউ এর যে কোনো একটি কৌশল বিশ্বকাপের যে কোনো দলকে প্রদানমাত্র সেই দল চ্যাম্পিয়ন হতে বাধ্য।

আমাদের একটি বিশ্বকাপ দর্শন সংঘ রয়েছে। ঘরে খেলা দেখার বিবিধ ঝুঁকির কথা গভীরভাবে বিবেচনা করে আমরা দলবেঁধে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখি। ইতোমধ্যে আমাদের কমপক্ষে দশ-বারোটি বিশ্বকাপ দর্শন সমাপ্ত হয়েছে। তবে এবার আমরা একটু ভিন্নতর ফুটবল খেলা দেখছি বলে মনে হলো। বিশ্বের সবগুলো দলের খেলার মান কেন জানি আমাদের চোখে একই মানের। তিন-চার দশক আগের খেলার যে গতি, কৌশল ও ক্ষিপ্রতা দেখেছি এবার সেরকম দেখছি না। কেন এমন হলো জানার জন্য আমাদের বিশ্বখ্যাত ফুটবল খেলা বিশারদ মুজবুক খানদারের নিকট উপস্থিত হই। এখানে জানিয়ে রাখা যেতে পারে যে, খানদার ফুটবল বিষয়ে ফিফার একজন বেতনবিহীন উপদেশক। বিশ্ব ফুটবল ক্রীড়া বিকাশে তার অবদান ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।

আমরা : স্যার, এবারের চলমান ফুটবলে দেখতে পাচ্ছি বিখ্যাত খেলোয়াড় ও দল কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে। এর কারণ কী?

মুজবুক : প্রথমেই ভুল হয়েছে, ফুটবল চলমান হলেও এক্ষেত্রে হবে খেলমান ফুটবল। খেলা বুঝতে হলে ভাষাও বুঝতে হবে। হ্যাঁ, আপনাদের প্রশ্নের দিকে এবার চলমান হই। নামের ভেতরেই সব গোলমাল। এবার বিশ্বকাপে সকল বিখ্যাত, কুখ্যাত ও অখ্যাত খেলোয়াড় নিজ নিজ নামের গুণের প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন।

আমরা : ঠিক বুঝলাম না, স্যার।

মুজবুক : একটু মাথা খোলা রাখলেই বোঝা যায়। ব্রাজিলের বিখ্যাত খেলোয়াড় কে? নেইমার। ‘মারে’ নেই। মারতেই পারে না। আর্জেন্টিনার মেসি... মিস্, মিস করে গেল। বেলজিয়ামের স্ট্রাইকার ফেলায়নি। সবগুলো বল অজায়গায়, কুজায়গায় ফেলে দিল। উরুগুয়ের সুয়ারেজ। সুয়ারেজ মানে কী... পয়ঃনিষ্কাশন, ময়লা-আবর্জনা টেনে নিয়ে যায়। আর কত বলব। বলতেও ইচ্ছে করে না।

অথচ নামের সঙ্গে বিশ্বকাপের অপূর্ব মিল দেখুন... ব্রাজিলের পেলে। আহা, কী নাম... প্লে! খেলার জন্য পৃথিবীতে এসেছেন। রুড গুলিত। কী বুঝলেন... গুলির বেগে ছুটতেন। ফুটবলের বিশ্বযুদ্ধে এক ভয়ানক গুলি। দিয়াগো ম্যারাডোনা। দিয়া গেলেন শুধু। গোল দিয়া গেলেন।

এবারের খেলার দিকে আবার চোখ রাখুন। ইংল্যান্ডের হ্যারি কেন। দুটি খেলায় পাঁচ-পাঁচটি গোল। পানামার বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক। আরে হ্যারি কেন ঝড়ের তাণ্ডব দেখেননি কখনো? হ্যারি কেনে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।

কী অসাধারণ যুক্তি, কী নাম ও ক্রীড়াবিজ্ঞান! আমরা একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যাই। এবার ভয়ে ভয়ে আমি একটা প্রশ্ন করি : আমাদের খেলোয়াড়দের নামও যদি সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো এরকম রাখি, তা হলে তারাও তো ফুটবল মাঠ কাঁপিয়ে দেবে, দাপিয়ে বেড়াবে?

খানদার মৃদু মৃদু হাসলেন। আমার প্রশ্নটাকে তিনি বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন বলে মনে হলো। খানদার জানালেন, আমার প্রস্তাব মন্দ নয়; এরকম নাম রাখা যেতেই পারে তবে ফুটবলঝড় ফরাশগঞ্জ থেকে নিতাইগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে লঘুনিম্নচাপে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

লেখক : রম্য লেখক

salehmahmoodriadh@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads