• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
শিক্ষামান এবং এমপিওভুক্তি

মন্ত্রিসভা বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রীর ওপর তীব্র ক্ষোভও প্রকাশিত হয়েছে

আর্ট : রাকিব

মতামত

শিক্ষামান এবং এমপিওভুক্তি

  • ইউসুফ শরীফ
  • প্রকাশিত ১১ জুলাই ২০১৮

শিক্ষাক্ষেত্রে এমপিওভুক্তি বহুল আলোচিত বিষয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের দাবি-কর্মসূচি-আন্দোলন দেশে সব মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হওয়ার কারণও আছে। অতীতে জাতি গঠনে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান যতই প্রশংসিত হোক না কেন, বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজ বলতে গেলে বরাবরই বঞ্চিত ছিল। তারপরও শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশে শিক্ষকরা অপরিমেয় অবদান রেখে গেছেন। সমাজকে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য যোগ্য, দক্ষ, সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মী-মানুষ। বিগত দশকগুলোতে ধাপে ধাপে এমপিওভুক্তি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক সমাজের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বহুলাংশে নিশ্চিত হয়েছে। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে শিক্ষকদের রাস্তায় নামা বা অনশনের মতো কর্মসূচি গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা আর থাকবে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির তালিকা যথেষ্ট যাচাইবাছাই বা পর্যালোচনা করেই তৈরি হবে- এটা আশা করাই স্বাভাবিক। সরকার প্রয়োজনে তার প্রণীত যেকোনো তালিকা শুধু নয়, সিদ্ধান্তও পুনর্মূল্যায়ন করতে পারে। অতীতে এমন ঘটনাও দেখা গেছে, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে প্রণীত তালিকায় নিজেদের পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম না-থাকায় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের থেকেও কেউ কেউ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। মন্ত্রিসভা বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রীর ওপর তীব্র ক্ষোভও প্রকাশিত হয়েছে। বাস্তবতা যদি এমন হয় যে, এমপিওর আবেদন ১০-১২ হাজার আর এর মধ্য থেকে মাত্র এক হাজার স্কুল-কলেজ-মাদরাসাকে এমপিওভুক্ত করার বাধ্যবাধকতা থাকে, তাহলে শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষে অনেকের অনুরোধই রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবার বিবেচনায় রাখতে হবে। বাজেটে শিক্ষা খাতের ব্যয়-বরাদ্দ এবং বিশেষ করে এমপিওভুক্তির ব্যয়-বরাদ্দের বাস্তবতার কথাটি ভুললে চলবে না। বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়েও বলা যায়, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল কোনো দেশে ব্যয়-বরাদ্দের অগ্রাধিকার নির্ধারণ কোনো একরৈখিক বিবেচনার বিষয় নয়। অতীতে লক্ষ করা গেছে, মন্ত্রী-এমপিদের তদবিরে এমন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্ত হয়েছে, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে মানসম্মত নয়। অতীতের অনিয়ম-দুর্নীতি সংশোধনের মাধ্যমে তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মানসম্মত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আর তা করতে গিয়ে কী করতে হয়েছিল, তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেন, ‘এমপিওর যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা কোনো নির্ণায়ক হতে পারে না। দলীয় সরকারের আমলে রাজনৈতিক চাপ সব সময়েই থাকে, তবে শিক্ষামন্ত্রীকে সাহসের সঙ্গে সে সবের ঊর্ধ্বে উঠতে হয়। আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষামন্ত্রী তা-ই করেছেন।’

যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে, সে সরকার শুধু তার আমলে এবং তার লোকেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই এমপিওভুক্ত করবে- সে সবের মান যা-ই হোক। অন্যদিকে, সরকারের বিরোধীপক্ষের প্রতিষ্ঠিত বা পৃষ্ঠপোষকতার কারণে যথেষ্ট উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও এমপিওভুক্ত হবে না- মান যত উন্নতই হোক। এ রকম প্রবণতা চালু হয়ে গেলে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উচ্চ মানসম্পন্ন করে তোলা কখনই সম্ভব হবে না। অথচ দলমত নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়ে থাকে। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মেধাবী, যোগ্য, দক্ষ শিক্ষক দরকার। এটা নিশ্চিত করতে হলে সর্বাবস্থায় প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট পূর্বশর্ত মোতাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি সম্পন্ন করতে হবে। এর কোনোই বিকল্প নেই। এমপিওভুক্তির পর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি শিক্ষামান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রথম বছর কঠোরভাবে সতর্ক করা এবং পরবর্তী বছর মান উন্নয়ন না ঘটলে এমপিওভুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তও নেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ সর্বাবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান নিশ্চিতের প্রচেষ্টাকে সর্বোচ্চ বিষয় হিসেবে গণ্য করতে হবে।

একটি কথা এ প্রসঙ্গে বলতে হয়। জনপ্রতিনিধিরা কি তাদের সুপারিশকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মানসম্মত করে তোলার জন্য যোগ্য-দক্ষ মেধাবী শিক্ষক নিয়োগসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারবেন? পারা অবশ্যই উচিত। তারা যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সুপারিশ করবেন, সেসব প্রতিষ্ঠানের সার্বিক দেখভালের বিষয়টিও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। দেশের প্রকৃত উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার যে প্রচেষ্টা আজ অপরিহার্য, তাতে জনপ্রতিনিধিদেরও পালন করতে হবে দায়িত্বশীল ভূমিকা। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা শিক্ষকদের আর এ বিষয়টি সবার আগে তাদেরই খতিয়ে দেখতে হবে। ষাট দশকের শেষদিকেও উচ্চবিদ্যালয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষকের বেতন ছিল ৯০-১০০ টাকা এবং বিএড ডিগ্রিধারী শিক্ষকের ১২০-১৩০ টাকা। আজ বেতন-ভাতা পরিস্থিতির যতটা উন্নতি ঘটেছে, শিক্ষার মানের ততটা উন্নতি ঘটেছে কি না- এ প্রশ্ন না তুললেও বলতে হয়, নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সবারই সচেতনতা-দায়িত্বশীলতার স্বাক্ষর রাখতে হবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক উপযোগিতামুখী, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ, সুষ্ঠু করে তোলার বৃহত্তর কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটানোর জন্য সংশ্লিষ্ট সব পর্যায়ে নৈতিক দৃঢ়তা অপরিহার্য। নীতিনির্ধারকদের দৃঢ়চিত্ত না থাকলে সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ কখনই সম্ভব হয় না। রাজনৈতিক চাপের মতো প্রচলিত প্রবণতা দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকলে সমাজে তার শিকড়-বাকড় গজায়। এই প্রবণতা উন্মূল করে পরিস্থিতির পরিবর্তন সাধন খুব সহজ কাজ নয়। মৌখিক কথায় এক্ষেত্রে সাফল্য লাভ অসম্ভব। নীতির কাছে আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, দলীয় স্বার্থকে তুচ্ছ জ্ঞান করার মতো দৃঢ়তা অর্জন করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। একমাত্র তাহলেই প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর অধিকতর কল্যাণকামী, যুগোপযোগী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে এ বিষয়টি সবসময় স্মরণে রাখতে হবে। এ কথাটাও মনে রাখতে হবে, মানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষায় যদি আমরা এগোতে পারি, তাহলে সমৃদ্ধির পথে, উন্নয়নের পথে, শান্তি-শৃঙ্খলার পথে এগোতে পারব।

বাংলাদেশ এক অমিত সম্ভাবনার দেশ। সম্পদ কম থাকলেও সম্ভাবনা আছে যথেষ্ট। দেশভরা সম্পদ আছে অনেক দেশেরই, কিন্তু তাদের খুব কম সংখ্যকই সে সম্পদ কাজে লাগাতে এবং পুনরুৎপাদনে প্রয়োগ করতে পারছে। যারা এক্ষেত্রে ব্যর্থ, তারা কাঁচামাল সরবরাহকারী হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। জাপান ও তাইওয়ানের নজির কে না জানে। এ দুটি দেশের মূল সম্পদ হলো তাদের মানুষ, যারা প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ। আজকের যুগ প্রযুক্তির যুগ। মানুষ যখন প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়, তখনই হয় দেশের জন্য সম্পদ। মানুষকে সম্পদে পরিণত করার জন্য উচ্চ মানসম্পন্ন শিক্ষা ও আধুনিক প্রশিক্ষণের কোনোই বিকল্প নেই। এজন্য বাংলাদেশের মতো কোনো উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার বড় অংশটাই হতে হয়, উচ্চমানের প্রযুক্তি শিক্ষা। বাংলাদেশে প্রযুক্তি শিক্ষা বলতে গেলে অবহেলিতদশা থেকে বেশি দূর এগোতে পারেনি। এখন এমবিএ করা তরুণের সংখ্যা অনেক। যারা কাজ পাচ্ছে না, এমন কর্মহীনের সংখ্যাও অনেক। দশ-বারো হাজার টাকার চাকরির জন্যও এমবিএদের ভিড় জমাতে হয়। দেশে বর্তমানে কত সংখ্যক এমবিএর প্রয়োজন, ভবিষ্যতে কখন কত সংখ্যক এমবিএর প্রয়োজন হবে- সে ধারণা বা হিসাব ছাড়াই এমবিএ তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে। একসময় দেশে ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হতো। আশির দশকের শেষ ও নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হয় এমবিএ পড়ানোর হুজুগ। এখনো এই হুজুগ বহাল রয়েছে। অথচ এমবিএ যত বেড়েছে, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রশিক্ষিত লোকবলের চাহিদা তত বাড়েনি। ক্ষেত্র বিশেষে এই শিক্ষার মান নিয়েই প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়।

এটা বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, শিক্ষাক্ষেত্রে জাতির বাস্তব চাহিদার বিষয়টি যথাযথ বিচার-বিবেচনা লাভ করেনি। করলে এমবিএর পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি ও কারিগরিসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিও সমগুরুত্ব দেওয়া হতো। এই হিসাব-নিকাশটিই যে নীতিনির্ধারণী বিষয়, এটা সবার জানা আছে। এটাও অজানা নয়, আমাদের নীতিনির্ধারকরা নীতিমালা প্রণয়নে যেমন যথেষ্ট দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রাখতে পারছেন না, তেমনি নীতিমালা বাস্তবায়নেও সব ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে সততা ও নিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ স্থান দিতে পারছেন না। দুয়েকটি বিষয়ে নজর বুলালেই এই বাস্তবতা পরিষ্কার হবে। বিদেশে শ্রমিক পাঠিয়ে যে রেমিট্যান্স আসে, তা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় মাধ্যম। এ আয়টা আরো দ্বিগুণ-তিনগুণ হতে পারে প্রযুক্তি জ্ঞানে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত উচ্চমানসম্পন্ন জনশক্তি রফতানি করতে পারলে। সংশ্লিষ্টরা কেউ এটা জানেন না, ব্যাপারটা তা নয়। তারপরও বাস্তবোচিত কার্যকর উদ্যোগ কখনো যে গৃহীত হয়নি, তার প্রধান কারণ জাতির ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয়তার চিন্তাটা এখনো সার্বিকভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। এ ছাড়া এ কাজটা কে করবেন, কার এ দায়িত্ব, এ ব্যাপারে অতীতে স্পষ্ট বোধ ও দায়িত্বশীলতা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কার্যকরভাবে সক্রিয় ছিল- এমন বলার কোনো সুযোগ নেই। অথচ বাংলাদেশ যেসব দেশে শ্রমিক পাঠায়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সেসবের অনেক দেশেই অদক্ষ এমনকি আধাদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা আর থাকবে না। ইতোমধ্যে কোনো কোনো দেশ চিকিৎসক, নার্স এবং প্রকৌশলী পাঠানোর ওপর জোর দিতে শুরু করেছে। প্রশিক্ষণ ছাড়া শ্রমিকও নিতে চাচ্ছে না কোনো কোনো দেশ। আর এ প্রশিক্ষণও হতে হবে আধুনিক যুগের উপযোগী প্রযুক্তিনির্ভর।

আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাতের এই খাতটি যে অচিরেই সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে- এ বিষয়টি চূড়ান্ত বিবেচনায় সরকারকেই ভাবতে হবে এবং এই মুহূর্তেই পদক্ষেপ নিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের আগামী দিনের চাহিদা মেটানোর জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে বাজেটে টাকা বরাদ্দ থাকে এবং দেশে যেসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে সেগুলোর আধুনিকায়ন ছাড়াও সব জেলায় আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের কথাও বলা হয়। বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জনশক্তি রফতানির বিষয়টিই দেখবে, কিন্তু শিক্ষিত জনশক্তি তৈরির বিষয়টি দেখতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই। দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার বাস্তব অবস্থার দিকে নজর ফেরালে যে দৃশ্য দেখা যাবে, তাকে  হতাশাব্যঞ্জক ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না। এ রকম খবর তো মাঝেমধ্যেই প্রকাশিত  হয়ে থাকে যে, কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় ৪০ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য। যারা আছেন তারাও নিজেদের চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শিক্ষা পাচ্ছে না। আর বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মান আরো নিম্নমুখী। নতুন কিছু করার সময় এই বাস্তবতাগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। কারিগরি শিক্ষার সার্বিক মান-উন্নয়ন ঘটানোর জোরদার পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। বিদেশে পাঠানোর কাগুজে সার্টিফিকেট দেওয়াটাই যে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ নয়, এই মৌলিক বিষয়টি কারিগরি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবার কাছে স্পষ্ট করে তুলতে হবে এবং তাদের কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য পরিবর্তন করতে হবে।

শুধু বিদেশে জনশক্তি রফতানির জন্যই নয়, দেশেও অভাব রয়েছে কারিগরি বিভিন্ন ট্রেডের যোগ্য টেকনিশিয়ান, প্রকৌশলী ও চিকিৎসকের। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, একুশ শতকের বিশ্বে আইটি খাতের প্রয়োজনীয়তা প্রতিদিন ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়ে উঠছে। বিশ্বজুড়ে এই সেক্টরে মানবসম্পদের বিপুল চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের আজকের তরুণরা আগেকার তুলনায় অনেক এগিয়ে আছেন। যারা সুযোগ পাচ্ছেন, তারা আইটি খাতে দেশে-বিদেশে মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিভিন্ন সময়ে নানা আশাপ্রদ কথা শোনা গেলেও বিশ্ব-বাস্তবতার নিরিখে এই সেক্টরে মানবসম্পদ গড়ে তোলার বিষয়টি অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে। সারাবিশ্বে কৃষি খাত সাম্প্রতিক সময়ে এক নতুন মাত্রা লাভ করেছে। কৃষি অর্থনীতির এই দেশে এখনো এ মাত্রাটা পুরোপুরি হূদয়ঙ্গম করা সম্ভব হচ্ছে না, মূলত কৃষি আবাদ ও কৃষকের সঙ্গে কৃষিকর্মী ও কৃষি বিজ্ঞানীদের মেলবন্ধন ঘটাতে না পারার জন্যই। আমাদের কৃষিশিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য আরো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দরকার। মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কৃষি বিজ্ঞানবিষয়ক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি কৃষি গবেষণায় আরো বিনিয়োগ ও প্রচেষ্টা আজ অপরিহার্য।

পরিশেষে বলতে হয়, নতুন প্রযুক্তি ও কারিগরি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশে যেসব ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেগুলোর সমস্যা-সঙ্কট ঘুচিয়ে দ্রুত আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। বর্তমান সরকারের ভিশন সফল করার জন্য জ্বালানি ও অবকাঠামো খাত যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় শিক্ষা খাত। মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত ও আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানবসম্পদ গড়ে তোলা এখন অপরিহার্য। এ জন্য সামনে সময় খুব কম। শিক্ষা খাতের উৎকর্ষ সাধনে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিশেষে বলতে হয়, ‘ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’ এবং ‘মন্দমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’— এই কথা দুটি এদেশ থেকে নির্বাসিত করতেই হবে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একটি মান-মাত্রায় পৌঁছানোই আজ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বড় তাগিদ। যতদিন এটা করা সম্ভব না হবে, ততদিন দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো উন্নতি ঘটেছে- এমন দাবি করার কোনো সুযোগ সৃষ্টি হবে না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads