• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
সুরতহাল রিপোর্ট ও বিচার ব্যবস্থা

যে কোনো হত্যামামলায় ময়নাতদন্ত রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ

আর্ট : রাকিব

মতামত

সুরতহাল রিপোর্ট ও বিচার ব্যবস্থা

  • প্রকাশিত ১১ জুলাই ২০১৮

দুই কর্মঠ সন্তান, স্ত্রী, নাতি-নাতনি নিয়ে ভালোই কাটছিল রহিমা খাতুনের (ছদ্মনাম) সংসার। একদিন সন্ধ্যায় প্রতিপক্ষরা তাদের বাস্তুভিটায় দলবদ্ধ হয়ে ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে নিহত হন রহিমা খাতুন। দুই সন্তান, স্ত্রী-সন্তানরাও আহত হন। প্রতিপক্ষরা তাদের জমিজমা দখল করে নেয়। এ নিয়ে থানায় মামলা হয়।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা মৃত রহিমা খাতুনের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে মামলার বাদী ছাকু মিয়াসহ (ছদ্মনাম) অনেকেই টিপসই দেন, কেউ কেউ দস্তখত করেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত রহিমা খাতুনের বাম চোখের ভ্রুর উপর কাটা চিহ্ন, চোখের নিচের হাড় ভাঙা, মাথার পেছনে আঘাত। আর ডান দিকের গালে একটি কালসিটে দাগ আছে। ময়না তদন্তের প্রতিবেদনেও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা তা-ই লেখেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে আঘাত ও রক্তক্ষরণের কথাই উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির ঠিক আধাঘণ্টা আগে বাদী ছাকু মিয়া থানায় যে এজাহার দাখিল করেন, তাতে বলা হয় মৃত ভিকটিমের ডান চোখের উপর কাটার দাগ। আসামিরা ধারালো অস্ত্র ও ছুরি দিয়ে মৃত রহিমা খাতুনের ডান চোখের উপর, ডান বুকে ও মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করেছে।

এজাহারে বর্ণিত ভিকটিমের শরীরের ক্ষতের স্থান হলো ডান চোখের উপর আর প্রকৃত জখম হলো বাম চোখের উপর। এই অসঙ্গতি নিয়ে মামলার তদন্ত চলতে থাকে। তদন্ত শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বিজ্ঞ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। শুরু হয় বিচারিক কার্যক্রম। আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণ শেষে আসামিরা বেকসুর খালাস পায়। কিন্তু কেন? অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম ও প্রধানতম কারণ ছিল মামলার এজাহারে বর্ণিত ভিকটিমের শরীরে আঘাতের চিহ্নস্থলের সঙ্গে (ডান চোখের উপর) সুরতহাল ও ময়না তদন্তে বর্ণিত আঘাতের চিহ্নস্থলের (বাম চোখের উপর) গরমিল।

পোস্টমর্টেমকে বাংলায় বলা হয় ময়নাতদন্ত। পোস্টমর্টেমের আরেকটি নাম রয়েছে, সেটি হচ্ছে ‘অটপসি’। সাধারণভাবে অটপসি হলো আইনানুগভাবে মৃতদেহ পরীক্ষা করে মৃত্যুর কারণ উদঘাটন করা। কোনো ব্যক্তি কখন, কীভাবে, কোথায়, কীসের দ্বারা কীভাবে মারা গেছে, স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক— এসব তথ্য জানার জন্য মৃতদেহকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কর্তৃক যে বিশেষ পরীক্ষা করা হয়, তাকে পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত বলে।

যে কোনো হত্যামামলায় ময়নাতদন্ত রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি যথাযথ না হলে একটি হত্যামামলায় প্রমাণ করা যায় না আসামি অপরাধী। ফলে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। একইভাবে তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন বা অভিযোগপত্রও মামলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই অভিযোগপত্রের ওপর ভিত্তি করেই মামলার বিচারকাজ পরিচালিত হয়।

একটি হত্যা সংঘটিত হওয়ার পর সেখানে প্রথমেই পুলিশ যায়। পুলিশ কর্মকর্তা গিয়ে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। লাশটির শরীরে কেমন আঘাত, কোথায় আঘাত, চোখ, মুখ, নাক, চুল, মলদ্বার, লিঙ্গ এসবের অবস্থা তিনি যা দেখবেন, সেভাবেই বর্ণনা করবেন। এমনকি ক্ষত বা আঘাত কতটুকু তাও মেপে লিখবেন। ক্রাইমসিন আলামত সংগ্রহ করার পর সেই লাশ ময়নাতদন্তের জন্য যে কোনো অনুমোদিত হাসপাতালে পাঠাবেন। হাসপাতালের নির্ধারিত চিকিৎসক লাশ গ্রহণের সময় একটি বর্ণনা পুলিশের কাছ থেকে বুঝে নেবেন। এরপর তিনি ময়নাতদন্ত করবেন। ভিসেরা সংগ্রহ করবেন। যেসব লাশের শরীরে দৃশ্যমান আঘাত থাকে, সেগুলোর বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন চিকিৎসক। কিন্তু আঘাতের চিহ্ন নেই, এমন লাশের মৃত্যুর কারণ জানতে আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।

একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এজাহারে একটি হত্যামামলায় যদি দুটি ছুরিকাঘাতের কথা উল্লেখ থাকে, সুরতহালেও তা-ই লিখতে হবে। কিন্তু ময়নাতদন্তে যদি রিপোর্ট আসে যে, তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, তখন ওই মামলা প্রমাণের জন্য গলার ছাপ নিতে হবে। ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। তারপর জানা যাবে কে বা কারা হত্যা করেছে। এভাবেই মূলত প্রতিটি রিপোর্ট মামলায় প্রভাব ফেলে।

বিচারিক আদালত অত্যন্ত নিপুণভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণ ও উপস্থাপিত আলামত বিশ্লেষণ করে তার সিদ্ধান্ত টেনেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই, যে পুলিশ কর্মকর্তা বাদীকে এজাহার লিখতে সহায়তা করেছেন, সেই কর্মকর্তাই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। সেই পুলিশ অফিসারই পুরো মামলাটি তদন্ত করেছেন। কিন্তু এজাহার গ্রহণ থেকে শুরু করে অভিযোগপত্র দাখিল পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই ভিকটিমের শরীরের আঘাতের স্থান সংক্রান্ত গরমিলের সুরাহা করেননি। তার নিজের তৈরি সুরতহাল প্রতিবেদন যেখানে বলছে মৃতের বাম চোখের ওপর আঘাত, তখনো তিনি এজাহারে বর্ণিত ডান চোখের ওপরই ভর করে আছেন এবং অভিযোগপত্রেও ডান চোখের উপর আঘাতের কথাই লিখে গেছেন। তার অভিযোগপত্রের পক্ষে সাক্ষীদের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারার জবানবন্দিতেও একই ভাষ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। মামলার তদন্ত ও বিচারিক পর্যায়ে সাক্ষীদের জবানবন্দির নানা অসঙ্গতির মধ্যে প্রধানতম অসঙ্গতি ভিকটিমের চোখের আঘাতের ডান-বামের পাল্লায় পড়েই ‘সন্দেহের সুবিধা’র পুরো অংশই চলে গেছে আসামিদের পক্ষে। তাই তারা বেকসুর খালাস পায়।

যেসব কারণে বাদীপক্ষের মামলায় সন্দেহের সৃষ্টি হয়— আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হলে, এজাহারের বিবরণ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী দ্বারা যদি সমর্থিত না হয়, আসামির কাছ থেকে উদ্ধারের আলামত জব্দ তালিকার সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত না হলে, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জব্দ তালিকার সাক্ষী না করলে (ফৌজদারি কার্যবিধি-১০৩ ধারা), এজাহারের বিবরণ সমর্থন করে সাক্ষী জবানবন্দি প্রদান না করলে, জেরার উত্তর এজাহারের বিবরণ ও সাক্ষীর জবানবন্দি সমর্থন না করলে এবং আসামির দাখিল করা কাগজপত্র বাদীর অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ করলে।

উল্লিখিত কারণের কোনো একটি যদি বাদীপক্ষের মামলায় পাওয়া যায়, তাহলে মামলা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হবে। আর এ ধরনের সন্দেহের সুবিধা আসামিপক্ষ পাওয়ার অধিকারী হয়। যে কারণে আসামি মামলা থেকে রেহাই বা অব্যাহতি অথবা খালাস পেতে পারে। বাদীর মামলাটি রুজু, সুরতহাল তৈরি, তদন্ত ইত্যাদি নিয়ে কতটুকু অদক্ষতা প্রদর্শিত হয়েছে তা বলা মুশকিল। কিন্তু এ মামলার রায়ের কোথাও আদালতের দৃষ্টিতে তাকে অদক্ষতা বলা হয়নি। মামলার তদন্ত, আলামত সংগ্রহ ও সাক্ষীদের উপস্থাপনসহ অন্যান্য কোনো ক্ষেত্রেই পুলিশের কোনো গাফিলতি সম্পর্কিত কোনো মন্তব্য বা পর্যবেক্ষণ মামলার রায়ে নেই।

 

বাদী এ খালাস আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে চাইলে বিজ্ঞ পিপি তাতে সাড়া দেননি। ফলে বাদী নিজ খরচে আপিল করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হন। বিচারে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পাওয়ার বেদনায় মর্মাহত বাদী ছাকু মিয়ার বিশ্বাস, জগতের সবাই তাদের প্রতারণা করেছে। তাদের মা রহিমা খাতুনের আঘাত অবশ্যই ডান চোখের উপর। এজাহারে তারা ঠিকই লিখেছিলেন। সাক্ষীতেও তারা একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু পুলিশ ও ডাক্তার ওটা ডানের পরিবর্তে বাম দিকে লিখে দিয়েছেন।

গত ৬ আগস্ট ২০১৭ বিশ্বজিৎ দাস হত্যামামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের রায় ঘোষণার সময় হাইকোর্টের বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর বেঞ্চ মরদেহের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী পুলিশ সদস্য ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কারণ বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজের সঙ্গে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের কোনো মিল ছিল না। ভিডিও ফুটেজ ও সাক্ষীদের বর্ণনা অনুসারে বিশ্বজিতের শরীরে রড, লাঠি ও ধারালো অস্ত্রের একাধিক আঘাতের কথা থাকলেও মামলায় দাখিল করা সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে এত আঘাতের তথ্য ছিল না। তাই বিষয়টিতে দায়িত্বে অবহেলা ছিল কি-না, তা খতিয়ে দেখতে আদালত আদেশ দেন।

আমরা এখন সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাব ‘উচ্চ আদালতের সকল আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালিত হয়েছে’। সেদিন আমাদের সংবিধানের শাশ্বত বাণী চিরন্তন রূপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।

সিরাজ প্রামাণিক

আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

seraj.pramanik@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads