• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বিশ্বকাপ ফুটবল ও বাংলাদেশ

একসময় বাংলাদেশে জমজমাট খেলার আসর মানেই ছিল ফুটবল

আর্ট : রাকিব

মতামত

বিশ্বকাপ ফুটবল ও বাংলাদেশ

  • প্রকাশিত ১২ জুলাই ২০১৮

চলছে বিশ্বকাপ ফুটবলের শেষ পর্যায়ের খেলা। হাতে বাকি আছে আর মাত্র দুটি খেলা। ম্যাচদুটি হলো তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ ও ফাইনাল। তারপরও বিশ্বজুড়ে চলছে উন্মাদনা। বলা যায় সব দেশই ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত। আমাদের বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

বাঙালি মানেই ফুটবলপ্রেমী। এদেশের মানুষ ফুটবলপাগল। বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ছাড়াও স্পেন, জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ডের সমর্থকদের উন্মাদনা শহর-গ্রামে সমানতালে উৎসবের আমেজে ছড়িয়ে রয়েছে। সারা রাত জেগে খেলা দেখার উন্মাদনা ফুটবল ছাড়া যেন অসম্ভব। দেশের কোথাও কোথাও ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। অতিরিক্ত পাগলামি বলে একেই। নিজের দল হেরে যাওয়ায় কেউ কেউ ছেড়ে দিয়েছে খাওয়া-দাওয়া। বিষণ্নতায় হয়েছে আচ্ছন্ন। বিশ্বকাপকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠতে দেখা গেছে ফ্যান ক্লাব, সমর্থক গোষ্ঠী। নিজ দলের ব্যানারসহ মোটর শোভাযাত্রার আয়োজনও দেখা গেছে কোথাও কোথাও।

অনেক এলাকায় নিজের বাড়ি, প্রতিষ্ঠান প্রিয় দলের সমর্থনে রঙ দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির কারণে অঘটনও ঘটেছে। এসব ঘটনা আনন্দের সঙ্গে বেদনারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে চলতি বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাতামাতি হয়েছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নিজের সমর্থিত দেশ ও দল এবং প্রিয় খেলোয়াড় নিয়ে যুদ্ধ। বিভিন্ন সময়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতাও দেখা গেছে।

একসময় বাংলাদেশে জমজমাট খেলার আসর মানেই ছিল ফুটবল। আর বাঙালিরা তো ফুটবলপ্রেমী জাতি হিসেবে ছিল ভীষণ পরিচিত। বেশ উৎসবমুখর সময় পার করে এসেছি আমরা। বিশ্বকাপ খেলা চলাকালীন সরগরম থাকলেও সময়ের পরিবর্তন আর বিশ্ব ক্রিকেটের দাপটে এখন সে অবস্থা আর নেই বললেই চলে। শুধু শহর নয়, গ্রামগঞ্জের ছোট-বড় পাড়া-মহল্লায়ও আজ ক্রিকেট উন্মাদনা লক্ষ করা যায়। অথচ একসময় ফুটবলই ছিল ওদের পায়ে পায়ে। ক্রিকেটের দাপটে যেন বাঙালি ভুলেই যাচ্ছে ফুটবল খেলা। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই আজ ক্রিকেটের রাজত্ব। তবে গর্বের বিষয় হচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এবারের বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে। আরো গর্বের খবর, চলতি বছর এশিয়া কাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের মেয়েরা হয়েছে চ্যাম্পিয়ন।

আমাদের গ্রামীণ আয়োজনে ফুটবল খেলায় এখনো দর্শকের বিপুল সমারোহ আর অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। ফুটবলামোদীদের পদচারণায় ক্ষুদ্র আয়োজনও উচ্ছ্বাসে বাঁধ ভাঙে। বিশ্বকাপে বিপুল উৎসাহী দর্শক পাওয়া গেলেও দর্শক খরায় ভুগছে ঢাকার ফুটবল টুর্নামেন্ট। দর্শক মাঠে টানতে খুব একটা উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বিশ্বে ক্রিকেট আমাদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বাংলার দামাল ছেলেরা ফুটবলে খুব একটা নাম করতে না পারলেও ক্রিকেটে পেরেছে, এটা গর্বের ও আনন্দের। ফুটবলের জনপ্রিয়তার ক্ষেত্র পরির্বতন করে আজ ক্রিকেটে বেড়েছে ক্রীড়ামোদীর ঝোঁক। তাই বলে ফুটবলকে ভুলে থাকলে চলবে না।

একসময় দেশের আনাচে-কানাচে দেখা যেত ছেলে-বুড়োরা ফুটবল নিয়ে সে কী ব্যস্ত! বর্ষা মৌসুম ছাড়া দেশে ফুটবল চর্চা নেই বললেই চলে। মনে হয় ফুটবল অনেকটা বাণিজ্যিক বা সরকারি উদ্যোগে শহরকেন্দ্রিক গণ্ডির মধ্যে বন্দি হয়ে পড়েছে। ব্যাপক চর্চা না থাকায় ফুটবলের মান নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের ক্লাবগুলোতেও। এ কারণেও ফুটবল মাঠে দর্শক উপস্থিতি কম। আজকের প্রতিযোগিতার এই সময়ে শুধু ক্রিকেট নয়, ফুটবল নিয়েও আমাদের ব্যাপক উদ্যোগী ও উৎসাহী হতে হবে।

শুধু যে ফুটবল তা নয়, আমাদের জাতীয় খেলা হা-ডু-ডুসহ দেশীয় অনেক খেলারই আজ বেহাল দশা। দেশীয় খেলাগুলোর এই অবস্থার জন্য দায়ী সরকারি, স্থানীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব।

দুই

ফুটবল খেলা কোন দেশে কখন প্রথম চালু হয়, সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা একমত নন। কেউ বলেন চীন, কেউ গ্রিস, কেউ রোম, কেউ বা ইংল্যান্ডকে ফুটবল খেলার আবিষ্কারক মনে করেন। তবে রোমানরাই ফুটবল খেলাকে ইউরোপের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় এবং এ খেলার বিস্তৃতি ও জনপ্রিয়তা দান করে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ফুটবল ইংল্যান্ডে প্রবেশ করার পর থেকে এর প্রচার, প্রসার ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৮৪৮ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম ফুটবলের জন্য আইন-কানুন প্রণয়ন করে। পরবর্তীকালে এর আরো পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন ঘটে। ফুটবলের জন্য একটি পরিপূর্ণ নীতিমালা তৈরি হয়। তাই ইংল্যান্ডকে আধুনিক ফুটবলের জনক বলা হয়। তারাই ফুটবলকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয় এবং জনপ্রিয় করে তোলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পৃথিবীতে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়ে। ১৯০৪ সালের ২১ মে প্যারিসে ইউরোপের ৭টি দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠকে ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল দ্য ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ফিফা) গঠিত হয়। ১৯৩০ সালে আয়োজন করা হয় বিশ্বকাপ ফুটবলের। উরুগুয়ে প্রথম বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে।

খেলাধুলা মানুষের শরীর ও মন দুটোকেই উজ্জীবিত রাখে, রাখে উৎফুল্ল। কিন্তু বর্তমানে খেলার মাঠ কমে যাওয়ায় খেলা এখন গেম নামে মোবাইল, কম্পিউটার আর ইন্টারনেটে বন্দি হয়ে যাচ্ছে। যদিও আশা জাগিয়ে রাখছে ক্রিকেট। শুধু দেশের মাঠ নয়, বিদেশেও আমাদের টাইগাররা সুনাম বয়ে আনছে। ক্রিকেটের সুনামের পাশাপাশি ফুটবল খেলায়ও আমরা সুনাম বয়ে আনতে পারি, যদি চেষ্টা থাকে। শুধু কথায় নয়, কাজে প্রমাণ রেখে ফুটবলের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।

ফুটবলকেও বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগও প্রয়োজন। শুধু বাফুফে নয়, ফুটবলকে উজ্জীবিত রাখতে আমাদের স্কুল-কলেজে সেই আগের মতো আয়োজন অব্যাহত রাখা দরকার। শুধু বিশ্বকাপ উন্মাদনায়ই নয়, বছরজুড়ে এই খেলার প্রতি টান, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা নিয়ে চেষ্টা চালাতে হবে। আমরা চাই বিশ্বকাপে ভিনদেশী দল আর খেলোয়াড় নয়, বাংলাদেশ ও আমাদের খেলোয়াড়দের নিয়ে মাতামাতি করতে। একদিন বাংলাদেশে শুধু আমাদের পতাকাই উড়বে, অন্য দেশের নয়। জয় হোক ফুটবলের, জয় হোক বাংলাদেশের।

সফিউল্লাহ আনসারী

গণমাধ্যমকর্মী

shofiullahansari@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads