• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
খালগুলো হতে পারে বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র

প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এ ধরনের শহর পৃথিবীতে বিরল

আর্ট : রাকিব

মতামত

খালগুলো হতে পারে বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র

  • প্রকাশিত ১৩ জুলাই ২০১৮

ঢাকা প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো শহর। ঢাকা শহর মূলত উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত আর এর পূর্ব-পশ্চিমে জলাশয়ের সংখ্যা বেশি। চারদিক নদীবেষ্টিত। শহরের মধ্যে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আঁকাবাঁকা বিভিন্ন খাল-বিল ও ঝিল। প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এ ধরনের শহর পৃথিবীতে বিরল। চারপাশে নদী আর ভেতরে ছোট-বড় খালের সমন্বয়ে ঢাকাকে বদ্বীপ শহর বললেও অত্যুক্তি হবে না। আগে বৃষ্টি হলে পানি বিভিন্ন খাল দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পাশের নদীতে পড়ত। এ ছাড়া পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে নিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যেত এই শহর। কিন্তু খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ার ফলে এসব বিষয় এখন অতীত।

জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, ঢাকায় খালের সংখ্যা প্রায় ৫৮টি। কাগজে-কলমে ৫৮টি খালের উল্লেখ থাকলেও এর অর্ধেকের বেশি খাল দখল হয়ে গেছে। ঢাকা ওয়াসার তথ্য মতে, এখন সচল খালের সংখ্যা প্রায় ২৬টি। সরকারের উদাসীনতা আর প্রভাবশালীদের দখলে হারিয়ে গেছে ঢাকার অধিকাংশ খাল। প্রভাবশালী থেকে শুরু করে স্থানীয় ব্যক্তি পর্যন্ত যে যেভাবে পেরেছে  বিভিন্ন খাল নামে-বেনামে দখল করেছে।

অবৈধ দখলের কারণে এসব খালের সঙ্গে আশপাশের নদ-নদীগুলোর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এসব খালের মধ্যে রয়েছে— হাজারীবাগ খাল, কাঁটাসুর খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, কল্যাণপুর খাল, আবদুল্লাহপুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, খিলগাঁও-বাসাবো খাল, সেগুনবাগিচা খাল, গোবিন্দপুর খাল, রামপুরা খাল, বোয়ালিয়া খাল, ডুমনি খাল, সুতিভোলা খাল, শাহাজাদপুর খাল, শাহাজাহানপুর খাল, মাণ্ডা খাল, জিরানী খাল, কসাইবাড়ি খাল, মেরাদিয়া-গজারিয়া খাল, দিয়াবাড়ি খাল, রায়েরবাজার খাল, ধোলাই খাল, কুতুবখালী খাল ইত্যাদি। ঐতিহাসিকদের মতে, ঢাকার এসব খাল দিয়ে একসময় বড় বড় নৌকা চলাচল করত। এখন খালগুলো ভরে গেছে পলিথিন, প্লাস্টিক আর বর্জ্য দিয়ে। আবার উন্নয়নের নামে রাজধানীর খালগুলোকে সরু নালায় পরিণত করা হয়েছে। যে কয়টি খাল সচল আছে এর বেশিরভাগের সঙ্গে আবার নদীর সংযোগ কাটা পড়েছে। খালগুলোতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নেই।

ঢাকা শহরের অন্যতম সমস্যা হলো জলাবদ্ধতা। এ জলাবদ্ধতা নিরসনে খালগুলো দখলের হাত থেকে উদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই। কালেভদ্রে রাজধানীর বেদখল হওয়া খাল উদ্ধারে মাঠে নামে প্রশাসন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একদিকে উচ্ছেদ অভিযান চলে আর অন্যদিকে খাল দখলের মহোৎসব চলতে থাকে। বেদখল হওয়া খাল উদ্ধারে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়। মূলত এখানে প্রশাসন ও সরকারের সদিচ্ছার অভাব লক্ষ করা যায়। একেকটি খাল যেন মশার কারখানা! খালগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হলে মশার অত্যাচার থেকেও নগরবাসী রক্ষা পাবে। এক কথায়, ঢাকা শহরের উদ্ধারকৃত খালগুলো হয়ে উঠতে পারে সৌন্দর্য ও বিনোদনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র।

রাজধানীবাসীর বিনোদনের জন্য যে ক’টি স্থান রয়েছে সেগুলো জনসংখ্যানুপাতে একেবারেই অপ্রতুল। বেদখল হওয়া খালগুলো উদ্ধার করে ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় এনে এগুলোর সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যমে রাজধানীবাসীর বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা কঠিন কাজ নয়। শুধু আইনের প্রয়োগ আর সদিচ্ছাই যথেষ্ট। পাশাপাশি প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকেও রেহাই পাবে রাজধানীর মানুষ। অন্যদিকে এসব বিনোদন কেন্দ্র ঘিরে গড়ে উঠবে অর্থনীতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জোগান। 

দখলকৃত খাল উদ্ধার করার সঙ্গে সঙ্গেই তা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। তারপর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নার্সারি গড়ে তোলা বা ওয়াকওয়ে (হাঁটাচলার পথ) নির্মাণ করলে ফের দখলের সুযোগ থাকবে না। উদ্ধারকৃত প্রত্যেকটি খালের দু’ধারে ঘাস ও গাছ লাগানোর মাধ্যমে চারপাশ সবুজায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মোটকথা খালের চারপাশ যাতে দৃষ্টিনন্দন রূপ লাভ করে সে ব্যবস্থা করতে হবে। দর্শনার্থীদের জন্য খালের ধারে বসার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি চারপাশের পরিবেশ আকর্ষণীয় করতে হবে। পুরো ব্যবস্থাটি একটি প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে ঢাকাবাসী এক নান্দনিক শহরের ছোঁয়া পাবে। কংক্রিটের খাঁচায় বন্দি নগরবাসী পাবে সবুজ শীতল এক নির্মল ও দৃষ্টিনন্দন প্রকৃতির আবেশ। বদলে যাবে ঢাকা শহরের পরিবেশ। দরকার শুধু সদিচ্ছা, আন্তরিকতা আর যথাযথ উদ্যোগ।

সুতরাং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব, ঐতিহ্যবাহী ঢাকা শহর রক্ষায় এবং একই সঙ্গে ঢাকাবাসীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। এর মাধ্যমে বিনোদনের চাহিদা মিটবে, খালগুলোও পানি-প্রবাহের মাধ্যমে ফিরে পাবে প্রাণ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও থাকবে বজায়। বায়ুদূষণ, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি থেকে ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে খালগুলোকে আগে উদ্ধার করা এখন সময়ের দাবি। আর তা করা গেলেই আমাদের রাজধানী মহানগরী ঢাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ বাসযোগ্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। অন্যথায় রাজধানী ঢাকার অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। নগরবাসী প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে। এ ব্যাপারে সময়ক্ষেপণ করার কোনো সুযোগ নেই। এখনই, এ মুহূর্ত থেকেই সরকার, দুই সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের উচিত সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমে পড়া।

সাধন সরকার 

প্রাক্তন ছাত্র, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads