• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
দেয়ালে আটকা প্রজন্মের শৈশব

ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ছোট্টমণিরা একসঙ্গে খেলতে পারে না

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

দেয়ালে আটকা প্রজন্মের শৈশব

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ১৪ জুলাই ২০১৮

সকালে গভীর ঘুম থেকে এক শিশুকে টেনেহিঁচড়ে তুলে ধরিয়ে দেওয়া হয় টুথব্রাশ। ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন শিশুর অনিচ্ছাকে তাচ্ছিল্য করে পরিয়ে দেওয়া হয় স্কুলড্রেস। তারপর এটা খাও, ওটা খাও। বাধ্যবাধকতার শেকল পরিয়ে তার কাঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বইয়ের ভারী ব্যাগ। এরপর মুরগির মতো ভ্যানগাড়িতে অথবা বাসে, রিকশায় কিংবা মোটরসাইকেলে বা হেঁটে চল স্কুলে। স্কুলে গিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওঠ। ক্লাসে পড় আর পড়। ছুটি শেষে একগাদা হোমওয়ার্ক নিয়ে বাড়ি এসো। তারপর চার দেয়ালের বন্দিশালায় হোমওয়ার্ক। বিকালে আসবেন হোম টিউটর। সপ্তাহে যেতে হবে গানের স্কুলে। শিখতে হবে নাচ বা আবৃত্তি। ড্রয়িংটাও কেন বাদ যাবে। উফ্ কী অমানবিক, নির্মম নির্যাতন! ওদের দেখে কষ্টে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। হায়, জাতির ইচ্ছের বোঝা যেন অবুঝ একটি শিশুর কাঁধে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। সকালে হাত-মুখ ধুয়ে আঙিনায় গলা ছেড়ে পড়তাম— ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই।’ ৮টায় গোসল করে খেয়েদেয়ে দল বেঁধে হইহল্লা করে ছুটে যেতাম স্কুলে। সেখানেও কিছুক্ষণ হইহই, রইরই। ক্লাস শেষে স্কুল ছুটি, উচ্ছলতা নিয়ে বাড়ি ফেরা। তারপর সারা দিন খেলাধুলা হইহল্লা। সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে অজু করে নামাজ শেষে পড়তে বসা। এমন আনন্দেই কেটেছে আমাদের শৈশব। আর এখন কী পাচ্ছে শিশুরা! যে শিশু ঠিকমতো কথা বলতেও শেখেনি, তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্কুলে। ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা পড়ছে  ইংরেজি মাধ্যমে! বাবা-মা ব্যস্ত, ব্যস্ত সবাই। শিশুর সঙ্গে সময় কাটানোর কেউ নেই। তার সঙ্গী গেম আর কার্টুন। অথবা কাজের লোক। আহারে কী নিদারুণ, নিঠুর-নির্মম-নির্যাতন চালানো হচ্ছে শিশুর ওপর।

এভাবে স্কুল, কোচিং, হোমওয়ার্ক, হোমটিউটর আর ভালো রেজাল্ট করার অসহনীয় চাপে পিষ্ট হচ্ছে আধুনিক যুগের শৈশব। যেখানে প্রকৃতির আলিঙ্গন নেই, মুক্ত আকাশ দেখার সুযোগ নেই, মাঠ নেই, পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে হইহল্লার সুযোগ নেই; আছে শুধু শাসন আর বেঁধে দেওয়া সময়ের-‘পড়, নাও-খাও আর ঘুমাও মার্কা শৈশব’। এই নগরের ইট-কাঠ-কংক্রিটের বাঁধনে আটকে গেছে এ প্রজন্মের ছেলেমেয়ের শৈশব-কৈশোর। উন্মুক্ত মাঠে খেলাধুলা করতে না পারায় শিশুরা শারীরিকভাবে অলস হয়ে মুটিয়ে যাচ্ছে। শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগ। সঠিকভাবে হচ্ছে না শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি। বন্দিত্বের কারণে খিটখিটে মেজাজের হচ্ছে শিশুরা। একালের বাবা-মায়েরাও যেন শিক্ষা-বণিকদের ফাঁদে পড়ে খেই হারিয়ে ফেলছে। তারাও বোঝার চেষ্টা করছেন না, ওরা রোবট নয়, ওরা শিশু, কোমল ওদের দেহ-মন। ফেসবুক, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ডিশ-এন্টেনার মোহাচ্ছন্নতায় হারিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রিয় মুহূর্তগুলো। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ঢাকা-কলকাতার মতো শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে অনেক শিশু মাটির সংস্পর্শে আসতে পারছে না। অথচ জার্মানিতে শিশুদের প্রকৃতির কোলে যেতে উৎসাহ দেওয়া হয়। সেখানে জঙ্গলের ভেতর গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন। গাছপালা ও নানা প্রাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয় হয় তাদের। ভালো-মন্দের প্রভেদ চেনা, কল্যাণ চিন্তা, প্রগতি ভাবনা, মানবিকতায় আর্দ্র হওয়ার মন্ত্রণা আমরা পেয়েছি সেই শৈশব-কৈশোরে। সেকালের অভাবের সঙ্গে সখ্যময় গ্রামীণ জীবন থেকে বেড়ে উঠে কেউ হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় মেধাবী ও প্রতিবাদী ছাত্র, কেউ বা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক আরো কত কিছু। আর একালের বাবা-মাও যেন জন্মের পরই ঠিক করে নেন তার সন্তান কী হবে!

দুঃখ লাগে, আমাদের সন্তানদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত শৈশবের গল্প। আমাদের শহুরে সন্তানরা মাছের নাম জানলেও, সেই মাছটি চেনে না। ফল খায়, তবে ফলের গাছ চেনে না। গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার কারণে এরা গাছে চড়তে জানে না। সাঁতার জানে না। কালবৈশাখীর ঝড় কী জিনিস তা গ্রামে না গেলে সে কী করে বুঝবে। কৃষকের কৃষিকাজের নৈপুণ্যতা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ দিতে হবে। আর এসবের জন্য কাব্যকথার সেই গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। এ বিষয়ে চীনের উদ্যোগটি অনুসরণীয় হতে পারে। গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে ধারণা নিতে এবং জীবনযাত্রার পার্থক্য অনুধাবনের জন্য চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চংকিং শহর কর্তৃপক্ষ শহরের শিক্ষার্থীদের গ্রামে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের মতে, এর ফলে প্রজন্মগত ও ভৌগোলিক দূরত্ব কমানো সম্ভব হবে। তারা ব্যয়বহুল-অভিজাত জীবনযাপনের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবন এবং তাদের বাবা-মা-স্বজন-সহোদর ও পূর্বপুরুষদের জীবনযুদ্ধ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাবে। তাদের ধারণা, এসব শিক্ষার্থীর জীবনবোধ হবে মানবীয়। তারা জীবনের কঠিন সংগ্রামকে শক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে পরিশ্রম করে জয় করতে সমর্থ হবে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনকি সরকার ও এনজিওদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্কুল, কলেজ পর্যায়েও চীনের মতো এমন ইন্টার্নশিপ প্রশিক্ষণ কোর্স সিলেবাসের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। তাহলেই পরিবর্তন আসবে। জীবনবোধ, পারিবারিক সম্পর্ক ও দেশীয় সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠবে আমাদের আদরের সন্তানরা।

দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, আমাদের পারিবারিক বিনোদনের জায়গাগুলো ছোট হয়ে আসছে। বাবা-মা, ভাই-বোন মিলে একসঙ্গে টিভির অনুষ্ঠান দেখা হয় না। যাওয়া হয় না সিনেমা হলে। সেখানে নেই পরিবেশ। নেই ভালো সামাজিক ছবি। যাওয়া হয় না নাট্যমঞ্চে। পারিবারিক ভ্রমণ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা তো আছেই। আত্মীয়দের বাসায় দাওয়াত খেতে যাওয়া এবং তাদের দাওয়াত খাওয়ানোর রেওয়াজটাও আধুনিকতার নামে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে আটকে গেছে। এ কারণে আত্মীয়তার সামাজিক বন্ধনগুলো কাছে টানছে না সন্তানদের। পারিবারিক বন্ধনগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন সংস্কৃতির নেতিবাচক দিকগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে। অভিভাবকরা সন্তানদের ভাষা বুঝতে পারছেন না। সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আবার সন্তানরাও অভিভাবকদের প্রত্যাশার কথা আমলে নিতে চাচ্ছে না। তাহলে কেমন হবে ভবিষ্যৎ? এরই বাস্তব প্রমাণ আন্তর্জাতিক শিশু সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের ‘চুরি হয়ে যাওয়া শৈশব’-বিষয়ক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিশ্বে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন বা তারও বেশি শিশুর শৈশব নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতা বাংলাদেশে চরম পর্যায়ে রয়েছে। পারিবারিক, সামাজিক এবং শিক্ষাজীবনে মানবিকতার বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ খুবই জরুরি। সন্তানকে দান করতে শেখানো, সহমর্মী এবং সহযোগী হতে শেখানোর বুনিয়াদি শিক্ষা পরিবার থেকেই পেতে হবে। তবে তা শিক্ষা কারিকুলামেও থাকা আবশ্যক। পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্কগুলোও বাড়ানো দরকার। এখন আধুনিক ফ্ল্যাট কালচারের অদ্ভুত এক সভ্যতা বিরাজ করছে আমাদের মধ্যে। কেউ কারো খবর রাখেন না। যাওয়া-আসা হয় না। ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ছোট্টমণিরা একসঙ্গে খেলতে পারে না। গল্প ও আড্ডায় মেতে উঠতে পারে না। কেমন যেন একটা রিজার্ভ সংস্কৃতির কবলে একক পরিবারের একাকিত্ব পেয়ে বসেছে আমাদের সন্তানদের জীবনে। এই শেকল ভাঙতেই হবে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। বাসায় বাসায়, ঘরে ঘরে সহপাঠী ও খেলার সাথী বন্ধুদের জম্পেশ আড্ডার সুযোগ না থাকলে ওদের বোধের পরিব্যাপ্তি বাড়বে না। মানবিক সম্পর্ক তৈরি হবে না। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে সৃজনশীলতার দৃষ্টান্ত উপহার হিসেবে দিতে পারবে না।

লেখক :  গবেষক

writetomukul36@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads