• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
নদীভাঙন : প্রয়োজন দ্রুত সমাধান

সদিচ্ছা আর সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে নদীভাঙন রোধ করা কঠিন কাজ নয়

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

নদীভাঙন : প্রয়োজন দ্রুত সমাধান

  • প্রকাশিত ১৬ জুলাই ২০১৮

বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রায় প্রতিদিনের খবরে স্থান পাচ্ছে নদীভাঙনের শিকার হাজারো মানুষের আহাজারি। নদীভাঙন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর প্রতিকার কিন্তু এখন অনেকটা মানুষের হাতে। মানুষ অনেক বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে সক্ষম। প্রতি বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙন বাংলাদেশের জন্য একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নদীর কূল সাধারণত ভাঙে স্রোত বাধাগ্রস্ত হলে। তা ছাড়া সমুদ্রের কাছাকাছি এলে নদীর স্রোত তীব্রতর হয়, ফলে নদীর তীর ভাঙনের কবলে পড়ে। আবার বর্ষা মৌসুমে নদীর উজানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রচণ্ড গতিবেগের কারণে ভূমি ক্ষয় হতে থাকে। এভাবে ভূমি ক্ষয় হতে হতে নিচের দিকে গর্তের সৃষ্টি করে, যা নদীভাঙন ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে নদীর গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে কোনো স্থাপনা তৈরি হলে সেটিও নদীভাঙনের কারণ হতে পারে। আবার দীর্ঘ সময় ধরে নদীগর্ভে পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেলে দেখা যায় অল্প বৃষ্টিপাতের ফলেও নদীভাঙনের সৃষ্টির হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যানের (ফ্যাপ) এক সমীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমি নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলস্বরূপ প্রতিবছর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ১০ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আশ্রয়হীন হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ২৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী বয়ে গেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ নদীই কোনো না কোনো সময় ভাঙনের সৃষ্টি করে। বিশাল পরিমাণ জমি নদীতে বিলীনের ফলে অসংখ্য পরিবার ছিন্নমূল হয়ে পড়ে। এভাবে ফসলের জমি এবং ভিটেমাটি হারিয়ে মানুষকে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পতিত হতে হয়। বিভিন্ন সময়ে গ্রামীণ দারিদ্র্যের ওপর পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায়, নদীভাঙনে গ্রামীণ মানুষ তথা নদী তীরবর্তী মানুষজন সর্বস্বান্ত হওয়ার কারণে দারিদ্র্যের বিস্তার ঘটছে বেশি। গবেষকরা নদীভাঙনকে গ্রামীণ দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শহরাঞ্চলে আসা ভাসমান ছিন্নমূল মানুষের অধিকাংশই এই নদীভাঙনের শিকার। এসব মানুষের একটি অংশ বিবিধ সামাজিক সমস্যারও জন্ম দিয়ে থাকে। ভয়াবহ নদীভাঙনের শিকার হয়ে অনেক জনপদের চেহারা পর্যন্ত পাল্টে যায়। এই নদীভাঙনকে ঘিরে আবর্তিত হয় নানাবিধ কর্মকাণ্ড। নদীর তীর সংরক্ষণের জন্য প্রতিবছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার কাজকর্ম হয়। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, এই কাজের ফলে স্থায়ী সমাধান আসে না। নদীগর্ভে ফেলা বালিভর্তি বস্তা বা পাথর কোথায় যায় তার হিসাব কে রাখে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানের কথায় আছে, ‘এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা।’ কবি নজরুলের এই গানের কথা আমাদের দেশের জন্যই সমার্থক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশ্বের বহু দেশ এসব প্রমত্তা নদীকে শাসন করে বা বাঁধ নির্মাণ করে মানুষের বশীভূত করেছে। তাদের দেশে এ-কূল ও-কূল ভাঙা-গড়া নিয়ে সম্ভবত এমন রচনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি এই উপমহাদেশের অন্য কোনো দেশও বাংলাদেশের মতো এত প্রকট আকারে নদীভাঙনের শিকার হয় না। যদিও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে এবার বিপাকে পড়েছে। প্রকৃতির ওপর খড়গ চালালে তার প্রতিশোধ প্রকৃতি থেকেই আসে। এবার গঙ্গা, তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য ভারত সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করা উচিত। ভারতীয় কর্তৃপক্ষও এখন বুঝতে সক্ষম হয়েছে, তাদের জন্য এটি ভালো হচ্ছে না। কোনো কিছুই মানুষের সাধ্যের বাইরে নয়। নদী শাসন তো অনেক দেশের কাছে অতি সাধারণ কাজ। যারা সমুদ্রের বুকে বাঁধ দিয়ে বসতি করছে তারা মানুষই তো (রিও ডি জেনেরো, ব্রাজিল)। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের, আমরা পারি না নদ-নদীকে বশীভূত করতে। আসলে আমরা যে পারি না তা কিন্তু সত্য নয়। আমরা বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করেছি, পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ প্রায় ৪০ ভাগ শেষ হয়ে আসছে বলে পত্রিকার খবরে জানা যায়। আমাদের সদিচ্ছা আর সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে নদীভাঙন রোধ করা কোনো কঠিন কাজ নয়। নদীভাঙন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এতে কারো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই দুর্যোগ আচেনা বা আকস্মিক নয়। সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিলে এটি রোধ করা খুবই সম্ভব। প্রতিবছর দেশের হাজার হাজার মানুষ শিকার হয় নদীভাঙনের। একসময় যাদের ছিল সুখীসমৃদ্ধ জীবন, নদীভাঙন তাদের বাধ্য করে জীবিকার সন্ধানে শহরে আসতে। ঢাকা শহরের বস্তিবাসীর একটা অংশ এসেছে নদীভাঙনের শিকার হয়ে। এসব মানুষের জীবিকার উৎস হয়ে দাঁড়ায় দিনমজুর, রিকশা চালনা, ঠেলাগাড়ি চালানো ইত্যাদি। অথচ আমরা ২০২১ সালের আগেই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছি।

নদীভাঙনের প্রভাব অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ অপেক্ষা অধিক ধ্বংসাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। এতে মানুষ তার চিরদিনের চেনাজানা স্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। হয়ে পড়ে আত্মীয়-পরিজনহীন। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নদীর তীরবর্তী সভ্যতা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারকসমূহ। তাই নদীভাঙনকে দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করে যারা নদীভাঙনের শিকার হয়েছেন, খুঁজে বের করে তাদের বিশেষ ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা উচিত। এসব মানুষের জন্য সরকারের সুদৃষ্টি জরুরি। সমাজের বিত্তবানদেরও সহায়-সম্বলহীন এই মানুষদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। তাদের জন্য নিতে হবে সমন্বিত উদ্যোগ। প্রয়োজনে প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটির সুপারিশক্রমে কাজ করতে পারে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কাজের তদারকির জন্য এই একই কমিটি দেখভাল করতে পারে। তাহলে হয়ত ঘরবাড়ি হারানো মানুষেরা খুঁজে পাবেন নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। তাদের কর্মসংস্থান এবং থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। নদীর বুকে নতুন চর জেগে উঠলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দিতে হবে তাদের বরাদ্দ।

আনোয়ার ফারুক তালুকদার

ব্যাংকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads