• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
নির্বাচন গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ

নির্বাচন নিয়ে আগের মতো হুজুগ তৈরির চেষ্টা আছে

আর্ট : রাকিব

মতামত

নির্বাচন গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ

  • আবুল কাসেম ফজলুল হক
  • প্রকাশিত ৩০ জুলাই ২০১৮

বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। তার আগে আগামী ডিসেম্বরে নতুন সরকার গঠনের জন্য জাতীয় সংসদের নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচন কমিশন আগামী অক্টোবরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে বলে জানিয়েছে। নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কথা চালাচালি চলছে। এই কথা চালাচালি নিয়ে কিছু লোক খুব উৎসাহী হলেও অধিকাংশ লোককেই নিঃস্পৃহ দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে আগের মতো হুজুগ তৈরির চেষ্টা আছে; কিন্তু বাস্তবে হুজুগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের রাজনীতির চরিত্র যে উন্নতির দিকে যেতে আরম্ভ করবে, তার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। হয়তো সেজন্য উৎসাহ-উদ্দীপনার এই ঘাটতি।

এর মধ্যে খুলনায় ও গাজীপুরে সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে। দুটি নির্বাচনেই জয়ী হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এই দুটি নির্বাচন নিয়েই বিএনপির এবং সুশীল সমাজের (Civil Soceity Organizations) অভিযোগের অন্ত নেই। নির্বাচন কমিশন, সরকার ও আওয়ামী লীগ বলছে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচনের খুলনা মডেল, নির্বাচনের গাজীপুর মডেল- কথা দুটো চালু হয়েছে। সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হতে চলছে। এসব নির্বাচনও খুলনা মডেল, গাজীপুর মডেল অনুসরণ করেই হবে- এমন মন্তব্য সুশীল-সুজনরা করে চলছেন। রাজনীতির প্রতি সারা দেশে জনগণের মধ্যে যে নিঃস্পৃহ ভাব বিরাজ করছে তাকে অনেকে Depoliticization বা নিঃরাজনীতিকরণ বা বিরাজনীতিকরণের ফল বলেছেন। অনেকে বলে থাকেন, ১৯৮০-এর দশক থেকে যেসব রাজনৈতিক আন্দোলন এদেশে হয়েছে সেগুলো ছিল হুজুগ-ভিত্তিক, গণজাগরণভিত্তিক নয়। গণজাগরণে জনগণের মধ্যকার মহৎ মানবীয় গুণাবলির সক্রিয়তা থাকে, মহান লক্ষ্য থাকে, মহান নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে এ-কালে জনচরিত্র গণজাগরণের পরিচায়ক নয়। বলা হয়, স্বৈরাচারী এরশাদকে উৎখাত করে যারা ক্ষমতায় এসেছে- আওয়ামী লীগ, বিএনপি- তারা কি অস্বৈরাচারী? স্বৈরাচার কী? গণতন্ত্র কী?- এসব প্রশ্ন লোকের মুখে আছে। এদেশের মানুষকে বলা হয় ভোট পাগল। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ দলে-দঙ্গলে ভোট দিতে যাবে। বিশ শতকের প্রথম পর্বে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বাঙালির আবেগাধিক্য ও হুজুগে চরিত্র দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি বাঙালি চরিত্রে বিবেক ও যুক্তির পরিচয় কামনা করেছিলেন। সেটা ছিল গণজাগরণের কাল। গণজাগরণের স্পিরিটকে উন্নত করার জন্য বাংলায় ও ইংরেজিতে তিনি দুটি পুস্তিকা প্রচার করেছিলেন- নাম ‘বাঙালির মস্তিষ্কের অপব্যবহার’ ও 'The Misuse of Bengalee Brain'। আজকের যে অবস্থা, তাতে বাঙালির মস্তিষ্কের সদ্ব্যবহার, Proper use কি হচ্ছে? বাংলাদেশে ক্লাস ফাইভে, ক্লাস এইটে পাবলিক পরীক্ষা চালু করে, কথিত সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করে, অবান্তর পাঠ্যসূচি পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক চালু করে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাকে বহুধা বিভক্ত রেখে কোচিং সেন্টার গাইড বুক চালু রেখে যে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রাখা হচ্ছে, তাতে কি শিশু-কিশোরদের মস্তিষ্কের সদ্ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়েছে?

যাদের বুদ্ধিজীবী বলা হয় তাদের বৃহত্তম অংশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে যুক্ত এবং সক্রিয়। তাদের মধ্যে বিবেক, যুক্তি ও চিন্তাশীলতার পরিচয় অল্পই পাওয়া যায়। তারা পরিচিত হয়ে আছেন ‘দলদাস’ বলে। ফেসবুকে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কৌতুকের অন্ত নেই। যে বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগকে অবলম্বন করে আছেন, তাদের বড় অংশই আবার বিভিন্ন Civil Society Organization-এ যুক্ত এবং সক্রিয়। ১৯৮০-এর দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি ও প্রকৃতি নির্ধারিত হয়ে আসছে সুশীল-সুজনদের দ্বারা। নাগরিক কমিটির পর নাগরিক কমিটির সক্রিয়তার মধ্যে সরকারের উত্থান-পতন, অরাজনৈতিক নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন, জরুরি অবস্থা ইত্যাদি হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও বামপন্থি দলগুলোর নেত্রী-নেতারা বুঝতে পারেন না যে তারা সুশীল-সুজনদের তৎপরতার মধ্যে নিঃরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়ায় পড়ে আছেন। বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, জি-সেভেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টও সক্রিয় আছে সুশীল-সুজনদের পেছনে। সরকার, সব রাজনৈতিক দল এবং কথিত বিশিষ্টজনরা এই অবস্থা মেনে নিয়ে চলছেন। চিন্তাচর্চা, বিচার-বিবেচনা, স্বাধীন চিন্তাশীলতা অল্পই আছে এখন এদেশে।

রাজনৈতিক চিন্তা এখন সীমাবদ্ধ আছে নির্বাচনে। ভোটাভুটিকেই বলা হচ্ছে গণতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের আদর্শকে এখন সম্পূর্ণ আবেদনহীন রূপ দিয়ে রাখা হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের চিন্তা সীমাবদ্ধ আছে বিশ্বব্যাংক কথিত উন্নয়নের চিন্তায়। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে উৎপাদন ও বৈষয়িক সম্পদ বাড়ছে; সেই সঙ্গে বাড়ছে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-জবরদস্তি ও অসাম্য; মানুষ হারিয়ে চলছে মানবিক গুণাবলি। মানুষের সমাজে, রাষ্ট্রব্যবস্থায়, পাশবিক প্রবণতা কর্তৃত্ব করছে। প্রায় দুনিয়াব্যাপী নর ও নারীর কেন্দ্রীয় প্রেষণা (central motive) অধিক থেকে অধিকতর বিত্তবেসাতের মালিক হওয়া, অধিক থেকে অধিকতর ক্ষমতা লাভ করা, মানুষ চলছে নিছক ভোগবাদী মন-মানসিকতা নিয়ে। সংস্কৃতির স্থান দখল করে আছে অপসংস্কৃতি। সভ্যতা, প্রগতি এখন নিতান্তই হারানো প্রত্যয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় সন্ধান করা দরকার। চিন্তা লাগবে, কাজ লাগবে। কেবল চিন্তা দিয়ে হবে না, কেবল কাজ দিয়েও হবে না, এক সঙ্গে চিন্তা ও কাজ- দুই-ই লাগবে।

রাজনীতির প্রতি যে নেতিবাদী মানসিকতা বিরাজ করছে তা পরিত্যাগ করে ইতবাচক মনোভাব অর্জন করতে হবে। উন্নত রাজনীতি ছাড়া অবস্থার উন্নতি হবে না। উন্নত রাজনীতির কিছুই সমাজের উচ্চশ্রেণি থেকে, শাসকশ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের থেকে, কায়েমি স্বার্থবাদী রাজনীতিকদের থেকে, বিশ্বব্যাংক থেকে, সুশীল সুজনদের থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহোযোগীদের থেকে আসবে না। ছাত্র-তরুণদের থেকেও এখন নতুন চিন্তা আশা করা যাচ্ছে না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কায়েমি স্বার্থবাদীরা অত্যন্ত সতর্ক প্রহরায় তাদের নিয়ে কাজ করছে যাতে কোনোভাবেই তাদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তাশীলতা দেখা না দেয়। বুদ্ধিজীবীরা সুশীল-সুজন হয়ে, দলদাস হয়ে স্বাধীন চিন্তাশীলতা ও বৌদ্ধিক চরিত্র সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশের আজকের রাজনীতিবিদদের ও সুশীল-সুজনদের জীবন দর্শনের যদি কোনো নাম দিতে হয় তাহলে তাদের সুবিধাবাদী বলা যায়।

এরই মধ্যে জনজীবনে সম্ভাবনা আছে মানুষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত আকাঙ্ক্ষা আছে পরিবর্তনের ও উন্নতির রাজনীতির। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের জনগণের ওপর ভরসা না রেখে তাদের রাজনীতিকে করে তুলেছে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাস-অভিমুখী। নতুন রাজনৈতিক চিন্তা ও নতুন রাজনীতি দরকার। দরকার নতুন নেতৃত্ব। রাজনীতিতে নেতৃত্ব গঠিত হয় রাজনৈতিক দল নিয়ে। এই রাজনৈতিক দল নিয়েই আলোচনা দরকার। আমরা জনগণের রাজনীতি ও জনগণের রাজনৈতিক দলের কথা বলছি; কায়েমি স্বার্থবাদীদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের কথা বলছি।

সুশীল-সুজনরা, বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ তাদের প্রচারকার্যের দ্বারা এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে, নতুন রাজনীতি ও নতুন রাজনৈতিক দলের কথা উঠলেই শিক্ষিত, অশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত নির্বিশেষে সকলেই বলে ওঠেন এটা হবে না, এটা অসম্ভব। অবস্থা এমন যে, বলা যায় বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ এখম rational inferiority complex-এ ভুগছে।

দৈনিক পত্রিকাগুলোর উপসম্পাদকীয়তে এবং টকশোতে কেউ কেউ নতুন রাজনীতির ও রাজনৈতিক দলের কথা বলেন। প্রচার মাধ্যম গতানুগতি চায়। তারপরও নিয়ন্ত্রণের ব্যূহ ভেদ করে কেউ কেউ একটি-দুটি কথা বলে ফেলেন যাতে উন্নত রাজনৈতিক চিন্তা ও সর্বজনীন কল্যাণের চেতনা ফুটে ওঠে। যারা উন্নত প্রগতিশীল নতুন চিন্তা করেন তাদের মধ্যে ভাব বিনিময় দরকার, ঐক্য দরকার, সাংগঠনিক উদ্যোগ দরকার। এক সময়ে রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করতে হবে। দল ক্ষমতায় গিয়ে জাতিকে ভুল যাত্রা থেকে কল্যাণকর ঠিক যাত্রায় উত্তীর্ণ করতে পারে।

১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সব দলের রাজনৈতিক ভূমিকা ও জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি যদি কারণ-করণীয়-করণ ও ফলাফলের সূত্র ধরে পর্যালোচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে ‘উন্নয়নের জোয়ার’ বইলেও এবং ‘দিন বদল’ ঘটলেও বাংলাদেশ থেকে বিরুদ্ধ পরিবেশ পুরো দূর করা সম্ভব হয়নি। দূতাবাসমুখী রাজনীতি, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্ট অভিমুখী রাজনীতি, বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের ওপর অনাস্থা, উচ্চ ও মধ্যশ্রেণির লোকদের সন্তান-সন্ততিকে বিদেশে নাগরিক করে চলা ইত্যাদি বেশকিছু ব্যাপার আছে যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া কি আজ স্বাধীন রাষ্ট্র। এদের জাতীয়সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা এবং জাতিসংঘের সদস্যপদ আছে। এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ন্যাটোর বাহিনী গণহত্যায় লিপ্ত আছে। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী গণহত্যায় লিপ্ত আছে। গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় দেখা দিয়েছে তালেবান, আল-কায়েদা, আইএস ইত্যাদি জঙ্গিবাদী গুপ্ত সংগঠন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রগতিচেতনা নেই, সংগ্রামী স্পৃহা নেই, উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টির কোনো কর্মসূচি কর্মনীতি ও কার্যক্রম নেই।

লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads