• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
উন্মাতাল ফেসবুক

একপর্যায়ে তার চোখ গিয়ে স্থির হয় চুম্বনরত তরুণ-তরুণীর ওপর

সংগৃহীত ছবি

মতামত

উন্মাতাল ফেসবুক

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ০১ আগস্ট ২০১৮

কয়েকদিন ধরে ফেসবুকের পাতায় পাতায় একটি দৃশ্য নিয়ে উন্মাতাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। দৃশ্যটি হচ্ছে, টিএসসির বারান্দায় বসে এক তরুণ এক তরুণীকে চুমু খাচ্ছে। আর বাইরে ঝরছে অঝোর বারিধারা।

বাংলাদেশের মতো একটি দেশে প্রকাশ্যে এই দৃশ্য দেখে হোঁচট খেয়েছেন অনেকেই। কারণ আমরা কিছু ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার বিধি-বিধান মেনে চলি। আর এ-জাতীয় সম্পর্ক ধর্মীয় ও সামাজিক কোনোভাবেই স্বীকৃত নয়।

২৩ জুলাই তুমুল বৃষ্টিধোয়া দিনে পূর্ব পশ্চিম বিডি নিউজের ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। একপর্যায়ে তার চোখ গিয়ে স্থির হয় চুম্বনরত তরুণ-তরুণীর ওপর। যেখানে ওরা চুমু খাচ্ছে, তার আশপাশে ছিলেন আরো বেশ কয়েকজন। তারা এ ব্যাপারে নির্লিপ্ত, উদাসীন। কিন্তু উদাস হতে পারলেন না জীবন আহমেদ। তিনি দৃশ্যটা তার ক্যামেরাবন্দি করে ফেললেন। ছবিটি ফেসবুকে আর অনলাইন নিউজ ‘পূর্ব পশ্চিমে’ পাঠালেন। তার তোলা চুমুর দৃশ্য ভাইরাল হলো। ঝড় উঠল পক্ষে-বিপক্ষে। নিরপেক্ষ ভূমিকায়ও আছেন কেউ কেউ। সমাজ-সংস্কার-ধর্ম সব একসঙ্গে আলোচনায় উঠে এলো।  অভিভাবকরা শঙ্কিত তাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। কী জানি তারা কোথায় কী করে বেড়াচ্ছে। তরুণ-তরুণীর ওপর এখন বাবা-মায়ের সতর্ক দৃষ্টি। ওরাও ভয়ে আছে। কোথায় কে কখন ছবি তোলেন কে জানে!

এর মধ্যে সেই যুগলের অবস্থা আমরা জানি না। তাদের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। তারা সমাজে, সংসারে, পরিবারে কতটা আলোচিত বা ধিকৃত হচ্ছে, তাও  জানি না। তবে আমরা না জানলেও, না চিনলেও তাদের পরিবার আর চেনা লোকজন চিনেছে নিশ্চয়ই। তারপর তাদের ভাগ্যে কী জুটেছে কে জানে! বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের লেখাপড়ার পাট চুকে যাবে কি-না, এ বিষয়ে শঙ্কিত আমি। বিশেষ করে মেয়েটির লেখাপড়া। কারণ আমাদের দেশে পুরুষ কোনো দোষ করতে পারে না, সব দোষ নারীর। এই চুমুটা কিন্তু দুজনের ইচ্ছেতেই ঘটেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে যা-ই বলুক, পরিবার বলবে, সমাজ বলবে দোষ মেয়েটারই। পুরুষ চাইলেই দিতে হবে কেন। নিশ্চয়ই মেয়েটা প্রশ্রয় দিয়েছে। বড় আদেখলে মেয়েটা! সমাজে সংসারে মেয়েদেরই দিতে হয় বার বার অগ্নিপরীক্ষা। কোনো মেয়ে যে নির্দোষ, সেটা প্রমাণ তাকেই করতে হয়। এক্ষেত্রেও পুরুষ হওয়ার কারণে সুবিধা পাবে ছেলেটি আর মেয়েটি হবে নিগৃহীত। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কত অভিভাবক যে তাদের মেয়ের লেখাপড়া ছাড়িয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেবেন কে জানে! এই চুমুকে আমি প্রশংসা করছি না। দুটি ছেলে-মেয়ে অনুকূল পরিবেশে একান্ত কাছে এসে ভালোবাসার আবেগে এটা করে ফেলেছে। তারা মনে রাখতে পারেনি যে এটা প্রকাশ্য স্থান, সেখানে সামাজিকভাবেই চলাফেরা করার নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন আছে। সেটা মনে রাখা উচিত ছিল এই জুটির। ওরা নিঃসন্দেহে ভুল করেছে ।

আপাতদৃষ্টিতে দেখে অনেকেই এটাকে নিষ্কাম চুমু বলছেন। আবার অনেকে এর পরের ধাপের কথাও বলছেন। আসলে নিশ্চয়তা দিয়ে তো কিছুই বলা যায় না। আরো কিছু হতে পারতো,  নাও পারতো। বিষয় সেটা নয়। তবে আমি অবশ্যই বলব, তরুণ-তরুণীরা এ ধরনের মেলামেশার ক্ষেত্রে কেন সচেতন হননি। এটা অবশ্যই একটা অপরাধ। তাদের কারণে আজ বিপদগ্রস্ত তরুণ সাধারণ ছেলে-মেয়েরা। তাছাড়া যারা এই চুমুকে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন, তাদের নিজের কেউ এ কাজ করলে সমর্থন করতেন না এটা আমি হলফ করে বলতে পারি।

সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলব, ঢাকা শহরে রাস্তায় চলতে অনেক কিছুই দেখি। হুডবন্দি রিকশা বা পর্দাঘেরা সিএনজিতে বয়স্ক পুরুষকে অল্পবয়সী নারীসহ শালীনতা ভেঙে আপত্তিকর অবস্থায় অহরহ দেখা যায়। তার হাতগুলো চলাফেরা করে নারীর শরীরের যত্রতত্র। দেখা যায় রমনা পার্কে আর ধানমন্ডি লেকের ধারেও। পুলিশের চোখের সামনেই ঘটে এসব। সংসদ ভবনের লেকের পাড়ে রাত-বিরাতে গাড়ি থামিয়ে গাড়ির মধ্যে অনেক কিছু ঘটে। আমি যখন দেখি নিশ্চয়ই অন্যরাও দেখেন। এসব বিষয় নিয়ে কখনো কোনো কথা উঠেছে বা কেউ বাধা দিয়েছে বলে আমি শুনিনি। আগে পুলিশ মাঝে মাঝে দু-চারজনকে ধরে নিয়ে পরে ছেড়ে দিত। এখন তাও শোনা যায় না। একসময় কিছু লিগ্যাল প্রোসটিটিউশন ছিল, সেখানেই লোক যেত। এখন মহল্লায় মহল্লায় চলছে এ ব্যবসা। চলছে কিছু পরিবারেও। ঘণ্টা চুক্তিতে ঘর ভাড়া দেয় তারা। স্বামী আছে, ছেলে-মেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি আছে, তার মধ্যেই এই কাজ চলছে। এটা তাদের বাড়তি উপার্জনের একটা রাস্তা। পুলিশ জানে, মহল্লার কেউকেটারাও জানে। সবাই ভাগ পায়। আর ভাগ পেলেই চুপ।

আমাদের শালীন-অশালীন, ন্যায়-অন্যায় বোধ আজ লুপ্তপ্রায়।  রাস্তাঘাটে মেয়েদের টিজ করা, ওড়না টেনে ধরা, শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় হাত দেওয়া, অনেকেই দেখছেন কিন্তু কেউ কথা বলছেন না, প্রতিবাদ করছেন না। ফেসবুকে পোস্ট হলে একটি-দুটি মন্তব্য দিয়েই থেমে যান কেউ কেউ। বাসে ট্রেনে লঞ্চে মেয়েদের খামচে ধরছে রুচিহীন কোনো কোনো পুরুষ। বাসে ট্রেনে পাটক্ষেতে গণহারে ধর্ষণ হচ্ছে, ধর্ষণ শেষে মেরে ফেলা পর্যন্ত হচ্ছে, তাতেও অনেকেই নীরব। ঘুষ দুর্নীতি অনাচারে ছেয়ে গেছে দেশ। সবার মুখে কুলুপ আঁটা, কেবল সরব হলো প্রকাশ্য চুমুর ব্যাপারে।

সরব হোক তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে নয় কেন? আড়ালে যে প্রতিদিন শুধু চুমুু নয়, চুমু অতিক্রান্ত অসংখ্য ঘটনা, এমনকি এসবের পরিণতিতে অ্যাবরশন পর্যন্ত ঘটছে, এ কাজ করে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছে কিছু ক্লিনিক— সেদিকে কারো কোনো নজর নেই।

এটা ঠিক যে, আমাদের দেশ এখনো প্রকাশ্য চুমু সমর্থন করে না। পাশ্চাত্যে যে দৃশ্য অত্যন্ত কমন এখানে তা নিন্দনীয়। এটা  খুবই স্বাভাবিক। একটা সময় ছিল যখন দিনের বেলায় বাড়ির বউ স্বামীর ঘরে যেতে পারত না। গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সব কাজ সেরে চুপিচুপি স্বামীর ঘরে যেত। যেন স্বামীর কাছে যাওয়া কত অন্যায়। গর্ভবতী হলে লজ্জায় কাউকে বলতে পারত না। এমনকি প্রকাশ্যে স্বামীর সঙ্গে কথাও বলতে পারত না। সে দিনটা যে খুব বেশিদিন আগের তাও নয়।

এখন এই বৃষ্টিভেজা চুমু নিয়ে উন্মাতাল ফেসবুক। আর্টিকেল লিখেছেন অনেকেই। মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে, কয়েকদিন আগে এক মেয়েকে বখাটেরা ওড়না টেনে নিয়ে মোটরসাইকেলে পিষে মেরেছিল— সেই ছবি কেন ভাইরাল হলো না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন হাতুড়ি মহড়া দেয়, কেন সে ছবি ভাইরাল হয় না? গণধর্ষণ করে যখন পাটক্ষেতে ফেলে রেখে যায়, সে ছবি কেন ভাইরাল হয় না? মা যখন সন্তানকে চরম মমতায় চুমু খায়, সে ছবি কেন ভাইরাল হয় না? ভাইরাল হলো চুমুর ছবিটি, কেন? মানুষ মনে মনে এই ইচ্ছেটা পোষণ করে কিন্তু সামাজিক চাপে অবদমিত করে রাখে— তাই কি?

জীবন আহমেদের ওপর হামলাও হয়েছে। তার ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, আইডি হ্যাক হয়েছে। তার সহকর্মীরাই হামলা করেছে বলে জানা গেছে। জীবনের অপরাধ তার ছবিটি ভাইরাল হয়েছে, সে আলোচনায় এসেছে। অন্য বন্ধুরা পিছিয়ে গেছে। এটা একধরনের পেশাগত জেলাসি। এই জেলাসি রয়েছে আমাদের কর্মক্ষেত্রের সর্বত্র। কিন্তু সেই জেলাসি শারীরিক আঘাত পর্যন্ত নিয়ে এসেছে তরুণ-তরুণীর প্রকাশ্য চুমুর কারণে। অবাক হওয়ার মতোই!

জীবন আহমেদ পূর্ব পশ্চিম বিডি নিউজের আলোকচিত্রী। অনেক ভালো ভালো ছবি তিনি তুলেছেন বলে জেনেছি। কিন্তু এই ছবিটা ফেসবুকে বা পত্রিকায় ছাপানোকে আমি সমর্থন করি না। আমাদের দেশের মানুষ হুজুগে মাতে। তার বোঝা উচিত ছিল, কী সংস্কারাচ্ছন্ন, কী উদারচেতা- দুই শ্রেণিই ছবিটি লুফে নেবে। এক শ্রেণি বলবে, ‘জাত গেল জাত গেল, রসাতলে গেল’ আর আরেক শ্রেণি বলবে, ‘আহা কী প্রেম! প্রেমের জয় হোক।’ মাঝখান থেকে বিপদে পড়বে ওই প্রেমিকযুগল। হয়তো এই বিপদ তাদের বহন করতে হবে আজীবন। সব প্রেম তো শেষাবধি বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছায় না। সে ক্ষেত্রে জানাজানি হয়ে গেলে এদের বিয়ে এবং পরবর্তী সময়ে সংসারে সমস্যা দেখা দেবে, বিশেষ করে মেয়েটার।

আরেকটা কথা, জানি না এ ছবি তোলায় ওই যুগলের কোনো সম্মতি ছিলো কি-না। সম্মতি থাকলে ভালো, কিন্তু না থাকলে? কারো পারমিশন ছাড়া এ অন্তরঙ্গ ছবি তোলা কি শোভন? এতটা ব্যক্তিগত স্পেসে কি ঢোকা উচিত? জীবন রহমানের কোনো আত্মজনের এই ছবি যদি ভাইরাল হতো, তার কেমন লাগত? আমরা সমাজবদ্ধ জীব, সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আছে একথা যেমন ওই তরুণ-তরুণীর মনে রাখা দরকার ছিল, তেমনি দরকার ছিল জীবন রহমানেরও!

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাবেক যুগ্ম-সচিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads