• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটে বিশ্ববাসী

ভূগর্ভস্থ পানি ছাড়া নদ-নদী, খাল-বিল কিংবা পুকুর-জলাশয়ের পানি সুপেয় হলেও তা বিশুদ্ধ নয়

সংরক্ষিত বি

মতামত

বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটে বিশ্ববাসী

  • প্রকাশিত ০২ আগস্ট ২০১৮

সমগ্র বিশ্বে মোট মজুত পানির পরিমাণ এক হাজার ট্রিলিয়ন টন। তার মধ্যে সমুদ্রে সঞ্চিত লবণাক্ত পানির পরিমাণ ৯৭ দশমিক ২ শতাংশ, যা মোটেই পান করার যোগ্য নয়। অপরদিকে ২ দশমিক ১৫ শতাংশ পানি জমাটবদ্ধ হয়ে আছে বরফাকারে। সেটিও পানযোগ্য নয়। বাকি শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ জল সুপেয় হলেও প্রায় শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ পানি রয়েছে ভূগর্ভে, যা উত্তোলনের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন পানযোগ্য পানির চাহিদা পূরণ করতে হয়। এটি আমাদের কাছে বিশুদ্ধ পানি হিসেবে পরিচিত। এই পানির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে প্রতিটি মানুষের জন্য দৈনিক গড়ে ৩ লিটার হারে। ভূগর্ভস্থ পানি ছাড়া নদ-নদী, খাল-বিল কিংবা পুকুর-জলাশয়ের পানি সুপেয় হলেও তা বিশুদ্ধ নয়। তবে সেটিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। বিশেষ করে গোসল, রান্নাবান্না, জামাকাপড় ধোয়ার কাজে এ পানির ব্যাপক প্রয়োজন পড়ে। তাতে করে একজন মানুষের সব মিলিয়ে গড়ে ৪৫-৫০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়।

অবধারিত সত্য কথাটি হচ্ছে, বিশ্বের মোট আয়তনের তিন ভাগ পানি হলেও বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটে ভুগছে ৮০টি দেশের প্রায় ১১০ কোটি মানুষ। এ ছাড়া প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ১৮ লাখ শিশু প্রাণ হারাচ্ছে শুধু দূষিত পানি পান করে। প্রতিদিনের পানি পানের চাহিদা মেটাতে কিংবা বিশুদ্ধ পানি পান থেকে বঞ্চিত হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, খরা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া কিংবা আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াই প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা আর মাত্র এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলেই বিশ্বের মোট ১৪৫ কোটি মানুষ সুপেয় পানি সঙ্কটের মুখোমুখি হবে। এর মধ্যে এশিয়া মহাদেশে ১২০ কোটি এবং আফ্রিকা মহাদেশে ২৫ কোটি মানুষ এর আওতায় পড়বে। এর থেকে বাদ যাবে না বাংলাদেশের মানুষও। বরং তুলনামূলক হিসাবে বাংলাদেশের হার বেশিই পড়বে।

গোটা বিশ্বে পানি সঙ্কট চরম আকার ধারণ করার ফলে জাতিসংঘ এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মরিস স্ট্রং ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত এক বিশ্ব সন্মেলনে সুপেয় পানি সঙ্কটের কথা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘একুশ শতকে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যায়, তবে তার প্রধান ইস্যু হবে পানি।’ তার আশঙ্কা যে অমূলক নয়, সেটার প্রমাণও আমরা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছি। যেমন নীলনদের পানি বণ্টন নিয়ে বরুন্ডি, কঙ্গো, তানজানিয়া, ইথিওপিয়া, সুদান, মিসর, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, উগান্ডাসহ আরো কয়েকটি দেশ দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া তানজানিয়া, ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, উগান্ডা নীলনদের পানি বণ্টন নিয়ে ‘কো-অপারেটিভ ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট অন দ্যা নীল রিভার বেসিন’ নামক একটি চুক্তি স্বাক্ষরও করেছে। যার ফলে ওই এলাকায় এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের আরেকটি দ্বন্দ্বের সংবাদ জানা যায় যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার মধ্যে। কানাডার সাসকাচুয়ান প্রদেশে ৮২ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে সুপেয় জলধারা। সেই জলধারার দিকে নজর পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে কানাডা সরকারের কাছে পানি আমদানি করতে চাইলে কানাডা সরকার তা নাকচ করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে কানাডার জনগণও সরকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। ফলে দু’দেশের মধ্যে এ নিয়ে কিছু টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে যৎসামান্য দূরত্বও। সম্প্রতি তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে ভারত-বাংলাদেশও। ফারাক্কা বাঁধ নিয়েও ইতোপূর্বে কম যায়নি। যার রেশ এখনো রয়ে গেছে। সেই বাঁধের খেসারতও আমাদের দিতে হচ্ছে।

অপরদিকে আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার উৎপত্তি হবে, যদি টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। জানা যায়, এ বাঁধের দৈর্ঘ্য ১৫০০ ফুট এবং উচ্চতা ৫০০ ফুট। বিশাল এ বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশের সিলেটসহ এক-তৃতীয়াংশ এলাকা এবং ভারতের মিজোরাম, মনিপুর, আসামের নৌপরিবহন, কৃষি, মৎস্যসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হবে। শুধু সিলেট ও মৌলভীবাজারের ৩৫ হাজার ৩৪৩ হেক্টর জমি বিরান হয়ে যাবে। এ বাঁধের ফলে মরুকরণের পাশাপাশি সমুদ্রের লোনা পানি উপরের দিকে উঠে আসবে। এতে সুপেয় পানির সঙ্কট দেখা দেবে। যেমন দেখা দিয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলার ফলে। এখানে স্পষ্ট লক্ষণীয় যে, বন্ধুপ্রতিম দু’দেশের সম্পর্কের অবনতির অন্তরালে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পানি বণ্টন। এতে প্রতীয়মান হয়, আগামী শতকে সুপেয় পানিই হবে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান হাতিয়ার। সেই হাতিয়ারটি রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকেও। সরকারকে এক্ষুনি আটঘাট বেঁধে নামতে হবে নদী খননের কাজে। নদী-নালা-খাল খননের মাধ্যমে হারানো নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতেও সচেষ্ট হতে হবে। তাতে করে আমাদের সুপেয় পানির চাহিদার ঘাটতি অনেকখানি কমে যাবে এবং তা সংরক্ষণও হবে। কারণ বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেকখানি নিচে নেমে গেছে বেশি বেশি উত্তোলনের ফলে, যা বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন নজির নেই। সুতরাং আমাদের এক্ষুনিই সাবধান হতে হবে। না হলে মেসোপটোমিয়া, ইথিওপিয়ার প্রাচীন সভ্যতার মতো পানি সঙ্কটের কারণে বিশ্বের বুক থেকে হারিয়ে যাবে একদিন বাংলাদেশ।

এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশে বিশুদ্ধ পানি সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করছে ইতোমধ্যেই। প্রায় ৭ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটে ভুগছেনও। তার মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ অতিমাত্রায় ভুগছেন। এদের জীবন বিপন্ন হওয়ার পথে বলা যায়। সেই সুযোগটি নিয়েছেন আমাদের দেশের পানি ব্যবসায়ীরাও। বিশুদ্ধ পানির বিজ্ঞাপন দিয়ে কিছু কিছু ব্যবসায়ী রীতিমতো ট্যাপের পানি বোতলে ঢুকিয়ে তা বাজারজাত করে চড়া দামে বিক্রি করছেন। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায় দুধ এবং পানি সমমূল্যে বিক্রি হতে। তারপরও সেই পানি নিরাপদ নয়। নিরাপদ পানি ভেবে ক্রেতারা তা পান করার ফলে পানিবাহিত রোগে ভুগছেন দেদার। এ ধরনের খবর আমরা প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই দেখতে পাই। এ হীনকর্মের জন্য ধিক্কার জানানোর পাশাপাশি আইনের আওতায় এনে এদের দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি কামনা করছি। তাহলে পানি জালিয়াতির ঘটনা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে জাতি।

আলম শাইন

কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ

alamshine@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads