• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ছাত্র আন্দোলন : অন্ধকারে নতুন আলো

মননে ভাবনার ক্ষেত্রটি তখন বিশাল সমুদ্দুর, পুরো বাংলার মানচিত্র

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

ছাত্র আন্দোলন : অন্ধকারে নতুন আলো

  • ওমর ফারুক শামীম
  • প্রকাশিত ০৩ আগস্ট ২০১৮

বুক ভরে গেছে গর্বে, চোখ ভিজে গেছে আনন্দে। মননে ভাবনার ক্ষেত্রটি তখন বিশাল সমুদ্দুর, পুরো বাংলার মানচিত্র। দৃষ্টিতে দেখছি শত বেদনা ছাপিয়ে আঠারো কোটি নক্ষত্র বাংলার আকাশকে আলোকিত করে তুলেছে।

গত পহেলা আগস্ট অফিসে বসেই কয়েকটি প্রথম সারির পত্রিকার অনলাইন ভার্সন ও কয়েকটি অনলাইন পত্রিকার প্রধান প্রধান সংবাদ পড়ছি— উল্টো পথে আসায় তোফায়েল আহমেদের গাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে আন্দোলনরত ছাত্ররা; ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকায় ছাত্ররা; গাড়ির ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করছে ছাত্ররা; উল্টো পথে আসায় র্যাব-পুলিশের গাড়িও ফিরিয়ে দিয়েছে ছাত্ররা; এবং হেলমেট আর লাইসেন্সবিহীন পুলিশের মোটরসাইকেল আটকে দিয়েছে তারা।

দেশের সবক’টি সংবাদপত্রের অনলাইন এবং টেলিভিশনে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের এই অভূতপূর্ব সংবাদ প্রচার হচ্ছিল বার বার। বিশ্বাসই করতে পারছি না আমি এই বাংলার মানুষ। আমার দেশের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কোমলমতি ছাত্ররা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানী ঢাকা অচল করে দিয়েছে। বাসচাপায় দুই সহপাঠী দিয়া ও করিমের মর্মান্তিক মৃত্যুতে ওরা ক্লাস ছেড়ে রাজপথে নেমে এসেছে প্রতিবাদ জানাতে আর নিরাপদ সড়কের দাবিতে। ওরা পুলিশের দমনে আরো জেগে উঠেছে। প্রমাণ করেছে সবকিছু পুলিশ দিয়ে রক্ষা করা যায় না। পহেলা আগস্টেও যাত্রাবাড়ীতে আরেক পিকআপ চালক তাদের নিষ্ঠুরতার নজির দেখায়। আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর দিয়ে পিকআপ চালিয়ে দেয়। পরিবহন মালিকরা কাদের হাতে তাদের গাড়ির চাবি তুলে দিয়েছেন- এই ঘটনাটি তার আরেকটি জ্বলন্ত প্রমাণ। নিহতের ঘটনা ঘটেনি, তবে আহত হয়েছে কয়েকজন। তবুও দমেনি ছাত্ররা। ওদের দৃঢ়চেতা মনোবল চালক নামের কিছু হায়েনাকে আরো ভীত করেছে।

প্রযুক্তির স্বর্ণযুগের ডিজিটাল প্রজন্ম যতটা অধিকার সচেতন, ততটা প্রতিবাদীও। ওরা কোনো কিছুর সীমা লঙ্ঘন বরদাশত করবে না। শুধু দিয়া-করিমের মৃত্যুই নয়, সড়কে মৃত্যুর মিছিলের দীর্ঘ সারি ওদের মস্তিষ্কে শোকের রক্তক্ষরণ তৈরি করেছে। কারণ ওরা প্রযুক্তির আবহে লালিত, বিশ্বায়নের বাংলাদেশ গ্রামের বাসিন্দা। তথ্য প্রবাহের অবাধ ক্ষেত্রে সব খবরাখবরের সঙ্গেই ওরা পরিচিত। সরকারের প্রশাসনিক ভুলে পুলিশ দিয়ে ছাত্রদের আন্দোলন দমন করতে গিয়ে তা আরো উল্টো গতি পেয়েছে। এক দিনের ব্যবধানেই কিশোর-যুবক ছাত্রদের এই আন্দোলন বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সবকটি এলাকায় ছাত্রদের এই প্রতিবাদী কর্মসূচি সর্বজনীন সমর্থন পেয়েছে। একইভাবে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।

চতুর্থ দিনে সরকারের বোধোদয় হয়েছে। ছাত্রদের আন্দোলনকে যৌক্তিক মেনে নিয়ে শিগগিরই তাদের সব দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। একই দিন সরকারের পরিবহন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন মাঠে নেমেছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের পাকড়াও করতে। পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রী ও উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা গণমাধ্যমে দেশবাসীকে সাক্ষী রেখে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার কথাটিও বলেছেন। এ যেন শোকের আবহে সান্ত্বনার কিছু পাওয়া। যারা চলে গেছে তাদের তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে আর কারো ভাগ্যে যেন মর্মন্তুদ সেই পরিণতি না আসে এই আন্দোলন তারই একটি স্মারক এবং সরকারের জন্য সতর্কবার্তা।

গত কয়েক দশকে দেশে কোনো আন্দোলন সংগ্রামের মুখে সরকার পক্ষ এত কম সময়ে দাবি মেনে নেওয়ার নজির এটিই প্রথম। একটি মর্মন্তুদ ঘটনার মধ্য দিয়ে নৈমিত্তিক বিপর্যয় থেকে রেহাই পাওয়ার সূচনা হলো মাত্র। এ জন্য আমরা আশাবাদী, দেরিতে হলেও দেশবাসী নিরাপদ সড়কে চলতে পারার শুভ কাজের সূচনা করতে পেরেছে। দেশের মানুষ এবং আইনকে জিম্মি করে রাখা একটি চক্রের চাপিয়ে রাখা জগদ্দল পাথর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার প্রথম কাজটি শুরু হয়েছে। তাও আবার ছাত্রদের হাত ধরেই। এই ছাত্ররাই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বাঙালির দুঃসময়ে অধিকার আদায়ের সব আন্দোলনে সবার আগে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবারো সে ছাত্রসমাজই সড়ক দুর্ঘটনার নৈমিত্তিক বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ত দিয়েছে।

এ জাতি বড়ই ভাগ্যবান— এ জন্য যে, দেশের সর্বত্র ছাত্র আন্দোলনের সোনালি ইতিহাস এখনো তাদের গৌরবকে এগিয়ে নিয়ে যায় আরো কিছু করতে। তাই সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে ছাত্ররাই সার্থক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিল এবং দাবি আদায়ের কাজ একধাপ এগিয়ে নিল।

দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় যেভাবে লোক মারা যায়, তার গড় হিসাবে প্রতিদিন ৬৪ জনের প্রাণ সংহার হয় সড়কেই। প্রতিবছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ১৬৬ জন প্রাণ হারায়। মাত্র ৫৫ হাজার ৫৯৮ মাইলের এই বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে ৫৫ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়। এটি বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের জরিপের পরিসংখ্যান। গণমাধ্যমে বিশিষ্টজনদের বিশ্লেষণে এই সড়ক দুর্ঘটনা নৈমিত্তিক বিপর্যয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। যে বিপর্যয়ে দেশের জিডিপিতে ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়া একটি দেশের সড়কে এমন মৃত্যুহার বিপর্যয় ছাড়া কোনোভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। কারণ ঘর থেকে বেরিয়ে নিরাপদে ফিরে আসার নিশ্চয়তা কারোরি নেই।

বাস মালিকদের অতি মুনাফার লোভ, অদক্ষ চালকদের কম বেতনে নিয়োগ, জঘন্য অপরাধে লঘু শাস্তিসহ পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠনগুলো দেশবাসীকে জিম্মি করে রেখেছে। সরকার নির্ধারিত ভাড়া উপেক্ষা করে, জনগণকে জিম্মি করে অর্থ হরিলুটের ক্ষেত্র বানিয়েছে তারা। নগর পরিবহনের ব্যবসায় সরকারের অনেক মন্ত্রী ও তাদের আত্মীয়স্বজন যুক্ত হয়েছে। তাদের পাশাপাশি পুলিশের কিছু কর্মকর্তাও যুক্ত রয়েছে এই পরিবহন ব্যবসায়। ক্ষমতাশালী এসব পরিবহন ব্যবসায়ীর পরিবহনের বিরুদ্ধে কখনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পদক্ষেপ নেয় না। সবসময় আগাম তথ্যসূত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত এড়িয়ে চলে এসব গাড়ি। কখনো ধরা পড়লেও ক্ষমতার দম্ভে তা ছাড়া পেয়ে যায়। আর যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় তো নিয়মে পরিণত হয়েছে। সড়কে এমন বিশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা পৃথিবীর কোনো দেশেই চোখে পড়ে না। শ্রমিক ফেডারেশনের সাংগঠনিক শক্তি ব্যবহার করে সরকার ও আইনকে জিম্মি করে এমন নৈরাজ্যকর চিত্র শুধু বাংলাদেশেই দেখা যায়। নানা রকমের অন্যায়, অনিয়ম আর জুলুমবাজি করে দেশের জনগণের অর্থ হাতিয়ে প্রতিদিন কোটি টাকার চাঁদা সংগ্রহ করছে পরিবহন সংগঠনের এই নেতারা। এসব নেতার চোখে সড়কে মানুষ মারা যাওয়া যেন পাখি মারা যাওয়ার মতো ঘটনা। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা দেদারসে তাদের অপকর্ম অব্যাহত রাখছে। সাধারণ জনগণ কোনো দুর্ঘটনার প্রতিবাদ করলে তারা সেই সড়কে পরিবহন চলাচল বন্ধ করে উল্টো ভোগান্তির অবস্থা তৈরি করে মুহূর্তেই। একটি দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় এমন বিশৃঙ্খলা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সড়কে প্রতিদিনের দুর্ঘটনা আর মৃত্যুহারকে বিশেষজ্ঞরা নৈমিত্তিক বিপর্যয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের এমন বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়াই এখন সময়ের দাবি।

লেখার শুরুতে যে আবেগমিশ্রিত আনন্দ বাক্যগুলো লিখেছি তা সময়েরই বাস্তবতা। প্রযুক্তির সোপানে লালিত প্রজন্মকে আমরা যেমন তৈরি করছি তারাও তেমনই গড়ে উঠেছে। ইন্টারনেট সুবিধার অবাধ ক্ষেত্রে ওরা এখন সবকিছুর সাক্ষী। কিশোর-যুবক ছাত্রদের এই আন্দোলন থেকে সে বার্তাই পাওয়া গেছে। এই প্রজন্মের হাতেই আগামীর বাংলাদেশ সুন্দর-সুখী ও সমৃদ্ধ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকায় ছাত্রদের নজিরবিহীন এই দায়িত্ব পালনের ঘটনা বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। গত চার দিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র আন্দোলনের চিত্র— দৃঢ়চেতা মনোবল আর অসীম সাহসিকতা, সে আশাকেই জাগিয়ে তুলেছে।

লেখক : সাংবাদিক, সমাজ বিশ্লেষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads