• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

দুর্বোধ্য সৃজনশীলে দিশাহারা শিক্ষা

  • প্রকাশিত ০৪ আগস্ট ২০১৮

শিক্ষা নিয়ে ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে দিশাহারা শিক্ষার্থীরা। এমসিকিউ, নম্বরের মানবণ্টন, পিইসি, জেএসসি থাকা না থাকা, পাঠ্য বইয়ের সংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে শুধু গবেষণাই চলছে। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বাজারে অবাধ নোট-গাইড এখন। আবার অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও দেদারসে চলছে কোচিং সেন্টার। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব সঙ্কটের মূলে কাজ করছে সৃজনশীল পদ্ধতি।

সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালুর সময় বলা হয়েছিল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ ও যোগ্য একদল শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা এর সুফল পাবে; কিন্তু সেটি সম্ভবত হয়নি। রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশনের (রেইস) জরিপ থেকে জানা যায়, মোট শিক্ষার্থীর এক-চতুর্থাংশই পরীক্ষার প্রশ্ন বুঝতে অক্ষম। তাদের কাছে কঠিন মনে হয় বিশেষ করে গণিত ও ইংরেজির মতো বিষয়গুলো। এতে আরো বলা হয়, শিক্ষার্থীদের ৯২ শতাংশই গাইডবই নির্ভর। তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝার জন্য গৃহশিক্ষক এবং কোচিংয়ের সাহায্য নেয়। অন্যদিকে শিক্ষকদের মাত্র ৪৫ শতাংশ এ পদ্ধতি বোঝেন, ৪২ শতাংশ অল্প অল্প বোঝেন, ১৩ শতাংশ এ পদ্ধতি বুঝতেই পারেননি। ফলে শিক্ষার্থীরা মূল জিনিস থেকে সরে গিয়ে ছুটছে সৃজনশীলের পেছনে। তারা পড়াশোনায় আর মনোযোগ দিচ্ছে না। বড়দের কথা না হয় বাদ দিলাম, সিন-আনসিনের মতো বিষয় প্রাথমিকের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কি বুঝবে নাকি তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব? এ কেমন অসহায়ত্ব? ফলে তারা হতাশায় ভুগছে। চিকিৎসকরা বলছেন এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

গত জানুয়ারি মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মনিটরিং শাখার ‘একাডেমিক তদারকি প্রতিবেদন’ জানিয়েছে, মাধ্যমিক স্কুলের ৫৪ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। তাদের ২২ শতাংশের অবস্থা খুবই নাজুক। বাকিরা এই সম্পর্কে যে ধারণা রাখেন, তা দিয়ে আংশিক প্রশ্নপত্রও তৈরি করা সম্ভব নয়। আর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও প্রায় একই চিত্র পাওয়া গেছে। এ কারণে ১০ বছর পার হওয়ার পরও জোড়াতালি দিয়েই চলছে সৃজনশীল পদ্ধতি। আর কবে এই পদ্ধতির উন্নতি হবে?

গত নভেম্বরে প্রকাশিত মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সর্বশেষ একাডেমি তদারকি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখনো ৪০.৮১ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে পারেন না। প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, ৫৯.১৯ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে পারেন। অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন ২৫.৯৯ শতাংশ শিক্ষক। আর বাইরে থেকে প্রশ্ন প্রণয়ন করেন ১৪.৮৩ শতাংশ শিক্ষক। তদারকি করা সাত হাজার ৩৫৮টি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা ৯৪ হাজার ৭৩৩ জন। এর মধ্যে সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৫৪ হাজার ১৯৬ জন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালের মে মাসে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য প্রশ্ন সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ করে। ওই প্রজ্ঞাপনে যেসব স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এখনো নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারে না তাদের চিহ্নিত করে এমপিও বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপরও পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটেনি। এমনকি একাধিক পাবলিক পরীক্ষায় গাইড থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। আর স্কুল-কলেজে হরহামেশাই কেনা প্রশ্নে নেওয়া হচ্ছে পরীক্ষা।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর) আয়োজন করে, ‘বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন : শিক্ষায় করণীয়, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনার। সেখানে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ‘সৃজনশীলতাকে আমরা যেভাবে দেখছি বা বলছি আসলে কি তাই? একজন মানুষ কি সব বিষয়ে একসঙ্গে সৃজনশীল হতে পারে? সৃজনশীলের ৯টি ডাইমেনশনের মধ্যে লেখনী একটা। আমাদের দেশে কেন শুধু লেখনী দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর পুরো সৃজনশীলতা বিবেচনা করা হবে? তাহলে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কি সৃজনশীল ছিলেন না?’

পরিশেষে বলা যায়, সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর সময় এই বিষয়ে যথেষ্ট প্রস্তুতি ও প্রচার হয়তো আমাদের ছিল না। আর এসব সম্পূর্ণ করতে বিশাল ব্যয়ভার লাগে। কিন্তু শিক্ষার মতো বিষয় নিয়ে আর কালক্ষেপণ নয়। দ্রুত এই বিষয়ে সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। একদল প্রশিক্ষণ নেবে আবার ওই দলই এলাকায় ফিরে বাকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবে। প্রশিক্ষণের ওপর মনিটরিং রাখতে হবে। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, শিক্ষকরা কতটুকু এই বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠেছে এবং সর্বোপরি এই পদ্ধতির সফলতা-দুর্বলতার ওপর নজর রাখতে হবে। এই পদ্ধতি জনপ্রিয় ও সফলতা আনতে যা যা করা দরকার তাই করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা ছাড়া আঁধার ঠেলা যায় না। যখন সমাজের অনেক ক্ষেত্রে আঁধার ঠেলা জরুরি হয়ে পড়েছে।

আ. ব. ম. রবিউল ইসলাম

লেখক : শিক্ষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads