• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা

‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এই দাবিতে আন্দোলরত শিক্ষার্থীরা

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা

  • আবুল কাসেম ফজলুল হক
  • প্রকাশিত ০৬ আগস্ট ২০১৮

গত তিন বছর ধরে ছাত্রছাত্রীরা কিছু দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। ২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকেই দেশে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নেই। জনগণের জন্য কল্যাণকর এবং জনগণের কাছে আকর্ষণীয় কোনো বক্তব্য নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল প্রচারকার্য চালাচ্ছে না এবং আন্দোলনে আসছে না। ২০১৪ সাল থেকে নির্বাচনকে বলা হচ্ছে ‘উৎসব’, ‘জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব’। এবার খুলনা, গাজীপুর, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে বলা হয়েছে ‘ভোটের উৎসব’। নিঃরাজনীতিকরণেরই দৃষ্টান্ত এসব। এই রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে ছাত্রদের অরাজনৈতিক সমস্যাভিত্তিক আন্দোলন প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিপুল প্রচার পেয়েছে এবং সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই আন্দোলনগুলোতে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে অত্যন্ত সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। আন্দোলন দমনে তারা শক্তি প্রয়োগেও লিপ্ত থাকছে। ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন প্রভৃতি সংগঠনকে নেতৃত্বের অবস্থানে দেখা যায়নি। নানাভাবে তারা আন্দোলনকে সমর্থন করছে, আন্দোলনে অংশগ্রহণও করেছে। কিন্তু নেতৃত্বে থাকেনি। এটাও নিঃরাজনীতিকরণেরই দৃষ্টান্ত। দেশে রাজনীতি যেমন নেই, ছাত্ররাজনীতিও তেমনি নেই। দেশে উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি হওয়ার কোনো স্বাভাবিক সুযোগ রাখা হচ্ছে না।

এই রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে প্রথমেই দেখা দেয় ঢাকা শহরের সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে নেওয়ার ফলে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের দাবিতে আন্দোলন। অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের সময়মতো পরীক্ষা না হওয়া, সময়মতো পরীক্ষার ফল প্রকাশিত না হওয়া, লেখাপড়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ইত্যাদি সমস্যার আশু সমাধানের দাবি জানায় আন্দোলনকারীরা এবং সময় যেতে থাকলে এক পর্যায়ে তারা রাস্তায় মানববন্ধন, শাহবাগ মোড়ে জনসমাবেশ ইত্যাদি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও এই সাত কলেজের অধিভুক্তির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে এবং অধিভুক্ত কলেজগুলোর ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে সমর্থন দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাড়তে বাড়তে এমন দশায় পৌঁছেছে যে, নিজের ভারে নিজেই চলতে পারছে না। এর ওপর এসে যুক্ত হয়েছে সাত কলেজের তিন লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীর ভার। সমাজের নানা স্তর থেকে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নিজের সিদ্ধান্তে অটল। সরকারের বক্তব্য সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকছে। ছাত্রছাত্রীদের মানববন্ধন ও সমাবেশে পুলিশের আক্রমণ আসে। ছাত্রলীগের আক্রমণ আসে। তাতে দু-একজন ছাত্র দারুণভাবে আহত হয়। তা ছাড়াও পনেরো-ষোলো ছাত্রছাত্রী আহত হয়। মামলা-মোকদ্দমা হয়। একটি ছাত্রের দুটি চোখই নষ্ট হয়ে যায়। তাকে সরকার চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠায়, কিন্তু চিকিৎসায় তার একটি চোখেরও দৃষ্টিশক্তি ফেরেনি। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অসাধারণ কৃতিত্ব এই যে, তারা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে আন্দোলন দমন করতে পেরেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই সাতটি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনাধীন ছিল। তাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরিয়ে আনার ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কতখানি উপকৃত হয়েছে বলতে পারব না; তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলছি যে, এর দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি-অবনতি নিয়ে চিন্তা করার লোক কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সত্তা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। এর মধ্যে অধিভুক্ত সাত কলেজের বোঝা তাকে ভেতর থেকে কাবু করে চলছে।

সাত কলেজের অধিভুক্তির ফলে সৃষ্ট সমস্যাবলির সমাধানের জন্য আন্দোলন দমনে সরকারের সাফল্যের পরেই দেখা দেয় কোটা সংস্কারের আন্দোলন। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান ছাপ্পান্ন শতাংশ কোটাকে রাষ্ট্রের স্বার্থের দিক থেকে অপ্রয়োজনীয় ও অনুচিত বলে জাতি ও রাষ্ট্রের স্বার্থে কোটা কমিয়ে দশ শতাংশ করার এবং বাকিটা পরীক্ষাভিত্তিক যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগদানের দাবি তোলা হয়। অনেকে মতপ্রকাশ করেন যে, সরকার প্রয়োজন মনে করলে সর্বাধিক বিশ শতাংশ কোটা রাখতে পারে। সরকার চলমান ছাপ্পান্ন শতাংশ কোটা রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর থাকে। এর মধ্যে সরকার ত্রিশ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিদের জন্য সংরক্ষিত রাখার নীতিতে অটল থাকে। সরকারের এক মন্ত্রী আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে প্রশ্ন তোলেন। সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নানারকম কটূক্তি করা হয়েছে। সরকার নানা সময়ে নানা কথা বললেও প্রচলিত প্রথা রক্ষা করে চলার অবস্থানে দৃঢ় আছে। আন্দোলনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী একসময় জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন যে, সব কোটা তুলে নেওয়া হবে, কোনো কোটা থাকবে না। প্রতিবন্ধী ও পশ্চাৎবর্তী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নতির জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কোনো প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ার ফলে তিন মাস পরে আন্দোলনকারীরা আবার আন্দোলন আরম্ভ করে। তাতে সরকার কোটা সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে একটি সুপারিশ প্রণয়নের জন্য প্রশাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি কমিটি করে দেয় এবং কমিটিকে পনেরো কর্মদিবসের মধ্যে সুপারিশ প্রকাশের জন্য আদেশ দেয়। পনেরো কর্মদিবস পার হতে না হতেই কমিটিকে রিপোর্ট প্রদানের জন্য আরো তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেয়। ফল কী হবে কে জানে? বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় এখন দুইশ’ নম্বর আছে। ২০০৮ সালে আসা সরকারের আগে এই নম্বর একশ’ ছিল। জাতি ও রাষ্ট্রের স্বার্থে এই নম্বর কমিয়ে একশ’ করার দাবিও উত্থাপিত হয়েছে। আমার মনে হয়, বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় পঁচিশ নম্বর করা উচিত। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সীমাহীন দমননীতি চালায়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। সরকারি দলের ছাত্রলীগও তাদের ওপর বলপ্রয়োগমূলক কার্যকলাপ চালাচ্ছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন নির্দয় দমননীতির মধ্যেও শেষ হয়ে যায়নি। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে এবং পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বেপরোয়া আচরণ নিয়ন্ত্রণের দাবিতে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন। এই আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে গত ২৯.৭.২০১৮ তারিখে। ওই দিন ঢাকা এয়ারপোর্টের কাছে বড় রাস্তার পাশে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা দাঁড়িয়েছিল। বেপরোয়া বাস তাদের ওপর এসে পড়ে এবং দুজন ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বাসের এভাবে রাস্তার পাশে অপেক্ষমাণ ছেলেমেয়ের ওপর এসে পড়া সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক ব্যাপার। এ ঘটনার পরই স্থানীয় স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমে আসে এবং দুপুর ১২টার দিক থেকে সারাদিন বাস ও গাড়ি ভাঙচুর করে। তারা ড্রাইভারের বিচার দাবি করে। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে স্লোগান তোলে।

পরিবহন শ্রমিকদের ও পরিবহন মালিকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের দাবি তোলে। পুলিশ তাদের দমন করার জন্য তৎপর হয়। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশি জুলুম বন্ধ করার স্লোগান দেয়। ওই দিন এবং তার পরের দিনও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটতে থাকে। আন্দোলন ঢাকা শহরের বাইরেও সারা দেশের শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাড়তে থাকে। এর মধ্যে সরকার ঘোষণা করে যে, ২.৮.২০১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার সারা দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত সব স্কুল-কলেজ-মাদরাসা বন্ধ থাকবে। দেখা গেল বন্ধের দিন সকাল ৮টা থেকেই সারা দেশের শহরগুলোতে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমে এসে সারাদিন ট্রাক, বাস, গাড়ি, বেবিট্যাক্সি, মোটর সাইকেলের ফিটনেস সার্টিফিকেট, চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করে। সরকার হয়তো পুলিশের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের মারধর না করতে। বন্ধের দিন রাস্তায় পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের পেছনে থেকে সহযোগিতা করে এবং প্রচার মাধ্যমের ক্যামেরার সামনে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকার প্রশংসা করে কথা বলেন। তারা পরিবহন ও ট্রাফিক রুল সংস্কারের প্রয়োজনের কথা বলেন। বৃহস্পতিবার বন্ধের দিন ঢাকায় ও অন্যান্য শহরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ছেলেমেয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করে। সরকার পক্ষ থেকে কেউ কেউ এমন কথা বলে ওঠেন যে, সেগুলো উত্তেজনা বৃদ্ধির সহায়ক হয়। আন্দেলনকারীদের এবার আর ‘রাজাকারের বাচ্চা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি’, ‘আলকায়েদা আইএস জেমবি দ্বারা পরিচালিত’ ইত্যাদি কথা বলা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী নিহত ছাত্র ও ছাত্রীর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেন এবং তা বড় করে প্রচার করা হয়। কোনো কোনো মন্ত্রী বলেন যে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের এই আন্দোলনের পেছনে কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা আছে। এই আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে নয়, সরকারের কাছে কতিপয় দাবি পেশ করার জন্য। আগের দুটি আন্দোলনও সরকারের বিরুদ্ধে ছিল না; ছিল সরকারের কাছে আবেদন। কিন্তু সরকার সেগুলোকে পাকিস্তানপন্থিদের কার্যকলাপ, রাজাকার-আলবদরদের আন্দোলন বলে অভিযোগ তোলে।

জাতীয় সংসদের নির্বাচন আসন্ন। এ অবস্থায় সমাজের নানা স্তর থেকে নানা দাবি উঠবেই। আওয়ামী লীগ সরকার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ-উজ্জ্বল ভাবমূর্তি নিয়ে আছে। সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, পুলিশ-র্যাব, বিচার বিভাগ, বুদ্ধিজীবী- সবই সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত আছে। এ অবস্থায় সরকারের সাফল্য স্বাভাবিক। এ অবস্থায় সরকার যদি শক্তি প্রয়োগ, গুণ্ডা-বদমাশ, লোভ ও ভয় দেখানো, আতঙ্ক সৃষ্টি ইত্যাদি দ্বারা উদ্দেশ্য সাধন করতে চায়, তাহলে তা সম্পূর্ণ ভুল হবে। আমরা চাই, সরকার শুভবুদ্ধির পরিচয় দিক। অশুভবুদ্ধি আর ৎবরমহ ড়ভ ঃবৎৎড়ৎ  সৃষ্টি দ্বারা যে বিজয়, তা কি প্রকৃত বিজয়। আমরা চাই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উন্নত রাজনৈতিক চরিত্র।

ছাত্রছাত্রীদের যে তিনটি আন্দোলনের কথা আমি উল্লেখ করলাম তার প্রতিটিই সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত বলে আমার ধারণা। বিবেকবান চিন্তাশীল সকলকে বিষয়টি ভেবে দেখার ও স্পষ্ট মত ব্যক্ত করার জন্য অনুরোধ জানাই।

 

আ বু ল  কা সে ম  ফ জ লু ল  হ ক

লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads