• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

নিরাপদ সড়ক কতদূর

  • প্রকাশিত ০৭ আগস্ট ২০১৮

আমাদের সামনে যখনই কোনো সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দেয়, তখনই আমরা আইনের তীব্র আকালের মধ্যে পড়ে যাই। ভাবখানা এ রকম যে, আইনের অভাবেই আইনের শাসন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সুশৃঙ্খল আন্দোলনের মুখেও আমরা সেই পুরনো অভাবটাই বোধ করছি। সরকারের পক্ষ থেকে বার বারই এই বলে আশ্বস্ত করা হচ্ছে যে, সড়কপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন আইন হচ্ছে। এই আইন পাস হয়ে গেলে সড়ক নিরাপত্তার পথে কোনো বাধা থাকবে না। তবে আইন পাস করার ব্যাপারটি কিছুটা সময়সাপেক্ষ। সে পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করা কর্তব্য। দেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং প্রবীণ রাজনীতিক বলেছেন, জরুরিভিত্তিতে পার্লামেন্ট ডেকে আইনটি পাস করিয়ে নেওয়া উচিত। এতে মনে হতেই পারে যে, প্রস্তাবিত আইনটি পাস হতে না পারার কারণেই সড়কপথে দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে বেশুমার। সেই কারণেই যত অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা।

পক্ষান্তরে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বলেছেন, সড়কপথে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন আইন জরুরি নয়। আইন যা আছে তার যথাযথ প্রয়োগ হলেই যথেষ্ট। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন আইনের প্রয়োজন আছে কি নেই, সেই তক্কে আমাদের মতো প্রান্তজন, যাদের স্পেশালাইজড কোনো জ্ঞান নেই, তাদের প্রবেশ করা বোধহয় সমীচীন নয়। আজকালকার রাজনৈতিক সুশীল সমাজ তো সবকিছুতেই স্পেশালাইজেশন খোঁজেন। বুড়ো আঙুলের নখ ব্যথা করলেও স্পেশালিস্টের অভাব বোধ করেন তারা। তবে খুব আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের স্কুল-কলেজের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এবার দেখিয়ে দিয়েছে, শুধু কমনসেন্স দিয়ে কী করে রাজপথে বুড়োদের ননসেন্স বিহেভিয়ার রুখে দেওয়া যায়। অন্তত গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তারা দেখিয়ে দেওয়ার এই কাজটি সুশৃঙ্খলভাবে করতে পেরেছে। কিশোরদের নিয়ম-শৃঙ্খলা দেখে সবাই মুগ্ধ, বাহবা দিয়েছেন। এমনকি পুলিশের বড় কর্তারাও বলেছেন যে, বাচ্চারা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কী করতে হবে। আমরা যা করতে পারিনি, ওরা তা করে দেখিয়েছে। রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, টেলিভিশন টকার— সবাই বলেছেন একই কথা। অথচ রাজপথে নামার আগে এই বিক্ষুব্ধ ছেলেমেয়েরা নতুন কোনো আইন বানিয়ে নিয়ে আসেনি, পথে নেমে পুরনো আইনও ভেঙে দেয়নি। বরং বহাল আইনের মধ্যে থেকেই তারা আইন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে।

বেপরোয়া বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের কোমলমতি দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক জীবনাবসানের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষুব্ধ ছেলেমেয়েরা কয়েকটি বাস ভাঙচুর করলেও পরে তারা এই কাজ আর করেনি। এতদসত্ত্বেও পরিবহন মালিক সমিতি ও বেপরোয়া শ্রমিকরা অঘোষিত ধর্মঘট শুরু করে দিল। তারা বাচ্চাদের ভালো কাজকে চ্যালেঞ্জ করল। তারা যুক্তি দেখাতে লাগল যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তারা গাড়ি চালাবেন না। পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সুপরিচিত নেতা বললেন যে, এটা কোনো ধর্মঘট নয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই দুয়েক দিনের মধ্যে গাড়ি চলবে। এমনকি সড়ক ও সেতুমন্ত্রীও বললেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা ভয়ে গাড়ি নামাচ্ছেন না। তাদের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, অঘোষিত এই ধর্মঘটকে তারা যৌক্তিক মনে করেন। সেটা তারা করতেই পারেন। মন তাদের, মনে করার স্বাধীনতাও তাদের রয়েছে বৈকি! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ভয়টা কিসের? পথে নামলে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে হবে, ফিটনেস সার্টিফিকেট দেখাতে হবে, অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা যাবে না, যেমন খুশি ভাড়া আদায় করা যাবে না— এই সব ভয়!

পরিবহনের নেতারা বলছেন, চার শ’ বাস ভাঙচুর করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বহু মূল্যবান গাড়ি তারা পথে নামাবেন কেমন করে! কোমলমতি ছেলেমেয়েরা এই কয়েক দিনে কোথায় চার শ’ বাস ভাঙচুর করেছে বা আদৌ এই কাজ বাচ্চারা করেছে কি না- সে প্রশ্ন কেউ করেনি। তার কোনো অনুসন্ধানও হয়নি। মুখে বলা কথা এটি। আসল কথা হলো, তারা নিয়ম-শৃঙ্খলার দাবি অগ্রাহ্য করতে চান। যারা এই দাবি করে, তাদেরই উলটো কাঠগড়ায় তুলতে চান।

আমরা বলতে শুরু করেছিলাম আইন প্রসঙ্গে। সরকার নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য আরো কঠোর একটি আইনের প্রয়োজন বোধ করছে। মন্ত্রিসভায় আইনটি ইতোমধ্যে অনুমোদিতও হয়ে যাওয়ার কথা। তা হোক। এতে যদি সড়ক নিরাপত্তার উন্নতি হয়, তাহলে তো খুবই ভালো কথা। তারপরও আইন প্রসঙ্গে যদি এখানে আমরা কিছু সাধারণ আলোচনা করি, তাহলে সেটা মনে হয় না অন্যায় হবে। আইনের শাসন আর আইনাধিক্য— দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান বিস্তর। আইনের শাসন হচ্ছে প্রায়োগিক এবং চর্চার বিষয়। আইন প্রয়োগ ও আইন মানা— এই দুই দিকের যোগফল হচ্ছে আইনের শাসন। পক্ষান্তরে লিখিত আইন এবং এর আধিক্য নেহায়েতই পুঁথিগত বিষয়। পুঁথির বাইরে এনে আইন প্রয়োগ ও তার চর্চা করা না হলে সেটি জড়বস্তু বৈ কিছু নয়। আইনের ভালো ও মন্দ সম্পর্কে দর্শন, নীতিশাস্ত্র ও রাষ্ট্রবিদ্যার জ্ঞানভান্ডারে নানাবিধ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে। ইংরেজিতে একটি প্রবচন রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, দুনিয়ার কারাগারগুলো তৈরি হয়েছে আইনের পাথর দিয়ে। আসলে আইন দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা যেমন নিশ্চিত করা যায় তেমনই রাষ্ট্রকে কারাগার বানিয়ে ফেলা যায়। বিষয়টি নির্ভর করে আইনের প্রকৃতি ও প্রায়োগিক তারতম্যের ওপর। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমন কথাও বলেছেন যে, যতবেশি আইন, ততবেশি অবিচার। আবার দেশের স্বীকৃত আইন জীবন দিয়ে হলেও মেনে চলার শিক্ষা দিয়ে গেছেন মহামতি সক্রেটিস। সক্রেটিসকে যখন হেমলক পানে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেওয়া হলো, তখন তাকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে তিনি কিছুতেই সম্মত হননি। কেননা, তিনি বিশ্বাস করতেন, যে আইন বলে তাকে বিষপানে মৃত্যুর বিধান দেওয়া হয়েছে, সেই আইন জনগণ কর্তৃক স্বীকৃত। তা না হলে জনসাধারণ প্রতিবাদ করতেন। কাজেই জীবন গেলেও আইন মানতে হবে। এই যে মান্য করার বিষয়টি, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমাজে সবাই সক্রেটিস নয়। যখন না মানার সুযোগ থাকে তখন একশ্রেণির লোক সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে- এটাই স্বাভাবিক। এই জায়গাটাতেই আসে প্রয়োগের বিষয়টি। সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করা না হলে সাদা আইনটিই হয়ে যেতে পারে কালো আইন। কমবেশি এই সমস্যাটি আমাদের দেশে আছে।

আইনের কিতাবে কোনো অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান লেখা থাকলেই সেই অপরাধটি সমাজে কমে যাবে, এমন কোনো কথা নেই। আমাদের আইনের বইয়ে নারী নির্যাতনের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তাই বলে কি নারী নির্যাতন কমেছে? খুনের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে। সেই ভয়ে খুনিরা খুনখারাবি থেকে বিরত রয়েছে? এও চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে নাকি! আবার বলি, আসল জায়গাটি হচ্ছে আইনের স্বচ্ছতম প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

আমাদের দেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নতুন আইনের আগে থেকে যে আইনগুলো আছে, সে সবের সঠিক প্রয়োগ হলে বিশৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে না বলে মনে করেন বিবেকবানরা। শৃঙ্খলা নিশ্চিত হলে দুর্ঘটনা এমনিতেই কমে আসবে। প্রসঙ্গত এখানে গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলার কয়েকটি নমুনা তুলে ধরা যেতে পারে। এখানে বেশিরভাগ বাসের ফিটনেস নেই। যখন-তখন ব্রেক ফেইল করে, চাকা ব্লাস্ট হয়ে যায়, গিয়ার পড়ে না, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়, গরম হয়ে যায়, জানালার কাচ ভাঙা, আসনগুলো যাচ্ছেতাই। বাস স্টপের কোনো সুনির্দিষ্ট স্থান নেই, ভাড়ার কোনো নিয়মনীতি নেই, পাল্লা দিয়ে বাস চলে, দ্বিগণ-তিন গুণ যাত্রী বহন করা হয়। ট্রাফিকে ধরলে কন্ডাকটর দৌড়ে গিয়ে রফা করে আসে, যাত্রীরা কিছুই বুঝতে পারেন না। যাত্রী বা পথচারী মারা না গেলে বা বড় কোনো দুর্ঘটনা না হওয়া পর্যন্ত কোনো হইচই হয় না। তবে ভাড়া নিয়ে বাসের ভেতরে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে যাত্রী ও কন্ডাকটর বচসা হয়, কখনো কখনো হাতাহাতি। এই তো চলছে।

এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সবার আগে বাসের মালিকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পরিবহন শ্রমিকদেরও জানতে দিতে হবে যে, তারা নিজেরাও ইউনিয়ন ও মালিকদের শোষণের শিকার। তাদেরই ক্রীড়নক হিসেবে শ্রমিকরা ব্যবহূত হচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, রাজধানী এবং সন্নিহিত মহানগরে বিভিন্ন রুটে বিভিন্ন নামে পরিবহন কোম্পানির বাস চলতে দেখা যায়। এগুলো নামে কোম্পানি হলেও আসলে একেকটি সিন্ডিকেট। এসব কোম্পানির প্রত্যেকটি বাসের মালিক আলাদা আলাদা ব্যক্তি। একটি অভিন্ন নামে বাসগুলো চালানো হয় মাত্র। সব বাসই চলে ঠিকাদারি পদ্ধতিতে, ঠিক যে ব্যবস্থায় চলে রিকশা ও সিনজি অটোরিকশা। বাসের মালিক প্রতি ট্রিপে নির্দিষ্ট হারে ভাড়া আদায় করেন ড্রাইভার ও কন্ডাকটরের কাছ থেকে। ড্রাইভার ও হেলপারের নিয়মমাফিক কোনো বেতন নেই। এরা যতবেশি যাত্রী বহন করে যতবেশি আয় করতে পারে ততই তাদের লাভ। নিয়মানুযায়ী যাত্রী বহন করতে গেলে ড্রাইভারের পকেট থেকে টাকা দিতে হয় মালিককে। কাজেই ওরা পেটের দায়ে যতবেশি সম্ভব যাত্রী বহন করে। শরীর না কুলালেও ট্রিপ মারে। ফলে গাড়ি চালায় যাচ্ছেতাইভাবে। এক্ষেত্রে মালিকদের কোনো জবাবদিহিতা নেই।

অনেক অনিয়মের মধ্যে এটি একটি বড় অনিয়ম। এই অনিয়মটা দূর করা গেলে অনেকটাই শৃঙ্খলা ফিরে আসতে পারে। পরিবহন কোম্পানিগুলোকে যথার্থই কোম্পানি হতে হবে। ড্রাইভার এবং অন্যান্য পরিবহন শ্রমিক-কর্মচারীরা দেশের বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী কোম্পানির চাকরি করবেন। ন্যূনতম বেতন-ভাতা পাবেন। ড্রাইভারের চাকরিতে কোনো অদক্ষ লোক নিয়োগ হলে তার দায়দায়িত্ব কোম্পানি বহন করবে, কোম্পানিকে জবাবদিহি করতে হবে। অন্য যেকোনো অনিয়মের জন্য কোম্পানিই দায়ী হবে। এই বিষয়টি নিশ্চিত করা হলে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার পথে বিরাজমান সমস্যাগুলোর অনেক কিছুই সমাধান হয়ে যেতে পারে। আরো অনেক সমস্যা আছে। সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। রোগ নির্ণয় করে নিরাময়ের জন্য ঠিক ওষুধটি দিতে হবে, তাহলেই রোগমুক্ত হতে পারে আমাদের কাহিল গণপরিবহন ব্যবস্থা।

 

 ফা ই জু স  সা লে হী ন

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সিনিয়র সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads