• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
কর্মরত শিক্ষকদের জন্য বিসিএস

এই অস্থিতিশীল পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন করে

মতামত

কর্মরত শিক্ষকদের জন্য বিসিএস

  • প্রকাশিত ০৯ আগস্ট ২০১৮

বাংলাদেশে সবচেয়ে বৃহত্তম পেশা হলো শিক্ষকতা পেশা। যাকে সবচেয়ে সম্মানজনক পেশা হিসেবেও মনে করা হয়। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে সরকারের স্বচ্ছ বা নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকায় এ পেশাটি সর্ববৃহৎ ও খামখেয়ালী পেশায় রূপান্তরিত হয়েছে। আবার এদের বেতন-ভাতায় অসঙ্গতি থাকায় এরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত। এখানে কেউ সরকারি তথা বিসিএস দিয়ে নিয়োগ পাওয়া, কেউ আবার এমপিওভুক্ত, কেউ নন-এমপিওভুক্ত, আবার কেউ কেউ বিভিন্ন ব্যক্তি কিংবা সংস্থা, কোম্পানি, ট্রাস্ট, কিংবা প্রতিষ্ঠানের অধীনে পরিচালিত হচ্ছেন। ফলে বিভিন্ন সংগঠনের উৎপত্তি হয়েছে আর এসব সংগঠন সরকারের কাছে একেক সময় একেক দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের বিভিন্ন দাবিনামা নিয়ে রাজপথে বিক্ষোভ-সমাবেশ, অনশন, ঘেরাও কর্মসূচি লক্ষ করা গেছে। এদের একটি সংগঠন চাচ্ছে- সদ্য আত্তীকরণ হওয়া কলেজগুলোর শিক্ষকরা ক্যাডারভুক্ত হোক, আবার বিসিএস শিক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে স্লোগান জারি করা হয়েছে ‘নো বিসিএস নো ক্যাডার’। অর্থাৎ তারা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আত্তীকৃত কলেজ শিক্ষকদের তাদের সমপর্যায়ে নিতে চায় না। আরেকটি গ্রুপ চাচ্ছে- বিদ্যমান সব এমপিওভুক্ত কলেজকে জাতীয়করণ করা হোক। অন্য আরেকটি দলের চাওয়া- নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে এমপিওভুক্ত করা হোক। অন্যদিকে ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষক সংগঠনগুলো চাচ্ছে তাদেরকে সরকারি প্রাথমিক স্কুলের ন্যায় সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক। আবার অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানকারী সব শিক্ষকই বর্তমানে নন-এমপিও, তারাও চাচ্ছে- তাদের সব শিক্ষককে এমপিওভুক্তির আওতায় নিয়ে আসা হোক। সবশেষ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়া তৃতীয় শিক্ষকরা কলেজেই যেতে পারছেন না, অন্য শিক্ষকরা তাদের শিক্ষক হিসেবে মনে করেন না বলে অর্থাৎ তাদের প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকার থেকে কোনো ভাতা না পাওয়ায় তারাও সরকারের কাছে এর প্রতিকার চান। এখান থেকেই ধারণা পাওয়া যায় যে, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় কী ধরনের অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা কিংবা অরাজকতা বিরাজ করছে। এই বিশৃঙ্খলা কিংবা অস্থিতিশীল পরিবেশের মূলে রয়েছে আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা। মূলত সরকারের শিক্ষা নিয়ে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় বিষয়টি আজকের পর্যায়ে এসে গেছে।

এই অস্থিতিশীল পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন করে। সেখানে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল গঠন করার প্রস্তাবনা দিয়ে এ অস্থিতিশীল পরিবেশের সাময়িক সমাধানের চেষ্টা করা হয় কিন্তু বিসিএস ক্যাডারদের আপত্তিতে এটা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তাদের যুক্তি- বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা সরকারি চাকরিজীবীদের মতোই যখন যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে তখন সেই আলোকে তারাও তা গ্রহণ করবেন। এখানে শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল করা হলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সঙ্গে বিসিএস শিক্ষকরা একীভূত হতে চান না। সরকার পরে শিক্ষার মান উন্নয়নে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কম খরচে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগের লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে সরকারি স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এতে প্রায় ২৮৫টি কলেজকে জাতীয়করণের জন্য মনোনীতও করা হয়। নিয়ম অনুসারে জাতীয়কৃত এসব কলেজের শিক্ষকরা শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সরকারি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার সমিতি। তাদের দাবি- দেশে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি কলেজ রয়েছে, কিন্তু সরকার ঘোষিত ২৮৫টি কলেজকে জাতীয়করণ করা হলে তাতে শুধুমাত্র ৫-৭ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপকৃত হবেন। আর শুধুমাত্র ৫-৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে এলে কী ধরনের ফল আসবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সর্বমহলে। প্রশ্ন উঠেছে সরকার জাতীয়করণের জন্য যে তালিকা প্রণয়ন করেছে তা নিয়ে, কোনো নীতিমালা কিংবা নির্দিষ্ট কোনো যোগ্যতা ছাড়াই শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় কলেজগুলোকে জাতীয়করণের জন্য মনোনীত করায় তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। তাদের অভিযোগ- একই যোগ্যতায়, একই মানদণ্ডে প্রত্যেক কলেজে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও কেন শুধু উপজেলা সদরে অবস্থানের কারণে এসব কলেজ জাতীয়করণ করা হচ্ছে? এর দ্বারা কি সমতা, ন্যায্যতা কিংবা নৈতিকতার ন্যায্যতার বিরুদ্ধে অবস্থান হলো না? এমন তো রয়েছে, যেসব কলেজকে জাতীয়করণ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশ শিক্ষক ক্যাডার কিংবা নন-ক্যাডার হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা রাখেন না।

বিসিএস শিক্ষক সমিতি ইতোমধ্যে ‘নো বিসিএস নো ক্যাডার’ স্লোগান তুলেছে। মর্যাদার স্বার্থে তাদের সেই স্লোগান অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। সরকার নীতিমালা ছাড়া শুধু উপজেলা সদরের অবস্থানকে চিহ্নিত করে জাতীয়করণের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে করে অযোগ্য শিক্ষকরা বিসিএস শিক্ষা সমিতিতে ঢুকে পড়লে পরবর্তীকালে বিভিন্ন অপেশাদারি ও বিব্রতকর কার্যক্রম চোখে পড়তে পারে, তাই বিসিএস শিক্ষা সমিতি এদেরকে ক্যাডারভুক্ত না করে নন-ক্যাডার হিসেবে ঘোষণা করার জোর দাবি জানাচ্ছে। অন্যদিকে আত্তীকৃত কলেজগুলোতে বিসিএসের মাধ্যমে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কথা সংসদে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আবার এসব জাতীয়কৃত কলেজের শিক্ষকরা বদলির সুযোগ পাবেন না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং জাতীয়করণ বিষয়টি নিয়েই চারটি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে- এক. বিসিএস শিক্ষা সমিতির স্লোগান। দুই. আত্তীকৃত শিক্ষকরা ক্যাডারভুক্ত হওয়ার বিভিন্ন যুক্তি। তিন. একই প্রতিষ্ঠানে বদলির সুযোগ পাওয়া না-পাওয়ার বৈষম্য ও ক্যাডার, নন- ক্যাডার সমস্যা। চার. জাতীয়করণের জন্য মনোনীত না হওয়া দেশের ৯৫ শতাংশ শিক্ষকদের দাবি সমগ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আন্দোলন।

উপরোক্ত চারটি সমস্যা সমাধানের জন্য একটি বিসিএস-ই যথেষ্ট। যার নাম হতে পারে বিসিএস ফর একজিসটেন্স টিচার, অর্থাৎ বিদ্যমান শিক্ষকদের জন্য বিসিএস। ফলে সবাইকে একই বৃত্তে এনে সমতা সৃষ্টি করতে, জাতীয়করণ নিয়ে তৃণমূলে ক্ষোভ প্রশমনে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আন্দোলন প্রশমিত করতে এবং সর্বোপরি ‘নো বিসিএস নো ক্যাডার’ স্লোগানকে জয় করতে হলে দেশের বিভিন্ন কলেজে কর্মরত শিক্ষকদের নিয়ে একটি বিসিএসের আয়োজন করাই যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করছি। এর মাধ্যমেই সব সঙ্কট দূর করা সম্ভব। এই প্রস্তাবনাটি সংশ্লিষ্টজনদের ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।

 

শরীফুর রহমান আদিল

শিক্ষক ও গবেষক, রিসার্চ বাংলাদেশ ৭১

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads