‘নদীর ধারে বাস/ভাবনা বারো মাস’- এ রকম একটি প্রবচন প্রচলিত আছে। আমার বাড়ি এ রকম জেলায় (চুয়াডাঙ্গা) না হওয়ায় বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন স্টেশনে পদায়ন এবং ভ্রমণপিয়াসী হওয়ায় কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। প্রায় দুই বছর লালমনিরহাটে থেকে দেখছি তিস্তাপারের মানুষের হাহাকার। আজ আবাস আছে তো কাল নেই হয়ে যায়। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাটসহ এসব এলাকার মানুষের কাছে শুনি তাদের করুণ পরিণতি। গাইবান্ধার অবস্থা সবচেয়ে করুণ। বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৫৪টি নদী আছে। এর মধ্যে প্রধান নদীগুলো হলো পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ও ব্রহ্মপুত্র। এ নদগুলোই সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার হচ্ছে। দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী যমুনা। এ ছাড়া তিস্তা, ধরলা, আত্রাই, কুশিয়ারা, খোয়াই, সুরমা, সাঙ্গু, গোমতী, মাতা মুহুরী, মধুমতী, বিশখালী ইত্যাদি নদীও ভাঙনপ্রবণ। নদীভাঙন এ দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে যেকোনো দুর্যোগের চেয়ে বেশি মাত্রায় ধ্বংস করছে। নদীভাঙনকে অনেকে বলে থাকেন, ‘Slow and Silent killer-Disaster।’ কিন্তু এই নিয়ে আলোচনা, লেখালেখি বা চিন্তাভাবনা খুব কম।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এদের বেশিরভাগই আশ্রয়হীন পরিবার। এরা বিচ্ছিন্ন হয়ে শহর অভিমুখে ছুটছে। সত্তর ও আশির দশক থেকে এ দেশে নদীভাঙনের তীব্রতা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে ক্ষয়ক্ষতি। প্রতিবছর বাংলাদেশে গড়ে আট হাজার সাতশ’ হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়। যার বেশিরভাগ কৃষিজমি। ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধেক লোকেরই টাকার অভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করা সম্ভব হয় না। তারা হয় গৃহহীন-ছিন্নমূল। এরা সাধারণত বাঁধ, রাস্তা, পরিত্যক্ত রেলসড়ক, খাসচর, খাসজমিতে অবস্থান নেয়। অনেকেই আবার কাজের খোঁজে আসে শহরে। নদীভাঙনের কারণে বেড়ে যাচ্ছে সামাজিক ও পারিবারিক সঙ্কট, বাড়ছে বেকারত্ব। উন্নয়ন অন্বেষণের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ভূমিহীনদের ৫০ শতাংশই নদীভাঙনের শিকার। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নদীভাঙনের কারণে এক ব্যক্তির জীবনে গড়ে ২২ বার ঠিকানা বদল করতে হয়।
পলিমাটি বেষ্টিত গঠন বাংলাদেশের নদীভাঙনের মূল কারণ। বর্ষাকালে নদীর প্রবাহের বিস্তৃতি অনেক বেশি থাকে। বর্ষা শেষে নদীর স্রোত ও পরিধি অনেক কমে যায়। এতে দুকূলে ভাঙন হয়। অনেক স্থানে নদীর দুকূলে স্থাপনা থাকে। এতে নদীর গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে নদী পাড়ে শক্তভাবে বাঁধ দেওয়া হয় না। নদীপথ শেষের দিকে স্রোতের বেগ কম থাকে, কিন্তু বর্ষাকালে নদীর দুকূল স্রোতের জলে নরম হয়ে যায়। পরে সেখানে ভাঙন সৃষ্টি হয়। অনেক সময় দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নদী শাসন বা সরকারি/বেসরকারি বরাদ্দের যথাযথ ব্যবহার হয় না। তাই নদীর শাসন কাজে ফাঁকফোকর থেকে যায়।
নদীভাঙনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী, যা সমাজ জীবনের ওপর প্রভাব পড়ছে। এর ফলে গতকালের আমির আজ ফকির ও আশ্রয়হীন হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে বেকারত্ব ও দারিদ্য। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ অভাবের তাড়নায় কিংবা অন্যের চাপের মুখে অবশিষ্ট জমিজমা, গবাদিপশু এবং মূল্যবান সামগ্রী হাতছাড়া করে ফেলে। অনেক পরিবার অতিমাত্রায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় পড়ছে। খাবার পানি ও পয়ঃপরিচ্ছন্নতার তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়। নারীদের ব্যক্তিগত বা দৈহিক নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয় এবং নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। বহুসংখ্যক লোক কর্মসংস্থান লাভের বা বেঁচে থাকার আশায় এলাকা ত্যাগ করে শহর বা অন্য কোনো স্থানে অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হয়ে চলে যায়। অনেকে বস্তিতে বসাবাস করছে। বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিচ্ছে। অনেক স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। বাস্তচ্যুত হওয়ার কারণে পড়াশোনার বিঘ্ন ঘটে। অনেকের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। শত শত বা হাজার হাজার মানুষ বাঁধ বা শহরের বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিশুরা বাঁধ বা বস্তির জীবনে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। দারিদ্য ব্যাপকভাবে পুষ্টিহীনতার প্রসার ঘটায়। শিশুশ্রম ও শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সামাজিক অবস্থানের চরম অবনতি ঘটে। বিবাহ বিচ্ছেদ, স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক পরিবারপরিজন ত্যাগ, বহু বিবাহ ইত্যাদি নেতিবাচক ঘটনা বৃদ্ধি পায়। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহমর্মিতা শিথিল হয়ে পড়ে। নদীতে ভেঙে যাওয়া জমি জেগে উঠলে তা দখলের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়, কোন্দল-মামলা বাড়ে। অনেক ক্ষেত্রে রক্তপাত হয়। সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে অনেকে।
ছোট আকারের নদীগুলোর ভাঙন ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ কিছুটা সক্ষম হলেও, প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি বরাদ্দের অভাবে বড় নদীর ক্ষেত্রে উদ্যোগগুলো তেমন সফল হচ্ছে না। এ ব্যাপারে আমরা সমন্বিত পরিকল্পনা করে স্বল্প বরাদ্দের সদ্ব্যবহার করতে পারি। দুয়েকটি করে পর্যায়ক্রমে বড় প্রকল্প গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে পারি।
বাংলাদেশের মোট আয়তনের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই প্রধান তিনটি নদ-নদী অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত। প্রধান তিন নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা ছাড়াও নদীবিধৌত বাংলাদেশের ছোট বড় নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় তিনশ’। এসব নদ-নদীর তটরেখা যার দৈর্ঘ্য হচ্ছে প্রায় চব্বিশ হাজার চৌদ্দ কিলোমিটার। এর মধ্যে কমপক্ষে প্রায় বার হাজার কিলোমিটার তটরেখা নদী ভাঙনপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তাই এ দেশের নদীভাঙন একটি অতি প্রাচীন ও ভয়াবহ সমস্যা। বর্ষাকাল জুড়েই চলতে থাকে ভাঙনের তাণ্ডবলীলা। বর্ষা শেষে ভাঙনের প্রকোপ কিছুটা কমলেও বছরজুড়ে তা কমবেশি মাত্রায় চলতে থাকে। এসব এলাকায় সরকারের নজর আছে। তবে আরো বরাদ্দ বেশি দেওয়া যেতে পারে। বিদেশি অনেক সাহায্য সংস্থা অপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে। দেশি অনেক সংস্থাও এ রকম করে। সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে নদীভাঙন ও পরবর্তী ব্যবস্থাপনা করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। এতে সুষ্ঠু-বণ্টন হতে সহয়তা করবে। নদীতে চর জেগে উঠলে ভাঙনের শিকার বা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সেসব চরের ভূমি সুষম বণ্টন করা দরকার।
আবু আফজাল মোহা. সালেহ
উপপরিচালক, বিআরডিবি, লালমনিরহাট