• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
শিশুরা যা শেখাল আমাদের

শিশুরা যা শেখাল আমাদের

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

শিশুরা যা শেখাল আমাদের

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ১১ আগস্ট ২০১৮

পাঁচ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টা। হেঁটেই আসছিলাম অফিসের দিকে। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘটের ফলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সবাইকে পড়তে হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে। বাস, মিনিবাস, ট্রাক, টেম্পো, লেগুনা সব বন্ধ। নগরবাসীর যাতায়াতের ভরসা স্কুটার আর রিকশা। রাজধানীতে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই যেখানে একটি স্কুটার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, সেখানে এই সঙ্কটকালে তা পাওয়া তো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। আর সুযোগ বুঝে রিকশাওয়ালারাও যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া। এ জন্য অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা তো এমনই। যে যখন যতটুকু সুযোগ পাই, তার ব্যবহার-অপব্যবহার করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করি।

যাহোক, তাই পদ যুগলকে ভরসা করেই গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হওয়া। উত্তর শাহজাহানপুর থেকে হেঁটে রাজারবাগ চৌরাস্তা (শান্তিনগর যাওয়ার রাস্তার মোড়) পার হচ্ছিলাম। অল্প বয়সী একটি নারী পুলিশ সামনে এসে বলল, ‘প্লিজ, জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হোন।’ রাস্তার মাঝখানের আইল্যান্ডের ওপর দাঁড়ানো আরেক পুলিশ কর্মকর্তা। স্মিত হেসে তিনি বললেন, ‘শুধু আপনি একা হলে হবে না। অন্যদেরও বলবেন নিয়ম মেনে পথ চলতে।’ ধন্যবাদ দিয়ে তাকে বললাম, ‘আগে তো কখনো আপনারা এভাবে বলেননি! আজ কেন বলছেন? যে যার মতো আইন ভেঙে রাস্তায় চলে, গাড়ি, মোটরসাইকেল, রিকশা রং সাইড দিয়ে যায়। কই, আপনাদের তো কোনো অ্যাকশনে যেতে দেখা যায়নি!’ পুলিশ অফিসার একটু লজ্জা পেলেন মনে হলো। বললেন, ‘আসলে কী বলব ভাই, শিশুরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।’ তাকে বললাম, ‘ঠিক বলেছেন। গতকাল আপনাদের কমিশনার সাহেবও এ কথাই বলেছেন। শুনেছেন তো নিশ্চয়ই।’ মাথা নেড়ে জানালেন যে, তিনি তাদের বসের বক্তব্য সম্পর্কে অবগত। আমি তাকে আরো বললাম, ‘শিশুরা শুধু আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে তাই নয়, অবমুক্ত করে দিয়েছে আমাদের বিবেকের বন্ধ অর্গল। তবে ওরা যদি আরেকটি কাজ করে, তাহলে এ জাতি আরো উপকৃত হবে।’ কোন কাজটি? জিজ্ঞেস করলেন পুলিশ কর্মকর্তা। বললাম, ‘রাস্তায় ঘুষ লেনদেন বন্ধ করার আন্দোলন। যানবাহনের ড্রাইভার-হেলপারদের কাছ থেকে কিছু সংখ্যক পুলিশ যেভাবে টাকা-পয়সা নেয়, তার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য ওরা যদি আরেকবার রাস্তায় নামে, আমার বিশ্বাস প্রতিটি মানুষ তাতে সমর্থন জানাবে।’ পুলিশ কর্মকর্তা এবার আর কিছু বললেন না। আমিও কথা না বাড়িয়ে নিজ গন্তব্যের পথে পা বাড়ালাম। বাস্তবিকই, গত ২৯ জুলাই থেকে ৯ দিন শিশুরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে আন্দোলন করেছে, তা আমাদের দেশ তো বটেই, বিশ্বে এক নজিরবিহীন ঘটনা। কোনো সংগঠন এবং নেতা ছাড়া এমন জনসমর্থিত ও  জনসম্পৃক্ত সফল আন্দোলনের নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। আন্দোলনটিকে সফল বলছি এজন্য যে, সড়ককে নিরাপদ করতে যেসব অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা দূর করা দরকার, সেগুলো ওরা আমাদের একরকম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

প্রিয় সহপাঠীদের গাড়িচাপা দিয়ে হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল ওরা। কিন্তু সে প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় আন্দোলনে। আর সে আন্দোলন অতি দ্রুত রাজধানীর গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। একই সময়ে শিক্ষার্থীদের সে আন্দোলন দেশের দলমত নির্বিশেষে সবার সমর্থন অর্জন করে। এর প্রধান কারণ দুটি। এক. ওদের আন্দোলন ছিল অহিংস। দুই. ওরা যেসব দাবি সরকারের কাছে উত্থাপন করেছে, তা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট। প্রথম দিকে ওরা একটু উত্তেজিত ছিল এবং তার ফলে বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওরা আন্দোলনকে অহিংস রূপ দিতে সক্ষম হয়। প্রতিবাদের পাশাপাশি ট্রাফিক আইন সম্বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে। চালকের অদক্ষতা, যানবাহনের ফিটনেসহীনতা এবং ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে চলাচলই যে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ, ওরা তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, দল বেঁধে ওরা রাস্তায় নেমে আসে ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে। ওরা ড্রাইভারের লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট, ইন্স্যুরেন্স পলিসি পরীক্ষা শুরু করে। এ এক অভিনব প্রতিবাদ! ওদের এ পরীক্ষার জালে ধরা পড়ে গণপরিবহনসহ ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকরাও। সমাজের অভিজাত শ্রেণির নামিদামি মানুষ, পুলিশ কর্মকর্তা, বিচারক, আইনজীবী, এমনকি প্রভাবশালী মন্ত্রীও আটকে যান ওদের অভিযানে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় পুলিশকে দিয়ে মামলা করানো, নিয়ম মেনে সঠিক লেনে গাড়ি চালাতে বাধ্য করেছে ওরা সবাইকে। এ এক ভিন্ন ধরনের আন্দোলন। কবির ভাষার অনুকরণে বলা যায়- ‘এমন আন্দোলন কখনো দেখেনি কেউ।’ রাজধানীর রাস্তায় দেখা গেছে এক অপরূপ দৃশ্য। স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরা, কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো প্রাণোচ্ছল শিশু-কিশোর-কিশোরীরা রাস্তায় পালন করছে ট্রাফিক শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব! কোনো জবরদস্তি নেই, নেই কোনো হিংসাত্মক ভূমিকা। আচরণ ছিল অত্যন্ত সংযত, ভদ্রজনোচিত। ওদের তৎপরতায় কেউ বিরক্ত হননি। বরং হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন ওইসব খুদে নির্দেশদাতার নির্দেশ।

ওরা বহন করেছে নানা ধরনের প্ল্যাকার্ড। সেগুলোর মধ্যে লেখা ছিল চমৎকার সব স্লোগান। পত্রিকার পাতা থেকে এখানে সেগুলোর কয়েকটি উল্লেখ করছি। ওদের প্রধান স্লোগানটি ছিল- ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ অর্থাৎ ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই।’ এ স্লোগানটি ওদের নিহত সহপাঠীদ্বয় হত্যার বিচারের দাবিতে উচ্চারিত হয়েছে ঠিক। তবে এটা রাষ্ট্র বা সমাজের সর্বস্তরে সব সময়ের জন্যই প্রযোজ্য। ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি যে আমাদের সমাজকে ক্রমশ অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সে সত্যকে তো অস্বীকার করা যাবে না। আরো যেসব স্লোগান মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো- ‘আমি তো পিচঢালা রাস্তা নই যে, তুমি আমার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেবে।’ কী অসাধারণ তাৎপর্যময় কথা! আমাদের দেশের অধিকাংশ বাস-ট্রাক চালকের মনোভাবই এ স্লোগানে ফুটে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো পথচারী দুর্ভাগ্যক্রমে বাস বা ট্রাকের নিচে পড়ে গেলে চালক গাড়ি না থামিয়ে তার দেহকে পিষ্ট করে নির্বিকারে চলে যায়! এটা যে কী নির্মমতা, বর্বরতা তা ভাষায় বর্ণনাতীত। স্লোগানগুলোর মধ্যে দুটো ছিল বেশ মজার। একটি ছিল-‘খুনিরা পাবে সাজা, বিচার হবে অপরাধীর হোক সে মন্ত্রী-রাজা।’ দ্বিতীয়টি ছিল-‘সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। দেশের মেরামত কাজ চলছে।’ হাস্যচ্ছলে এমন নির্মম সত্য উচ্চারণকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় কী? বিগত দিনের ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে এর মর্মার্থ কি অস্বীকার করা যাবে? প্রকৃতই শিশুরা তাদের প্রতিবাদ-আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ ও রাষ্ট্রের একটি অন্যতম অংশের মেরামত কাজের উদ্বোধন করে দিয়েছে। এখন সে মেরামত কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের কর্ণধারদের। শিশুদের হাতের আরো একটি প্ল্যাকার্ডের স্লোগানও ছিল বেশ তাৎপর্যময়। তাতে লেখা ছিল-‘চলো না বন্ধু হাতে হাত ধরি, একসাথে মোরা নতুন নিয়ম গড়ি।’ আমাদের দেশে এখন চলছে নিয়ম ভাঙা আর অনিয়ম করার জোয়ার। কেউ কেউ বলেন, এখানে এখন অনিয়ম করাটাই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সে অনিয়মকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন নিয়ম অর্থাৎ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে একাত্ম হতে সবাইকে আহ্বান জানিয়েছে এ স্লোগানের মাধ্যমে।

শিশুদের এসব স্লোগান, সর্বোপরি তাদের আন্দোলন আমাদের অনেক কিছু শেখাল। তারা দেখিয়ে দিল কীভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়। কীভাবে ভেঙে দিতে হয় অনিয়মের অচলায়তন। আর আজ তাই সবার মুখে তাদের প্রশংসা ধ্বনি। সমাজের বিশিষ্টজনরা তাদের জানাচ্ছেন অভিনন্দন। বাংলাদেশের খবরের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন তাই যথার্থই লিখেছেন, ‘আঠারো কোটি মানুষকে সাক্ষী রেখেছে তরুণরা। তারাই পারবে হাজারো অনিয়মকে নিয়মে ফেরাতে। গত এক সপ্তাহের আন্দোলন তারই প্রমাণ।’ (বাংলাদেশের খবর, ৬ আগস্ট, ২০১৮)।

শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এ আন্দোলনের কেউ বিরুদ্ধাচরণ করেননি। সরকার, বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দল শিশুদের দাবিসমূহকে যৌক্তিক বলে সমর্থন করেছে। তা ছাড়া এ আন্দোলনে দেশের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ছিল চোখে পড়ার মতো। আন্দোলন চলাকালীন রাজধানীতে পরিবহন সঙ্কট থেকে সৃষ্ট দুর্ভোগ নগরবাসীকে হাসিমুখেই মেনে নিতে দেখা গেছে। অভিভাবকদের ভূমিকা ছিল প্রচলিত ধারার একেবারে উল্টো। আমাদের দেশের অভিভাবকরা সাধারণত তাদের সন্তানদের রাজনীতি, আন্দোলন, মিছিল, মিটিং থেকে দূরে রাখতে চান। কিন্তু এবার আমরা দেখলাম ব্যতিক্রম চিত্র। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের রাস্তায় নামতে উৎসাহিত করেছেন। অনেক মা নিজেরা গিয়েছেন সন্তানদের সঙ্গে। ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত সন্তান ও তার সহপাঠী বন্ধুদের মুখে তুলে দিয়েছেন খাবার। শিশুদের এ আন্দোলনের প্রতি দেশবাসীর এই যে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন, এর কারণ কী? কারণ একটাই। ওরা এদেশের মানুষের বুকে জমে থাকা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কথা প্রকাশ্যে এনেছে। ওদের প্রতিবাদে প্রতিধ্বনিত হয়েছে এদেশের মানুষের মনের কথা। যে কথা আমরা সজোরে বলতে পারিনি, ওরা সে কথাই হাজারো কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে নির্ভয়ে, শঙ্কাহীন চিত্তে। দেশবাসী ওদের মধ্যে দেখতে পেয়েছে আশার আলো।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া গত ৪ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেছেন, ‘কোমলমতি শিশু তরুণরা যা করেছে তাকে স্যালুট জানাই। তারা পুলিশের নৈতিক ভিতকে জাগিয়ে তুলেছে, অনেক শক্তিশালী করেছে, চোখ-কান খুলে দিয়েছে। তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।’ ডিএমপি কমিশনারের এ বক্তব্য সঙ্গত কারণেই প্রশ্নের জন্ম দেয়- এতদিন কেন তাদের ‘নৈতিক ভিত’ ঘুমিয়ে ছিল, কেন তাদের চোখ-কান বন্ধ ছিল? এই কেন প্রশ্নের কারণ খুঁজতে গেলে অনেক কথা এসে যাবে। যা অনেকের কাছে কুইনানের মতো তেতো লাগতে পারে। শিশুদের আন্দোলন সফল হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে গত ৬ আগস্ট সড়ক পরিবহন আইনটি অবশেষে অনুমোদন হয়েছে।

এ মুহূর্তে কবি গোলাম মোস্তফার সেই বিখ্যাত কবিতাটির কথাই মনে পড়ছে-‘আমরা শিশু, আমরা নবীন নিখিল বন-নন্দনে/ ওষ্ঠে রাঙ্গা হাসির রেখা জীবন জাগে স্পন্দনে,/ লক্ষ আশা অন্তরে/ ঘুমিয়ে আছে মন্তরে/ ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ ঘুমিয়ে থাকা সেই শিশুর পিতাদের এ আন্দোলন আমাদের বিবেকের দরজায় সজোরেই কড়া নেড়েছে। সে কড়া নাড়ার শব্দে আমাদের বিবেক কতটা জাগ্রত হবে- সেটাই প্রশ্ন।

 

ম হি উ দ্দি ন  খা ন  মো হ ন

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads