• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
কয়লার মতো পাথরও উধাও!

কয়লার মতো পাথরও উধাও!

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

কয়লার মতো পাথরও উধাও!

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ১১ আগস্ট ২০১৮

দেশের উত্তরাঞ্চলের ভূসম্পদ বলতে পানিই অন্যতম। যে পানিকে ঘিরে সেচভিত্তিক চাষাবাদের বদৌলতে উত্তরাঞ্চল এখন খাদ্য ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত। এ অঞ্চলের উৎপাদিত ধান স্থানীয় চাহিদা পূরণের পর গোটা দেশের ভোক্তাদের মুখের আহার জোগান দিয়ে থাকে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় ভূগর্ভস্থ সম্পদ গ্যাস না থাকায় এ অঞ্চলে শিল্প-কলকারখানা তেমন গড়ে ওঠেনি। ংশুধু ধানকে ঘিরে এ অঞ্চলে গড়ে ওঠা কৃষিভিত্তিক চালকল শিল্পই মুখ্য। সে শিল্পটিও এখন রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে। একমাত্র স্বয়ংক্রিয় চালকলের গর্ভেই বিলীন হয়েছে হাসকিং চালকল শিল্প। আর উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়ায় কয়লা ও মধ্যপাড়ায় পাথরের খনিই একমাত্র ভূসম্পদ। ভূসম্পদ কয়লাকে ঘিরে দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বড়পুকুরিয়ায় স্থাপনের পর থেকে রংপুর বিভাগের ৮টি জেলার বিদ্যুতের মোট চাহিদার ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জোগান দিয়ে আসছে। চাহিদার বাকি ১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেশের অন্যত্র থেকে এনে ভোক্তাপর্যায়ে বিপণন করা হয়েছিল। মাত্র কয়েক দিন আগেই বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, খনির ইয়ার্ডে কয়লার মজুত শেষ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়েই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ একে একে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম তিনটি ইউনিটই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। সঙ্গত কারণেই রংপুর বিভাগের আট জেলায় বিদ্যুতের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যদিও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ আশা করছে, সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু করতে পারবে। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা তছরুফের প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে দুর্নীতি দমন কমিশনের তরফে তদন্ত কাজ অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে দুদক মন্তব্য করেছে, কয়লাখনিতে ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা মজুত থাকার কথা থাকলেও তা নেই। প্রাথমিক তদন্তে কমিশন দুর্নীতির আলামতও পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা দেখার জন্য আমাদেরকে কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

কয়লা কেলেঙ্কারির রেশ কাটতে না কাটতেই দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) প্রায় ৫৬ কোটি টাকা মূল্যের ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৮১৭ টন পাথরের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। মনে করা হচ্ছে, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির মতোই মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানিতেও বড় ধরনের তছরুফের ঘটনা ঘটেছে। যদিও মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি পরিমাপগত ত্রুটি, সিস্টেম লস বা পদ্ধতিগত লোকসান ও মাটির নিচে দেবে গেছে বলে দাবি করেছে।

সম্প্রতি কয়লা কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর এমজিএমসিএল তড়িঘড়ি করে গত ২৯ জুলাই বোর্ড মিটিংয়ে বিষয়টি উত্থাপন করে। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি তদন্তের জন্য পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) জাবেদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন সুবিধা হচ্ছে, ছোটখাটো ঘটনা থেকে বড় ধরনের যেকোনো ঘটনা ঘটলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এরপর কী হয়, তা জনগণের জানার বাইরেই থেকে যায়। নতুন কোনো ঘটনায় জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরে যায়। অথচ এমন এক সময় ছিল, যখন দুর্ঘটনা, অগ্নিসংযোগ, তছরুফ কিংবা জনস্বার্থ পরিপন্থি কোনো ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য দুস্তর মিটিং মিছিল পর্যন্ত করতে হতো। যাক সে কথা, এখানে স্পষ্ট মাত্র ২০০৬-২০০৭ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৫৬ কোটি টাকার পাথর সিস্টেম লস, পদ্ধতিগত পরিমাপের কারণ কিংবা দেবে যাওয়ার মতো ঘটনা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে খনি কর্তৃপক্ষের জনৈক কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, ২০০৬-২০০৭ থেকে ২০১২-২০১৩ অর্থবছর পর্যন্ত খনি বাস্তবায়নকারী উত্তর কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান নামনাম কর্তৃক উৎপাদনশীল পরিমাণগত ত্রুটি ও সিস্টেম লস দেখনো হয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার ২৩৩ টন। ২০১২-১৩ অর্থবছরের পর আর কোনো পরিমাপগত ত্রুটি ও সিস্টেম লস নেই। এরপরও বলা হচ্ছে, উত্তোলিত পাথর মাটির নিচে দেবে গেছে কিংবা মাটি খেয়ে ফেলেছে, যা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

 সূত্র মতে, ২০০৭ সালের ২৫ মে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত পাথরের উত্তোলন করা হয়েছে ৪২ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৫ টন। গত ২৯ জুলাই অনুষ্ঠিত এমজিএমসিএল বোর্ড মিটিংয়ে উত্থাপিত রিপোর্টে ২০০৬-২০০৭ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত পরিমাপগত ত্রুটি ও সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার ২৩৩ টন এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ১ লাখ ৬ হাজার ৪৬৮ টন পাথর খনি ইয়ার্ডে মাটির নিচে দেবে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ নিয়ে সর্বমোট ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৮১৬.৮৯ টন পাথরের মজুত বাবদ ৫৫ কোটি ২৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪৮ টাকা অবলোপন করার জন্য এমজিএমসিএল বোর্ড সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছে (সূত্র : দৈনিক বাংলাদেশের খবর, তারিখ ৬ আগস্ট ২০১৮)।

বাস্তবতা হচ্ছে, ‘কাজির গরু খাতায় আছে, গোয়ালে নেই’ অবস্থার মতো ঘটনা আমাদের দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় হরহামেশাই ঘটে, যা বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ও মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডে ঘটতে পারে। আর এটি অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। যেহুতু মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানিতে প্রায় ৩ লাখ ৫৯ হাজার টন পাথর উধাওয়ের অভিযোগ উঠেছে, সেহেতু আমরা মনে করি, মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানির সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদন্তই যথেষ্ট নয়, এক্ষেত্রে দুদকের তরফে তদন্ত কমিটির মাধ্যমে চুলচেরা তদন্ত করলে পুকুরচুরির ঘটনা উদ্ঘাটন হতে পারে।

মোদ্দাকথা, দেশপ্রেমই হচ্ছে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে বড় নিয়ামক। সে দায় থেকে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই যদি আন্তরিক হয়, তাহলে কোনো অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। কিন্তু আমাদের দেশে দুর্নীতিবাজদের শিকড় অনেক গভীরে। যে শিকর উপড়ে ফেলা বড় কঠিন। তবু অপরাধীর হাত যত লম্বাই হোক, দেশ ও জাতির স্বার্থে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হোক, এটাই আপামর জনগোষ্ঠীর একমাত্র প্রত্যাশা।

 

আবদুল হাই রঞ্জু

লেখক : সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads