• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
অমানবিক ‘আমি’

নির্মম সত্যের এমন কাহিনী এ দেশে হাজার হাজার

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

অমানবিক ‘আমি’

  • ওমর ফারুক শামীম
  • প্রকাশিত ১৩ আগস্ট ২০১৮

জানালার পাশে অপলক বসে আছেন ‘মা’। ৭০ বছরের দীর্ঘদৃষ্টি— আনন্দ-বেদনার শত কোলাহল চোখের জলে ছবি আঁকে। মমতায় ঘেরা ভালোবাসাগুলো আজ কীভাবে যেন ভুলে আছেন! প্রতিটি মুহূর্ত যাদের কষ্টকাতর নিঃশ্বাসে ভাসে। জীবন গড়িয়ে বার্ধক্যে এসে অশ্রুই যেন তাদের সম্বল! প্রতিপ্রাপ্যের প্রতি নিদারুণ অবজ্ঞায় যাদের আশ্রয় হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে, তাদের কথা বলছি।

‘টগবগে যৌবনের দিশেহারা সময়ে যোগ্য অভিভাবকের সঙ্কট ছিল। আগ্নেয়গিরির বুদবুদের মতো ফাঁপিয়ে তুলছিল কৈশোর উত্তীর্ণ যৌবনকে। যৌবনে পা পড়া ছেলেটির মুহূর্ত কাটে টনটনে শিহরণে নতুন নতুন আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন বুনে। ভুল পথে পা বাড়াতে সাহস জুগিয়েছিল অচেতন সমাজের বেহায়া পরিবেশ। যোগ্য অভিভাবকের শূন্যতায়, মায়ের আর্তনাদকে পায়ে ঠেলে বাড়িই ছেড়ে দিল ছেলেটি! রঙিন যৌবনের টানে মমতার শেকলও আটকাতে পারেনি তাকে। হঠাৎ নিরুদ্দেশ। কোনো খোঁজ নেই, লাপাত্তা হয়ে গেছে টগবগে যুবকটি। বেঁচে থাকার অবলম্বন সন্তানকে হারিয়ে শোকে-দুঃখে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলেন মা। বেশ কয়েক বছর পর ফিরেছে সেই ছেলেটি। মূল্যবান সময়কে জীবনের পেছনে ফেলে, নিঃস্ব হয়ে। ততদিনে শোকাতুর রুগ্ণ বিধবা মায়ের ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে।’ নিষ্ঠুর নিয়তির এমন কাহিনী পাঠক মনকে নিশ্চয়ই বিচলিত করছে।

নির্মম সত্যের এমন কাহিনী এ দেশে হাজার হাজার। সংবাদপত্রের পাতায় নিষ্ঠুরতার চোখভেজা খবরগুলো প্রায়ই চোখে পড়ে। তবে ধরন ভিন্ন, মানুষও ভিন্ন ভিন্ন। স্ত্রীর অর্থের প্রাচুর্যে বৃদ্ধ বাবাকে প্রতিপালনে ব্যর্থতার খবর। মমতাহীন অট্টালিকায় বৃদ্ধ মাকে প্রতিপালনে ব্যর্থতার খবর। কিছু কিছু মানুষ কীভাবে যেন এ কাজগুলো করছে অমানবিক হূদয়ে।

তাই গড়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রম। সেখানে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে মা-বাবাদের। কথিত আভিজাত্যে চলতে ফিরতে আমরা ভুলে গেছি জন্মের কথা। ভুলে গেছি মমতার চাদরে আগলে রাখা শৈশবের কথা। নৈতিক দায়বোধ যেন উবে যাচ্ছে প্রতিদিন। আজকের স্বনামধন্য এই ‘আমি’ কোথা থেকে এসেছি? কার অবদানে এসেছি? তার সবই যেন মুছে ফেলা অতীত! এসব যেন ভাববার কিছুই নয়, পালন করারও কিছু নয়!

আমিত্বের অহঙ্কারে ভুলে গেছি— ‘আমি’ কে, কে আমার। এই ‘আমি’র জন্মই বা কেন, কাদের জন্য? এই সমাজ এই প্রকৃতির সোনায় মোড়ানো স্নেহগুলো, পরম মমতার বন্ধনগুলো, সবই যেন আজ ভুলে যাচ্ছি। ভুলে যাওয়ার এই বৈপরীত্য আমাকেও যে একই পরিণতি ভোগাবে। এই ‘আমি’র যেন সেই হুশ নেই। যে বাবা-মায়ের শ্রেষ্ঠ রক্তকণা দিয়ে আজ আমার ‘আমি’ হয়েছি, সেই শুভবোধটিও কেন ভুলে আছি? আজ যাদের অবদান ভুলে আছি সেখানেও যে আমার অস্তিত্ব, সে কথাও ভুলে গেছি। এই ‘আমি’ আমাকেও ভুলে যাচ্ছি— যেন শুভবোধের শূন্যস্থানে অমানবিক ‘আমি’। গায়ের জোরে, অর্থের জোরে পরম মমতার বন্ধনকে পায়ে দলছি। বার্ধক্যে পড়া মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যে গর্হিত কাজটি ‘আমি’ করছি, উত্তরসূরিরা যে আমার বেলায়ও এই কাজটি করবে, সে কথা কেন ভুলে আছি!

তবে সৌভাগ্য যে, নগর জীবনে অমানবিক এই রীতির প্রচলন হলেও গ্রাম বাংলায় এখনো এর বিস্তৃতি ঘটেনি। একজন মা কিংবা বাবার সারা জীবনের সাদ আহ্লাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন তার সন্তান। সেই সন্তান যখন বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে, ওই বাবা-মায়ের কাছে সে ব্যথা কতটা বেদনার হয়- তা এই কলমে ব্যাখ্যা করার সাধ্য নেই। নিষ্ঠুরতার এমন হাজারো গল্পের ভিড়ে অল্প কিছু শব্দে বৃদ্ধাশ্রমের অশ্রুঝরা কষ্টকথাগুলো বলতে চেয়েছি। পৃথিবীতে এমন কোনো সন্তান নেই যে, মায়ের গায়ের সুবাস না পেয়ে ঘুমাতে পেরেছে। সেই মা যখন বৃদ্ধাশ্রমে কষ্টকাতর সময় পার করেন, তখন বুক চিনচিনে ব্যথার কথা মানুষ মাত্রই অনুভব করতে পারেন, পাষণ্ড ওই সন্তানরা নয়।

মাস দুয়েক আগে অফিসের প্রয়োজনে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে জানাশোনার প্রয়োজন হয়েছিল। অনলাইনে বৃদ্ধাশ্রমের খবর খুঁজতে গিয়ে কয়েকটি সংবাদ মনোযোগ সহকারে পড়েছি। গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে কয়েকজনের আশ্রিত হওয়ার খবর পড়ে চোখ ভিজে গেছে। পরম মমতার বন্ধনগুলো কীভাবে দূরে সরে যায়, মমতাভরা অতীতগুলো কীভাবে নিষ্ঠুর আচরণে রূপ নেয়— তা পড়ে চোখের পানি আটকাতে পারিনি, অসংযত আবেগের স্রোতে ভেতরটা ফুঁপিয়ে উঠছিল বার বার। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কারো কারো হূদয় থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা হারিয়ে যায়। বেহায়া আভিজাত্যের বিলাসী আধুনিকতাও কারো কারো বন্ধন ছিন্ন করে দেয়। আহ, যারা বৃদ্ধাশ্রমে দিন পার করছেন তাদের দীর্ঘশ্বাসগুলো যেন সৌরমণ্ডলের চেয়েও ভারী। সাত প্রবীণের বুকভাঙা গল্প পড়ে অনুমান করতে চেষ্টা করি মানবিক হূদয়ে কেন নিষ্ঠুর ইচ্ছাগুলো এভাবে বেড়ে ওঠে।

সরকারের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকার কথা যারা স্বজন হারানো, যাদের আপন বলতে কেউ নেই। অথচ গাজীপুরের পুনর্বাসন কেন্দ্রে যারা রয়েছেন তাদের অধিকাংশেরই কেউ না কেউ আছে। অবহেলা আর তাচ্ছিল্যে প্রতিপ্রাপ্যের অভাবের কারণেই এসব প্রবীণের আশ্রয় হয়েছে এখানে। এ মানুষগুলোর প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণের পরও কিন্তু তারা স্বজনদের ভোলেননি। জীবনের শেষ বেলার প্রতিটি মুহূর্ত কাটে তাদের ইবাদত বন্দেগি করে। পরম করুণাময়ের কাছে দু’হাত তুলে নিষ্ঠুর সেই স্বজনদের জন্যই মঙ্গল কামনা করেন তারা!

জীবনের এমন পরিণতি নিয়ে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে এক প্রবীণ মা বলেছিলেন, ওরা ভুল করেছে বলে কি আমিও ভুল করব! আহারে মাতৃত্ব! এর ব্যাপ্তি আর বিশালতা যে কত বড়, তা বলে বা লিখে বোঝানোর সাধ্য নেই। সন্তানের জন্য যেই মা জীবন দিতেও দ্বিধা করেন না, সেই মা আজ বৃদ্ধাশ্রমে। সেই মা-ই আবার চোখ ভিজিয়ে সন্তানদের জন্য মঙ্গল কামনা করে স্রষ্টার নিকট দু’হাত তুলে প্রার্থনা করছেন। অথচ ঈদে-উৎসবে নিষ্ঠুর সেই স্বজনদের অনেকে বাবা-মাকে একবার দেখতেও যান না। কথিত সেই অভিজাত সন্তানদের কেউ কেউ কেয়ারটেকার বা কারো মাধ্যমে ভালো খাবার আর খরচের টাকা পাঠান। ওসব পেয়ে মনোবেদনায় আরো ভারী হন তারা। অনেকে আবার অভিমানে সেসব খাবার আর জিনিসপত্র গ্রহণ করেন না। বৃদ্ধাশ্রমের আলো-আঁধার, বার্ধক্যের কষ্ট, দীর্ঘশ্বাসের চোখভেজা নিয়তিই তাদের দিন পার করে নেয়।

মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে যে মানুষগুলো এই অমানবিক রীতির চর্চা করছেন তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে যে সন্তান বৃদ্ধ মা-বাবাকে প্রতিপালনে বোঝা মনে করে, অথবা যে পুত্রবধূ তার শাশুড়িকে শ্রদ্ধা-ভক্তি বা ভালোবাসা দিতে কার্পণ্য করছেন তাকেও মনে রাখতে হবে, এই দিনটি আপনার জন্যও অপেক্ষা করছে। একজন মা সন্তানকে জঠরে ধারণ করার পর ভূমিষ্ঠ করে যেমনি লালন-পালন করেন, তেমনি সন্তানেরও দায়িত্ব বার্ধক্যে যাওয়া মাকে যত্নসহকারে প্রতিপালন করা। একই রকম দায়িত্ব জন্মদাতা পিতার প্রতিও। শুধু তাই নয়, স্বজনদের মধ্যে যাদের গুরু মান্য করা হয়, তাদের কেউ যদি আপনার জন্য অবদান রেখে যান তারাও আপনার কাছে প্রতিপাপ্যের দাবিদার। এ ছাড়াও আপনার আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বা নিকটতম প্রতিবেশীও আপনার নিকট সাহায্য সহযোগিতার দাবিদার; যদি তারা হয় সাহায্য পাওয়ার যোগ্য, আর আমি কিংবা আপনি যদি হই সেই সাহায্য করার মতো সামর্থ্যবান। ইসলাম ধর্মেও এ বিষয়ে জোর দিয়ে বলা আছে। যেটিকে ধর্মের ভাষায় ‘হককুল ইবাদত’ বলা হয়। অর্থাৎ যারা আপনার নিকট সাহায্য পাওয়ার যোগ্য, তারাই আপনার হককুল। এই হককুলের প্রতি যেমনি রয়েছে নৈতিক দায়িত্ব, তেমনি রয়েছে ধর্মীয় দায়িত্বটিও। যে কথা আমরা ভুলেই গেছি বলা যায়।

প্রকৃতির বনে-জঙ্গলেও রয়েছে এর চমৎকার উদাহরণ। ছোট-বড় অনেক বন্যপ্রাণী একই বনে আহার করে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। হিংস্র প্রাণীরা ছোট প্রাণীদের আক্রমণের আগে ও পরে ছোট প্রাণীগুলো একে অপরকে বাঁচাতে শব্দ করে সতর্ক করে। আবার কখনো কখনো দলবদ্ধ হয়ে হিংস্র প্রাণীর কবল থেকে রক্ষা করতেও দেখা যায়।

বনের পশুদের মধ্যে প্রতিবেশী বা সহচর প্রাণীর প্রতি সহযোগিতার এমন দৃষ্টান্ত প্রকৃতির কাছ থেকে শেখার একটি অংশ। অথচ মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব হয়েও অমানবিক, অনৈতিক আর নিষ্ঠুর কাজগুলো করে চলেছে কেউ কেউ। যা দেখে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও এই কুশিক্ষা গ্রহণ করছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই স্বর্ণযুগে নগরকেন্দ্রিক সমাজের কিছু কিছু মানুষের এই নিষ্ঠুর রীতির প্রচলন বন্ধ করতে হবে। নইলে যান্ত্রিক জীবনের ক্ষয়ে যাওয়া মানবিকতা রুগ্ণ থেকে আরো রুগ্ণ হতে থাকবে, সময়ের ব্যবধানে এ মানুষ হয়ে যাবে আরো অমানবিক। আমরা চাই না সেই বর্বর সমাজ। আমরা চাই না সেই তথাকথিত আভিজাত্য, যে আভিজাত্যে মানবিকতা নেই, নেই প্রতিপ্রাপ্যের প্রতি ঋণ শোধ করার মানবিক চেতনা। আমরা চাই সেই আভিজাত্য সেই সন্তান; যিনি শ্রদ্ধা-ভক্তি আর ভালোবাসায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে অতিযত্নে প্রতিপালন করবেন। আমাদের প্রজন্মের হাত ধরে আমরাও যেন শেষ জীবনে শান্তিতে সমাহিত হতে পারি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads