• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

আমাদের রাজনীতি ও নির্বাচন

  • মামুন মুস্তাফা
  • প্রকাশিত ১৪ আগস্ট ২০১৮

বছরটি নির্বাচনের। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন এ বছরের শেষ নাগাদ অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এ নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে রয়েছে নানা সংশয়, দ্বিধা, সঙ্কোচ এবং ভয়। অথচ এ নির্বাচন নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে থাকা উচিত ছিল আনন্দ, উল্লাস এবং উৎসবের আমেজ। যেমনটি উন্নত দেশগুলোতে হয়ে থাকে, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও। আমাদের দেশেও যে অতীতে হয়নি তাও নয়। তাহলে কেন এত শঙ্কা! এই আশঙ্কার ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছে মূলত বর্তমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি চর্চার কারণে। যার দরুন বৃদ্ধি পেয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস, হিংসা, দ্বেষ ও সংঘাত।

একটি দেশের জন্ম-ইতিহাস, সরকার ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক প্রভাব ও মানুষের রাজনীতি মনস্কতার ওপর নির্ভর করেই সে দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির চর্চা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রের স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থকেই বড় করে দেখেছে। এমনকি, তাদের নিজেদের ভেতরেও আস্থাহীনতার সঙ্কট জাতির ক্রান্তিকালেও দেশবাসীর সামনে উন্মোচিত হয়েছে। ফলে দুর্নীতি, অনৈতিকতা, লুটপাট, দলীয়করণ ও পরিবারতন্ত্রের ফলে রাজনৈতিক দলগুলোও ভাঙাগড়ার ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে গণতন্ত্রহীন চর্চার আদলে। ফলে অসহিষ্ণু ও সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি বাধাগ্রস্ত করেছে দেশের অগ্রযাত্রাকে। আর এ জন্যই সাধারণ মানুষ কখনো কোনো রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেনি।

কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, একুশ শতকের পৃথিবীতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট ম্যানিফেস্টো জনসাধারণের সামনে রাজনৈতিক দলগুলোকে তুলে ধরতে হবে। আশার কথা, বড় দুটো দলই তাদের ম্যানিফেস্টো ভিশন আকারে জনগণকে জানিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ভিশন-২০২১ ও ২০৪১ ইতোমধ্যেই জনগণকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে, দেশের উন্নয়নের একটি পরিষ্কার চিত্র সেখানে ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে বিএনপির ভিশন-২০৩০ রাজনীতিতে ইতিবাচক মানসিকতার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর এই ইতিবাচক ভূমিকাকে কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তাদের প্রস্তাবিত খসড়া রোডম্যাপে প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন ঘটানো। একই সঙ্গে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য সরকার, সব রাজনৈতিক দল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সুশীল সমাজ ও জনগণেরও উচিত হবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণে ইতিবাচক সহায়তা প্রদান করা।

অথচ বিগত তিন-চার মাস আগে একটি প্রধান দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে— ‘সাংঘর্ষিক অবস্থানে সরকার ও বিএনপি’ (প্রথম আলো, ৩০ এপ্রিল ২০১৮)। এই সাংঘর্ষিক অবস্থান জোরালো হয়েছে বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে একটি দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করায়। একটি দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। তাই দুর্নীতিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হবে না। কিন্তু সেই আইনের শাসনের নামে কোনো পক্ষই যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে না পারে, সেদিকে রাষ্ট্রকে মনোনিবেশ করতে হবে। কেননা এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে যদি আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়, তবে সেই গণতন্ত্র দেশ ও দেশের বাইরে হুমকির মুখে পড়বে এবং বর্তমানে সক্রিয় দেশের উন্নয়নের চাকাকেও শ্লথ করে দেবে। যে মুহূর্তে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করতে চলেছি এবং ১৯৪১-কে লক্ষ করে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সাজানো হচ্ছে, তখন বর্তমান সরকারও যে আগামী নির্বাচনকে সর্বসাধারণের গ্রহণীয় করতে পদক্ষেপ নেবে- তেমনটাই আমরা মনে করি।

রাজনীতিতে বিরোধী দলের ভূমিকা যে গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাবে অতীতের অনেক নিরঙ্কুশ সরকারও যে স্বৈরশাসকে রূপ নিয়েছিল তার বহু দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে। খোদ বাংলাদেশেই এরশাদ সরকার স্বৈরশাসকের তকমা নিয়ে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে তিরোহিত হয়েছিল ন্যায়বিচার, সুশাসন, নাগরিক অধিকারগুলো। উন্নয়ন ছিল দূরাগত। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে কীভাবে? সে পথ তৈরি করে দিতে হবে প্রথমত সরকারকে; দ্বিতীয়ত, তাকে সহযোগিতা করবে অন্য সব রাজনৈতিক দল এবং তৃতীয়ত, একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন উপহার দিতে নিরপেক্ষ ভূমিকা বজায় রাখতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সর্বজন শ্রদ্ধেয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ‘বাংলাদেশের রাজনীতি : কয়েকটি বিশ্লেষণ’ প্রবন্ধে প্রশাসন যন্ত্রের ভূমিকার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এই ত্রুটিপূর্ণ সংসারে কোনো কিছুই নিরপেক্ষ নয়, প্রশাসন যন্ত্র তো নয়ই। প্রশাসন যন্ত্রের সহযোগিতা না পেলে নির্বাচনে জেতা যে কঠিন সেই ব্যাপারটা বলা বোধ করি আবশ্যক।’ সেই থেকে আজ অবধি ওই প্রশাসন যন্ত্র ক্ষমতাসীন সরকার ও দলকে আনুকূল্য দিয়ে আসছে। অথচ তারা ভুলে গেছে, চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে তারা শপথ নিয়েছিল প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে তাদের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থ দেখতে গিয়ে তারা বিসর্জন দিয়েছে রাষ্ট্র ও তার নাগরিকের যথার্থ পাওনাটুকু।

নির্বাচনে প্রশাসন যন্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করতে হলে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। অথচ আজ পর্যন্ত স্বাধীন সার্বভৌম নির্বাচন কমিশন গঠন ও তার কার্যাবলি নির্ধারণ সাংবিধানে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। সংবিধান অনুসারে যেভাবে নির্বাচন কমিশন গঠিত হচ্ছে, সেখানেও সমালোচনার পথকে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। যে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে এবং তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়, সেখানেও দলীয়করণ কিংবা স্বজনপ্রীতির বিষয়টি থেকেই যাচ্ছে। ওই প্রক্রিয়ায় একটি স্বায়ত্তশাসিত নির্বাচন কমিশন গঠন করতে গিয়ে শুধু বড় দুটি দলের কাছ থেকে প্রাপ্ত তালিকা থেকে নাম নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন— কোনো স্বাধীন দেশের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিশেবে একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া হতে পারে না। আর তাই তো প্রতিবারই একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পর পরই তার স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিভিন্নভাবে সমালোচনা শুরু হতে দেখা যায়। তারপরও সাধারণ মানুষের আশা, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ পদকে কোনো বিবেকবান ব্যক্তি বিতর্কিত করতে পারেন না।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বাংলাদেশ খুব বেশি দূরে দাঁড়িয়ে নেই। এরই মধ্যে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও নির্বাচিত হওয়ার পর পরই ঘোষণা করেছিল ‘নির্বাচনী খসড়া রোডম্যাপ’। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে যেকোনো দিন ভোটগ্রহণের যে খসড়া তৈরি করেছে নির্বাচন কমিশন, তা ইতিবাচক। তফসিল ঘোষণা ও ভোটগ্রহণের সম্ভাব্য তারিখ, রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে আমাদের ধারণা। দেশবাসী ৫ জানুয়ারি মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সংঘাতময় নির্বাচন দেখতে চায় না। কিন্তু সেই সর্বজনগ্রাহ্য ও সর্বদলীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটটি তৈরি করার গুরুদায়িত্ব বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর। কিন্তু আমরা এও জানি যে, বর্তমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্তরায়। আর তাই প্রয়োজন রয়েছে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন এবং কঠোরভাবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের। 

একটি বিষয় শাদা চোখে খুব পরিষ্কার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে তার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারলেও, এই একই নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন কোনো দলীয় সরকারের অধীনে সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারছে না। ঘুরেফিরে সন্দেহ, অবিশ্বাস, পক্ষপাতিত্বের প্রশ্নটি থেকেই যায়। এরও প্রধান কারণ মূলত আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা এবং রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির চর্চা। এরপরও যদি দলীয় সরকারের প্রাধান্যকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের না থেকে থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে অন্তত নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। আর এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা ও উদ্যোগ প্রথমত প্রয়োজন।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে এমনভাবে পরিকল্পনা সাজানো উচিত, যার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে তার নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে, এবং অপরদিকে কোনো রাজনৈতিক দল বা তৃতীয় পক্ষ নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। যেমনটি আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের নির্বাচনের সময় তাদের নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রশাসন যন্ত্র কিংবা সরকারের কোনো প্রকার কর্তৃত্ব থাকে না, বরং নির্বাচন কমিশনের আদেশ-নির্দেশ-উপদেশ পালনে তারা বাধ্য থাকে। এক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ের নির্বাচন কমিশনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোতে দায়িত্ব পালনের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। আর তা করা গেলে প্রশাসন যন্ত্রের আধিপত্য রোধ করা কিংবা ছেঁটে ফেলা সম্ভব হবে।

আমরা বিশ্বাস করি, যেকোনো পরিস্থিতিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা তাদের সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণে কুণ্ঠিত হবেন না। কারণ তাদের ওপরই নির্ভর করছে একটি সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার ওপরই নির্ভর করছে দেশে ও দেশের বাইরে গ্রহণীয় একটি নির্বাচিত সরকার— যে কিনা বর্তমানে চলমান আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অগ্রগতির চাকাকে সচল রাখতে এবং আরো বেগবান করতে পারঙ্গম হবে। দেশকে উন্নয়নশীল থেকে মধ্যম আয়ের দেশে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবে। জাতি এখন সেদিকেই চেয়ে আছে।

 

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads