• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
শোকচিত্তে পিতাকে স্মরণ

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোড়ের বাড়িটি বাঙালির এক অনিবার্য ঠিকানা হয়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেই

সংগৃহীত ছবি

মতামত

শোকচিত্তে পিতাকে স্মরণ

  • মিজান মনির
  • প্রকাশিত ১৫ আগস্ট ২০১৮

‘কাঁদো বাংলার মানুষ কাঁদো।’ কাঁদো, বাঙালি কাঁদো। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে ফের ফিরে এসেছে শোকের মাস আগস্ট; একটি রক্তস্নাত মাস। পৃথিবীর কোনো জাতির ইতিহাসে বাংলাদেশের মতো শোকাবহ আগস্ট নেই। বেদনাবিধুর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর দিন আজ। ১৯৭৫ সালের আগস্টের ১৫ তারিখে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেই থেকে আগস্ট পিতা হারানোর শোকের মাস।

প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই তাঁর ভাঙা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। এই আগস্টকে বাঙালির ট্র্যাজেডির মাস আখ্যা দিয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। এ শোকাবহ আগস্টের শুরু থেকেই গ্রাম-শহর, নগর-বন্দর সবখানে শোকের ছায়া বইছে। পথে পথে কালো কাপড়ে লেখা আগস্টের শোকগাথা : ‘তুমি নেই তোমার চিহ্ন পড়ে আছে’ সারা বাংলা জুড়ে, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত ভূমিতে। আটষট্টি হাজার গ্রামে মানুষের হূদয়ের মণিকোঠায়। বেদনার্ত হূদয়ে তোমাকে স্মরণ করি অসীম সাহসে বাংলাদেশ জুড়ে। তাঁর অস্তিত্ব এক নদী জল চোখে নিয়ে প্রাণে বেঁচে আছেন বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোড়ের বাড়িটি বাঙালির এক অনিবার্য ঠিকানা হয়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেই। আর ১৫ আগস্টের পর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়িটি বাঙালির জন্য এক স্মৃতির বাড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বাড়ির পুরো প্রাঙ্গণ জুড়ে বঙ্গবন্ধু আর তার চিহ্ন। আগস্ট এলে বাড়িটি ঘিরে শুরু হয় অন্য এক মর্মন্তুদ আয়োজন। এ বাড়ি নিয়ে অনেক কথা, অনেক কবিতা আছে। ‘এক যে আছে বাড়ি’ শিরোনামে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন— “এক যে আছে বাড়ি আমাদের এই প্রিয় ঢাকা শহরেই।/কোনো প্রাসাদ নয়।/এখানে কখনো হাতীশালে হাতী ছিল না, ছিল না ঘোড়াশালে ঘোড়া।/আর দশটি বাড়ির মতোই সাধারণ এক বাড়ি।/কিন্তু এই সাধারণ বাড়িতেই একদা বাস করতেন একজন অসাধারণ মানুষ।/তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।” স্মৃতিময় ৩২ নম্বরের বাড়িটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতি বড় মধুর স্মৃতি বড় বেদনার শিরোনামে একটি বেদনার্ত লেখা প্রকাশ করেন।

“আর এখানেই একদিন আমাদের পিতা, আমাদের জনক শেখ মুজিব,/বঙ্গবন্ধু তথা আমাদের স্বপ্ন বিদ্ধ হয়েছিল ঘাতকের বুলেটে।/ দেয়ালে গর্ত, হুমড়ি খেয়ে পড়া আলমারি, কাচ ফেটে গেছে জানালার,/মুখ থুবড়ে পড়েছে রবীন্দ্র রচনাবলী, এখানে এলে দেখতে পাবে/ সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর পবিত্র রক্তের ফোঁটা আজো পড়ে আছে।” সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তার দীর্ঘ কবিতা ‘বত্রিশ নম্বর বাড়ি’র এক পর্বে লিখেছেন উপরের কথাগুলো। বঙ্গবন্ধুর শত-সাহস স্মৃতিঘেরা ৩২ নম্বরের বাড়িটি তাই তো নানা কারণে কখনো কখনো বাংলাদেশের হূৎপিণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে এমন অনেক মহাকাব্যের চরণ লেখা হয়েছে। প্রতিদিন তাকে নিয়ে লেখা হচ্ছে শত-সহস্র কথা ও কবিতা। বাঙালির জীবনে অনেক শোকের ঘটনা আছে। সব শোক, বেদনা ছাড়িয়ে ১৫ আগস্ট হয়ে উঠেছে শোকাবহ। শোককে শক্তিতে পরিণত করে শান্ত বাঙালি বার বার উঠে দাঁড়িয়েছে। লড়াকু বাঙালি কোনো দিন পরাজয় মানেনি।

‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ ভিন্ন মহাদেশের আরেক গণনায়ক ফিদেল ক্যাস্ত্রোর এই উক্তিই প্রমাণ করে, বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল বাঙালি জাতির জন্য উৎসর্গিত। বাঙালির মুক্তির জন্য তিনি জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন। বঙ্গবন্ধু একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি দেশ। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানেই শেখ মুজিব। তিনি আমাদের চেতনা। তিনি সব বাঙালির অনুপ্রেরণা। যতদিন বাংলাদেশ নামে দেশ থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে, বাংলা সংস্কৃতি ও সভ্যতা থাকবে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বহমান থাকবে, তত দিন শেখ মুজিব নামটি সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে বাঙালি জাতির ইতিহাসের পাতায় পাতায়। তাই তো কবি বলেছেন— “যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।/দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙা রক্তগঙা বহমান/তবু নাহি ভয়, হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।” তিনি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আবহমান বাংলার প্রাণপ্রবাহ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখার কোনো সমাপ্তি ঘটে না; তিনি বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ বিদ্যমান বাংলার আকাশে বাতাসে, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া জুড়ে। বঙ্গবন্ধু মানে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তিনি চিরঞ্জীব, চির অম্লান হয়ে থাকবেন এ দেশের প্রতিটি মানুষের মণিকোঠায়। তাঁর স্মৃতি অক্ষয় ও অমর হয়ে থাকবে এ দেশের প্রতিটি ধূলিকণায়।

লেখক : সাংবাদিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads