• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

প্রসঙ্গ : ২২ শিক্ষার্থীর বন্দিজীবন

  • আহমেদ তেপান্তর
  • প্রকাশিত ১৮ আগস্ট ২০১৮

কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সমর্থন করতে গিয়ে বেসরকারি দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থী ‘অজানা’ রোষানলে কারাগারে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘তারা ফৌজদারি অপরাধ করেছে, প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার হবে।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের ‘ক্ষমা’ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি এই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘স্কুলশিক্ষার্থীরা যা কিছু ভুল করেছে, সবই ক্ষমার যোগ্য। কারণ, তারা কোমলমতি শিশু। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ম্যাচিউরড। তারা যা করেছে, বুঝে-শুনেই করেছে। তাদের ক্ষমা করার সুযোগ নেই। আর ক্ষমা করার এখতিয়ারও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেই। কেউ ফৌজদারি অপরাধ করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে।’ (সমকাল, ৯ আগস্ট ২০১৮)।

এর পরপরই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক সোহরাব হাসান ‘ক্ষমাহীন শিক্ষামন্ত্রী!’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন প্রথম আলো পত্রিকায়। তিনি বেশকিছু বিষয় শিক্ষামন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এরমধ্যে একটি বিষয়ের সঙ্গে মন্ত্রী মহোদয়ের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল যখন তিনিও শিক্ষার্থী ছিলেন। সোহরাব হাসান ওই নিবন্ধে লিখেছেন, ‘অরাজনৈতিক’ কোনো মন্ত্রী বললে ভাবতাম, তিনি ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ষাটের দশকে তখনকার অন্যতম প্রধান ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র এবং গণআন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, সেই আন্দোলনে যেসব ছাত্রছাত্রী সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন, তারা কেউ আইন-কানুনের তোয়াক্কা করেননি।

প্রতিটি আন্দোলনই একটা রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের অংশ। এটা উপমহাদেশীয় রাজনীতির চরিত্র। আর ক্ষমতাসীনরা দেখেন সরকার পরিবর্তনের ষড়যন্ত্র হিসেবে। এটা বহুদিনের প্রচলন। নতুন করে দেখছি কেবল সরকার হটানো নয়, কেউ কেউ এগিয়ে এটাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’র মতো সেনসেটিভ শব্দ ব্যবহার করতে পিছপা হচ্ছে না। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানের আলোচনায় উপাচার্যদের উপস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সেই পথেই হেঁটেছেন। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, এই শিক্ষার্থীরা তার সঙ্গে সংহতি জানিয়েছিল। মন্ত্রী তার শান্ত-সুবোধ খোলস ছেড়ে রাজনৈতিক কায়দায় উপাচার্যদের ‘আইন’ দেখালেন। গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, ওই দুই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা কোমলমতি শিশুদের সমর্থনে রাজপথে নেমেছিল। কিন্তু হুট করেই পুলিশি ছত্রছায়ায় কিছু লোক যাদের পরিচয় তারা স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ আর সরকারি ভাষায় ‘অনুপ্রবেশকারী’রা আক্রমণ করে পুরো এলাকায় চালাল ত্রাসের রাজত্ব। শিক্ষার্থীদের কলেজেও হামলা চালানো হলো। তাদের বেধড়ক পেটানো হলো। অথচ স্বাধীন দেশে কোনো আন্দোলন বা মতপ্রকাশ বেআইনি নয়, কিন্তু সেদিন সে কাজটাই হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সেদিন প্রতিহত করতে পেরেছিল তথাকথিত অনুপ্রবেশকারীরা। পুলিশ তাদের থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার দেখিয়ে চালান করেছে। জেনেছি, ধরে নিয়েই কেবল ক্ষান্ত হয়নি; শিক্ষার্থীদের কপালে জুটেছে বেধড়ক প্রহার! 

অথচ সরকারের অঙ্গ-সংগঠন ছাত্রলীগের হাতে ২০০৯ সাল থেকে চলমান সময় পর্যন্ত কোলের শিশুসহ অন্তত অর্ধশতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। বাদ যায়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে কয়লা করার মতো অমার্জনীয় অপরাধগুলো। সেসব কোনো ঘটনারই কিন্তু বিচার হয়নি। অধিকাংশ ঘটনায় অভিযুক্তদের আদালত প্রাঙ্গণে পর্যন্ত নেওয়া যায়নি। একইভাবে কোটা সংস্কার দাবিকারীদের দমন করা হয়েছে। কেউ কেউ বিচারের অপেক্ষায় জেলের ঘানি টানছেন। আবার কারো লাশ পাওয়া গেছে ডোবায়। এরই ধারাবাহিকতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে প্রিজনভ্যানে তোলা হয়েছে। তখন বলার অপেক্ষা রাখে না বর্তমান সময়ে শিক্ষা আর শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

দেশের শিক্ষা অঙ্গনে যখন সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হয় এবং দলীয় লোকজনের সহায়তায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আইন দেখানো হচ্ছে যেন শিক্ষাকে কলঙ্কমুক্ত রাখা যায়! এত কিছুর পরও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাঁধে ষড়যন্ত্রের দোষ চাপানো কতটুকু যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

১০ আগস্ট, প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিবন্ধে সোহরাব হাসান দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে লিখেছেন, শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল সমাবেশ করছিল। স্থানীয় কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ও বহিরাগতরা এসে ভাঙচুর করেছে। গণমাধ্যমের খবরেও বলা হয়, পুলিশ ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কে আক্রমণকারী আর কে আক্রান্ত, নির্ধারণ করবে কে? পুলিশ ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ নেই। সেদিনের সহিংসতার পেছনে যদি স্বার্থান্বেষী মহল ও বহিরাগতরা কলকাঠি নেড়ে থাকে, তার দায় কেন শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানো হবে? তার মানে ভবিষ্যতে সামান্য আন্দোলনকেও এভাবে দমানো হবে-যার পূর্বাভাস হচ্ছে এই শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে হুশিয়ারি দেওয়া যে, ভবিষ্যতে যত অন্যায় অবিচার হোক, আওয়াজ হবে না; মুখবুজে সহ্য করে যাবে।

এক্ষেত্রে বিগত দিনের হতাহতের ঘটনার দায় প্রশাসন কি এড়াতে পারবে? অথচ যারা একটা সৎ আন্দোলনে সহযোদ্ধা হতে চাইল তাদের কপালে রাজতিলকের বদলে জুটছে রাজদণ্ড! এতে করে যে সরকারকে রাষ্ট্রের মুখোমুখি করানো হলো তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? যখন সড়ক দুর্ঘটনায়  িশক্ষার্থীরা বেঘোরে প্রাণ হারাল তখন কিন্তু শিক্ষার্থীদের হয়ে এগিয়ে আসেননি কেউ, ওদের আশারবাণী শোনাননি অথচ আজ যখন ওরা সহমর্মিতা প্রকাশ করতে গেল তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে হাতকড়া!  আইন চলুক তার নিজস্ব গতিতে। আজ অভিভাবক-শিক্ষার্থী সবার প্রত্যাশা, সন্ত্রাসীদের আর আশ্রয়-প্রশ্রয় নয়। তাহলে ইতিহাস কখনই ক্ষমা করবে না।

 

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads