• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ঈদুল আজহা ও আমাদের সংস্কৃতি

ঈদুল আজহা ও আমাদের সংস্কৃতি

প্রতীকী ছবি

মতামত

ঈদুল আজহা ও আমাদের সংস্কৃতি

  • আলতাফ হোসেন
  • প্রকাশিত ১৮ আগস্ট ২০১৮

বছর ঘুরে আমাদের জীবনে আবার ফিরে এসেছে পবিত্র ঈদুল আজহা। মহান আল্লাহ বছরে আমাদের জন্য দুটি শ্রেষ্ঠ আনন্দের দিন উপহার দিয়েছেন। এর একটি ঈদুল ফিতর, অপরটি ঈদুল আজহা। দুই ঈদেরই রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ঈদুল আজহা ত্যাগ ও কোরবানির বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর মহান ত্যাগের নিদর্শন। এই ত্যাগের মূলে ছিল আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং তার সন্তুষ্টি অর্জন। মহান পিতা ও পুত্র আমাদের জন্য যে উদাহরণ রেখে গেছেন তার মর্মকথা হলো- আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে প্রয়োজনে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, এমনকি জীবন প্রদানেও আমাদের হতে হবে অকুণ্ঠচিত্ত। কিন্তু বর্তমান সময়ে সত্য ও ন্যায় তথা আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে ত্যাগ ও কোরবানির যেসব চ্যালেঞ্জ আসে তাতে আমরা কতটা সাড়া দিই, সেই প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে।

ঈদ আমাদের ভালোবাসতে শেখায়, ত্যাগের মহিমা শেখায়, কিন্তু আদৌ কি আমরা ভালোবাসতে শিখি? ধনীরা গরিবকে ভালোবাসে ঠিকই, তবে সেটা জাকাতের কাপড় বিতরণের মাধ্যমে। জাকাত গরিবের প্রতি ধনীর দয়া বা করুণা নয়, বরং এটা গরিবের অধিকার। ঈদ এলেই দেখা যায় শাড়ির দোকানগুলোতে আলাদা স্টিকার লেগে যায়— ‘এখানে জাকাতের শাড়ি পাওয়া যায়।’ খোঁজ নিলে দেখবেন জাকাতের শাড়ি মানেই সস্তা আর অতি নিম্নমানের কাপড়। গরিবের প্রতি ধনীদের এই দায়সারা মনোভাব যত দিন দূর না হবে, তত দিন জোর দিয়ে বলা যাবে না ঈদ সত্যি সত্যি আমাদের ভালোবাসতে শেখাতে পেরেছে। একইভাবে আমরা ত্যাগের মহিমাও শিখতে পারিনি। ঈদুল আজহার কথাই ধরা যাক। এই ঈদে আমাদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের কথা ছিল। যেখানে ত্যাগ স্বীকার করতে গিয়ে ইব্রাহিম (আ.) তার নিজ পুত্রকে কোরবানি করতে চেয়েছিলেন, সেখানে পশু কোরবানি করতে গিয়েও আমরা নিজেদের জড়িয়ে ফেলি বিভিন্ন আপত্তিকর কাজে। বিশেষ করে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। প্রতিবেশী এক লাখ টাকার গরু কোরবানি দিচ্ছে, তাই আমাকে দিতে হবে দুই লাখ টাকা দামের। কোরবানিকে প্রেস্টিজ ইস্যু বানিয়ে ফেলেছে কিছু মানুষ। ত্যাগের নয়, কেউ কেউ আবার মৌসুমভর মাংস খাওয়ার কুমতলব নিয়েও কোরবানি দেন। ফলে ত্যাগের বিষয়টি একেবারেই অধরা থেকে যায়।

আমাদের ঈদ সংস্কৃতির একটা বড় অংশজুড়ে থাকে নাড়ির টানে একাত্ম হওয়ার বিষয়টি। ঈদ এলে সেই দূরত্ব ঘুচে যায়। যেকোনো মূল্যে আমরা সেটি ঘুচিয়ে ফেলি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এখন হাজারটা উপলক্ষ। ঈদকে উপলক্ষ করে প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার যে আনন্দ, এই আনন্দের সমতুল্য আর কোনো কিছুই হতে পারে না।

আল্লাহর উদ্দেশে পশু কোরবানি করে গোশত বণ্টনের সময়ও আমরা মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে থাকি। কোরবানিদাতা শুধু নিজেই কোরবানির গোশত ভোগ করেন না, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং দরিদ্র মানুষের মধ্যে তা বণ্টন করে তিনি কোরবানির ইবাদতকে পূর্ণ করেন। কোরবানির এই চেতনা এক দরদি সমাজ গঠনে আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

একটা সময় ছিল, যখন ঈদের মৌসুম এলেই জমজমাট হয়ে উঠত ঈদকার্ডের দোকানগুলো। আহা! কত রঙ আর বাহারের ঈদকার্ড! সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন কার্ডটি কিনে এনে প্রিয় কিছু কথা লিখে প্রিয়জনের হাতে ধরিয়ে দেওয়া কিংবা তার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো।

এই ডিজিটাল সময়ে ঈদকার্ড বড়ই বেমানান। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় তো থেমে নেই। মোবাইল আছে, ই-মেইল আছে, ফেসবুক আছে, ইমো আছে, ভাইভার আছে, স্কাইপ আছে। যখন তখন যে কাউকে শুভেচ্ছা জানানো যেতে পারে। শুধু মনে শুভ ইচ্ছেটা থাকলেই হলো। প্রতিবছরই আমাদের জীবনে ঈদুল আজহা আসে, কিন্তু কোরবানি বা ত্যাগের এই ঈদের মর্মবাণী প্রাত্যহিক জীবনে আমরা কাঙ্ক্ষিতভাবে অনুসরণ করি কি?

আমরা সচেতন হলে আমাদের অর্থনীতি, বাজারনীতি ও রাজনীতি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারত না। ত্যাগের বদলে আজ লুণ্ঠনের প্রবণতাই প্রবল। সহানুভূতি ও হূদয়বৃত্তির বদলে আজ আগ্রাসন ও নিষ্ঠুরতার চিত্রই বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। এসবের সঙ্গে কোরবানির চেতনার কোনো মিল নেই। আজ আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, কোরবানি শুধু একটি উৎসবের নাম নয়; বরং আল্লাহর বান্দাহ হিসেবে ন্যায়-অন্যায়ের তথা কল্যাণ-অকল্যাণের দ্বন্দ্বে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার নামই কোরবানি। আমাদের ঈদ সংস্কৃতি অত্যন্ত শক্তিশালী না হলে এটা সম্ভব হতো না।

এবারের ঈদের আনন্দ কোনো অশুভ কারণে মাটি হবে না, আমরা পরিবার-পরিজনসহ চমৎকার একটি ঈদ কাটাব, এই শুভকামনায় সবাইকে আগাম ঈদ মোবারক।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads