• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
অপরীক্ষিত জীবন কি যাপনযোগ্য?

সমাজ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

অপরীক্ষিত জীবন কি যাপনযোগ্য?

  • আবুল কাসেম ফজলুল হক
  • প্রকাশিত ১৯ আগস্ট ২০১৮

জন্ম ও মৃত্যু জীবনের দুই প্রান্ত। মনে হয় পৃথিবীতে মানুষের এবং অন্য সব প্রাণীরও জন্ম মৃত্যুদণ্ড নিয়ে। সারাজীবন কেউ এক রকম থাকে না। জীবনে শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য আছে। চারপাশের অবস্থাও এক রকম থাকে না। জীবনের এই পর্যায়গুলোতে মানুষের শরীরের অবস্থা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, কর্মক্ষমতা, চিন্তা ও চেষ্টা বিভিন্ন রকম হয়।

গোটা ইতিহাস জুড়েই দেখা যায় চিন্তাশীল লোকেরা জীবনযাপন করতে গিয়ে জীবন ও জগতের রহস্য উদ্ঘাটন করতে এবং জীবনযাপনের উৎকৃষ্ট উপায় জানতে চেষ্টা করেছেন। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা, সেই সঙ্গে যতটা পারা যায় চারপাশের অন্যদের জীবনের অভিজ্ঞতা ও পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে তারা আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর সন্ধান করেছেন। তারা জেনে-বুঝে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা, সমালোচনা করে নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চেয়েছেন।

বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন কালের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা, দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকরা এবং জননেতারা ভালো সমাজ ও ভালো জীবন সম্পর্কে নানা মত ব্যক্ত করেছেন। মুনি-ঋষিরা, ধর্মপ্রবর্তকরা এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠাতারাও পথ সন্ধান করেছেন  এবং সবার জন্য পথ প্রদর্শন করেছেন।

পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাপনের শ্রেষ্ঠ উপায় কী- এ প্রশ্নের উত্তরে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের, মুনি-ঋষিদের, ধর্মপ্রবর্তকদের ও মতবাদ প্রতিষ্ঠাতাদের ধারণা বিভিন্ন রকম। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের, এক কালের সঙ্গে অন্য কালের পার্থক্য আছে। তা ছাড়া আছে একজনের সঙ্গে অন্যজনের ব্যক্তিত্বের পার্থক্য। তা সত্ত্বেও চিন্তকদের, ধর্মপ্রবর্তকদের ও আদর্শ প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে কিছু বিষয়ে মতের মিলও আছে। সর্বজনীন কল্যাণ সবার লক্ষ্য।

তবে ধর্ম ও আদর্শের নামে ভণ্ডামি এবং ভাঁওতা-প্রতারণাও আছে। স্বার্থ নিয়ে বিরোধ আছে। হীন-স্বার্থবাদীরাও ধর্ম ও আদর্শের কথা বলে নিজের স্বার্থ হাসিল করে নেয়। ফলে ভালো জীবনযাপনের সমস্যা অত্যন্ত জটিল রূপ নেয়। প্রত্যেককে জীবনযাপন করতে হয় প্রতিযোগিতার মধ্যে। প্রতিযোগিতায় সাফল্যের প্রশ্ন আছে। ভালো কর্মসূচিকে সফল করার জন্য কাজ করতে হয়। অশুভ শক্তির সঙ্গে মোকাবেলায় জয়ী হওয়ার ও বিজয়কে স্থায়ী করার প্রশ্ন আছে।

মূল প্রশ্ন হলো, এদেশে একালে আমাদের জীবনযাপনের উৎকৃষ্ট উপায় সম্পর্কে আমাদের মত কী? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। গভীরে দৃষ্টি দিলেই দেখা যায়, কোনো কিছুরই দৃশ্যমান রূপ ও মর্মগত রূপ এক রকম নয়।

ব্যক্তি, সমাজ ও ভাষা

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ব্যক্তি নিয়ে গঠিত এবং ব্যক্তি সমাজের অংশ। ব্যক্তির প্রতি সমাজের কর্তব্য আছে এবং সমাজের প্রতিও ব্যক্তির কর্তব্য আছে। কোনো দিক থেকে এই কর্তব্য পালনে গাফিলতি দেখা দিলে দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুই পক্ষকেই নিরন্তর চেষ্টা করতে হয় ভালো থাকার ও ভালো রাখার জন্য।

আদিতে মানুষ ছিল যূথচারী। যূথভ্রষ্ট হয়ে কেউ বাঁচতে পারত না। সম্মিলিত জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছে ভাষা। ভাষা মানুষের জীবনের অঙ্গ রূপেই বিকশিত হয়েছে। ভাষা কেবল মুখের আওয়াজ নয়, চিন্তাচেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আবেগ-অনুভূতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর ভাষা অভিন্ন। ভাষা থেকে এগুলোকে কোনোক্রমেই আলাদা করা যায় না। এগুলো থেকে ভাষাকেও আলাদা করা যায় না। ভাষাকে মানুষ পূর্বপুরুষের উদ্ভাবিত লিপি দিয়ে রক্ষা করছে। মুখে মুখে কথা বলেও রক্ষা করছে। জীবনযাত্রার, চিন্তা-ভাবনার, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে মানুষ ভাষাকে বিকশিত করে চলেছে। জীবনে, সমাজে ভাষা সৃষ্টি হওয়ার পর মানুষ ভাষা ছাড়া নিজের স্বাভাবিক অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না। নিজের ভাষার উন্নতি সাধন ছাড়া কোনো ব্যক্তি, কোনো জাতি, কোনো রাষ্ট্র উন্নতি করতে পারে না। অন্য ভাষা থেকে উন্নত রূপ-রীতি, চিন্তা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান গ্রহণ করে নিজের ভাষাকে উন্নত করা হয়। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে উন্নতি করতে হলে পার্শ্ববর্তী বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাষাকে নিজের ভাষা করে নিতে হয়।

যতই দিন গেছে, ততই মানুষ পরিচিত হয়েছে সামাজিক জীবন বলে। সমাজ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। নিজের অস্তিত্বের, সমৃদ্ধির ও আনন্দের প্রয়োজনে ক্রমে মানুষ গড়ে তুলেছে পরিবার, জাতি, রাষ্ট্র ও আন্তঃরাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠান। ভালো জীবনযাপনের জন্য প্রত্যেককে এসবের মধ্যে থেকে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। এগুলোকে ভালো রাখার ও উন্নত করার জন্য প্রত্যেকের চিন্তা ও চেষ্টা করতে হয়। এগুলো খারাপ হয়ে গেলে প্রত্যেককেই দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হয়।

সমাজের রীতিনীতি, বিধিবিধান ও আইনকানুন কখনো কখনো সেকেলে হয়ে যায়। তখন সেগুলো মানুষের ন্যায়বোধকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। সে অবস্থায় লোকে সামাজিক রীতিনীতি, বিধিবিধান ও আইনকানুনের প্রতি আস্থাশীল থাকে না। মানুষে মানুষে সামাজিক আকর্ষণ কমে যায়। প্রবলরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। সর্বত্র খারাপ লোকেরা কর্তৃত্ব দখল করে নেয় এবং ভালো লোকেরা অসহায় হয়ে পড়ে। নানাভাবে মানুষের জীবন অস্বাভাবিক ও বিকারপ্রাপ্ত হয়। সমাজে সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। এই রকম অবস্থাকে বলা হয় সামাজিক অবক্ষয়। কোনো জাতির অবক্ষয়ক্লিষ্ট অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য দরকার হয় প্রচলিত মূল্যবোধ, প্রচলিত বিধিবিধান, প্রচলিত আইনকানুন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন। নিজের জীবনযাপনের সঙ্গে সঙ্গে সর্বজনীন কল্যাণে এই পরিবর্তন সাধনে অংশগ্রহণও কোনো ব্যক্তির ভালো জীবনযাপনের অপরিহার্য শর্ত। ভালো জীবনে অবশ্যই সাফল্য লাভের চেষ্টা থাকবে। রাষ্ট্রিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন থেকে যারা দূরে থাকেন, তাদের জীবনকে ভালো জীবন বলা যায় না।

সময়ের মূল্য

পৃথিবীতে আমাদের জীবন কাটানোর সুযোগ একবার মাত্র। আর জীবনের সময় স্বল্প। বছর, মাস, দিন, ঘণ্টা, মিনিট ইত্যাদি দিয়ে সময় মাপা হয়। দীর্ঘতর সময়ের পরিমাপক হিসেবে আছে শতাব্দ, সহস্রাব্দ ইত্যাদি। জীবনের সময় একবার চলে গেলে কোনোভাবেই তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। বিগত একটি মুহূর্তকেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। এজন্য আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য, যতটা সম্ভব জীবনের লক্ষ্য নির্ণয় করে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লক্ষ্যকে বিকাশমান রেখে লক্ষ্যের প্রতি নিষ্ঠ থেকে, পরিবর্তনশীল পরিবেশের মধ্যে নতুন নতুন কর্মসূচি নিয়ে কাজ করা- কাজের মধ্যদিয়ে নিজেকে এবং নিজের পরিবেশকে উন্নত করা। উৎপাদনের কাজ ও সৃষ্টির কাজ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদন হয় কৃষি ক্ষেত্রে, কলকারখানায়। এর সঙ্গে আছে ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা, পরিচালনা। ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। আয়-ব্যয় আছে। মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটে দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য ও শিল্পকলা ইত্যাদি চর্চার মধ্য দিয়ে। যারা সৃষ্টির কাজে উৎসাহ বোধ করেন না, তাদের কর্তব্য সমজদার হিসেবে সক্রিয় থাকা। কাজের মধ্যে বিশ্রামের ও আনন্দেরও সুযোগ রাখতে হবে। জীবনকে উপভোগ করতে হবে কাজের ও কাজের সাফল্যের মধ্য দিয়ে। কাজের মধ্য দিয়েই ব্যর্থতা ও দুঃখকে পেছনে ফেলে এগোতে হবে। অধ্যবসায় অপরিহার্য।

কৈশোরকালে যখন মানুষের জীবনে জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসা প্রবলভাবে দেখা দেয়, তখন থেকেই যদি মানুষ জীবন নিয়ে সতর্ক হয়, সময়ের গুরুত্ব বুঝে কাজ করে চলে, তাহলে জীবনে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি। ব্যক্তি যদি সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীল থাকে; তাহলে ব্যক্তির সাফল্যের সঙ্গে সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রও উপকৃত হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে এবং পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রে ভালো মানুষ রূপে গড়ে ওঠার এবং ভালো জীবনযাপনের উপযোগী পরিবেশ নেই। প্রতিকূলতার মধ্যেই ভালো হওয়ার ও ভালো করার জন্য কাজ করতে হবে এবং অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। নিজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকেও উন্নত করতে হবে। কাজের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করতে হয়। আলস্য সাফল্যের শত্রু। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না।

ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ

দুনিয়াটা অতি পুরনো হলেও প্রতিটি নতুন শিশুর কাছেই নতুন। প্রত্যেকের নিজের জীবনও প্রত্যেকের কাছে নতুন। কেউই জীবনযাপনের উপায় সম্পর্কে কোনো ধারণা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। জন্মের সময় প্রত্যেকেই অন্তর্জগত ও বহির্জগত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকে। জীবন ও জগত থাকে রহস্যময়।

আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য হলো, এই দেশে- এই পৃথিবীতে- আগে যারা জীবনযাপন করে গেছেন, সফল ও অসফল জীবন, তাদের জীবনধারা ও পরিবেশকে যতটা সম্ভব জানা। তা যদি আমরা করি, তাহলে নিজেদের জীবনযাপনের প্রকৃষ্ট উপায় সম্পর্কে আমাদের মনে কার্যকর উপলব্ধি জাগবে। আমরা বুঝতে পারব, কী আমাদের করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়। অতীতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কালে বিভিন্ন জাতি কী করেছে আর কী করতে পারত, কী হয়েছে আর কী হতে পারত, তা যতটা পারা যায় জানা আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য। ইতিহাসে এবং বাস্তবে জীবনযাপনের উৎকৃষ্ট উপায় সম্পর্কে নানা মত আছে। যতটা সম্ভব সেগুলো বিবেচনা করে আমরা আমাদের নিজেদের মত গঠন করতে পারি। ভালো জীবনযাপন করতে হলে তার উপায় অবশ্যই আমাদের সন্ধান করতে হবে। না জেনে, না ভেবে, কর্তব্য নির্ধারণ না করে জীবনযাপন করে গেলে জীবনে ভালো কিছু, বড় কিছু করা যায় না। তাতে জীবনের অপচয় হয়ে যায়। জীবনে ভালো কিছু, বড় কিছু করার সঙ্কল্প এবং চিন্তা ও চেষ্টা থাকা চাই। দুনিয়াব্যাপী মানুষের মধ্যে এই কর্তব্যবোধ জাগ্রত থাকলে এবং কর্তব্য পালনের আন্তরিক চেষ্টা থাকলে মানুষের জন্য দুনিয়াটা অনেক সুন্দর ও সুখকর হতো। জীবন ও পরিবেশ সম্ভাবনাময়। চিন্তা ও কাজের মধ্য দিয়ে সম্ভাবনা উপলব্ধি করা যায়, বাস্তবায়িত করা যায়। নিজের জীবনকে এবং অন্যদের জীবনকেও, অনুসন্ধান করে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুঝতে হবে। অতি পুরনো কথা- ‘অপরীক্ষিত জীবন যাপনযোগ্য নয়।’

জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা লক্ষ করলে দেখা যায় : বাইরের জগৎ সম্পর্কে মানুষ অন্তঃহীন জ্ঞানের অধিকারী; কিন্তু অন্তর্জগৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান অল্প। অর্থনীতিবিদদের চিন্তা অপর্যাপ্ত ও ত্রুটিপূর্ণ। তারা সাধারণত মানুষের অর্থবিত্তের ও ভোগবিলাসের চাহিদা ছাড়া আর কোনো কিছুকেই বিবেচনায় নেন না। ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে সাধারণত তাদের আগ্রহ দেখা যায় না। এ যাবৎকালের ইতিহাসে দেখা যায়, অর্থ-সম্পদ অর্জনের ও ভোগ-বিলাসের আগ্রহের তুলনায় জীবনযাপনের উৎকৃষ্ট উপায় ও ভালো জীবন সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা ও আগ্রহ একেবারেই কম। বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ সম্পর্কে জ্ঞানের ও অনুসন্ধিৎসার অসামঞ্জস্যের এবং ভালো জীবন সম্পর্কে উপলব্ধির অভাবের কারণে মানবজাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলছে। প্রযুক্তির সুবিধা মানুষ ভোগ করছে, কিন্তু নৈতিক দিক দিয়ে মানুষ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে চলছে। এই অবস্থায় পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এর জন্য রাষ্ট্রের আইনকানুন উন্নত করতে হবে। কেবল ব্যক্তিজীবনের নৈতিক অনুশীলন দিয়ে হবে না, রাষ্ট্রীয় আইনকানুনের উন্নত নৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ব্যক্তি জাতি রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা

প্রত্যেককেই পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবনযাপন করতে হয়। অস্তিত্বের ও সম্মানজনক জীবনযাপনের জন্য অর্থ উপার্জন করতে হয়। কিন্তু এতেই জীবনের চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি সবটা শেষ করে ফেললে ভালো জীবনযাপন করা হয় না। আমরা পূর্বপুরুষদের থেকে অনেক কিছু পাই; আমাদের কর্তব্য তার চেয়েও বেশি কিছু উত্তর পুরুষদের জন্য রেখে যাওয়া। আর অসংখ্য কারণে আমরা সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র ও পূর্বপুরুষদের কাছে ঋণী। আজকের এই উন্নত অবস্থা বহুকালের ও বহুজনের সাধনা ও সংগ্রামে সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় ভালো জীবনযাপনের জন্য প্রত্যেককেই সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের কল্যাণে এবং ভবিষ্যৎ জেনারেশনের কল্যাণেও কাজ করতে হবে। ভালো জীবনের অধিকারী হতে হলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের দায়িত্বকে বাদ দেওয়া যাবে না।

ব্যক্তি সমাজের অংশ এবং সমাজ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত। সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির কর্তব্য আছে। অপরদিকে ব্যক্তির প্রতিও সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের কর্তব্য আছে। একটির অস্তিত্ব ও সুস্থতা অন্যটির অস্তিত্ব ও সুস্থতার ওপর নির্ভরশীল।

একা একলা খুব কম কাজই করা যায়। ভালো জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী নানাভাবে সম্মিলিত ও সংগঠিত হতে হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রকে যতই পীড়নমূলক মনে হোক- এগুলো ছাড়া চলা যাবে না। এ জন্য ব্যক্তিজীবনের দায়িত্বের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভালো রাখার কিংবা ভালো করে তোলার দায়িত্বও প্রত্যেককেই পালন করতে হবে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা, আবিষ্কার-উদ্ভাবন এবং সৃষ্টি ও প্রগতির জন্য সাধনা ও সংগ্রাম নিয়েই হবে ভালো জীবনের অগ্রযাত্রা। নিজে পারলে ভালো। নিজে না পারলেও যারা এসব পারেন, তাদের কাজের সহায়ক ও সমঝদার হতে হবে।

বর্তমান আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক সুষ্ঠু নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। জাতিসংঘ পরিণত হয়ে আছে কেবল বৃহৎ শক্তিবর্গের সংঘে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর বিশ্বযুদ্ধ না ঘটলেও কোথাও না কোথাও যুদ্ধ লেগেই আছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও গণহত্যা চলছে। রাষ্ট্রব্যবস্থাও ভালো নয়। অসাম্য ও অন্যায়-অবিচার বাড়ছে। আদিবাসীদের চিরকালের জন্য আদিবাসী করে রাখা হচ্ছে। যে পৃথিবীতে আমরা বাস করছি তাতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এই উন্নতির কালেও অর্ধেকের বেশি লোক রাত-দিন প্রাণান্ত পরিশ্রম করেও পর্যাপ্ত জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারছে না। ভিক্ষুকদের সংখ্যা বাড়ছে। ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, গরিবরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এই দুরবস্থার মধ্যে লোকে ভালো জীবনযাপন করবে কী করে। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা-আন্দোলন, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, (১৯২৬-৩৮) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের আবেগ, পাকিস্তানকালে পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আমরা বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছি। এই কর্মধারায় ভালো যেমন ছিল, তেমনি ত্রুটি-বিচ্যুতিও ছিল। তবে অর্জনটাই বড়। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ এবং ব্রিটিশ সরকারের Divide and Rule Policy-এর কারণে ভারত বিভক্ত হয়, বাংলাও বিভক্ত হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও গত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরেই আমরা পারস্পরিক সম্পর্কের দিক দিয়ে রুগ্ণ, বিকারপ্রাপ্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছি। ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে এবং বাড়ছে। অন্যায় বাড়ছে, ন্যায় কমছে। দুর্নীতি ও জুলুম-জবরদস্তি বেড়েছে, বাড়ছে। অবস্থাকে অবশ্যই ন্যায়ানুগ ও উন্নত করতে হবে। তার জন্য যা যা করা দরকার সবই করতে হবে। জাতির ভেতরে সৃষ্টি ও প্রগতির চেতনা এবং সাধনা ও সংগ্রামের স্পৃহা জাগাতে হবে।

অশুভ বুদ্ধির প্রাধান্যের মধ্যে কল্যাণ নেই, শুভ বুদ্ধির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুভবুদ্ধির বিজয় ও কর্তৃত্বকে স্থায়ী করতে হবে। সর্বজনীন গণতন্ত্রের আদর্শ উদ্ভাবন ও অবলম্বন করে আর্থসামাজিক এবং রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। চিন্তা-ভাবনাকে উন্নত করতে হবে। নিজের জীবন ভালোভাবে যাপন করতে হবে, সেই সঙ্গে পরিবেশকে উন্নত করার দায়িত্বও পালন করতে হবে। কোনোটার প্রতিই উদাসীন থাকা যাবে না।

লেখক : বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads