• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলোর অপকর্ম

মাত্র কয়েকশ’ যাজকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলোর অপকর্ম

  • জি. কে. সাদিক
  • প্রকাশিত ১৯ আগস্ট ২০১৮

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বিশ্বে শরণার্থী সমস্যা নামে নতুন একটি মানবিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্টি— এ দুটি কারণে বিশ্বব্যাপী এমন মানবিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মানবিক এই সঙ্কটকে পুঁজি করে আবার সৃষ্টি হয়েছে তৃতীয় মানবিক সমস্যা, যার নাম সেবা সহায়তার বিনিময়ে যৌন ফায়দা নেওয়া। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট সৃষ্টির ফলে কয়েক বছর ধরে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।

গত কয়েক বছর ধরে অক্সফাম, সেভ দ্যা চিলড্রেন, রেড ক্রস ও এমএসএফ’র (ফরাসি দাতব্য সংস্থা) মতো শীর্ষস্থানীয় দাতব্য সংগঠনগুলোর কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে সাহায্য ও সেবার বিনিময়ে নারীদের ওপর যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। উত্থাপিত অভিযোগের ভিত্তিতে এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে তদন্ত শুরু করে ব্রিটিশ সরকারের হাউস অব কমন্স ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কমিটি। গত ৩১ জুলাই এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন মতে, অক্সফাম, সেভ দ্যা চিলড্রেন, এমএসএফ ও রেড ক্রসের কর্মীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনের একটি ঘৃণ্য চিত্র হচ্ছে, হাইতিতে ২০১০ সালের ভূমিকম্পের পর কাজ করার সময় একটি বেসরকারি সংস্থার এক কর্মী গৃহহীন এক মেয়েকে প্রতিনিয়ত এক ডলারের বিনিময়ে ধর্ষণ করত। ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা অক্সফামের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও হাইতিতে মিশনে গিয়ে যৌনকর্মী ভাড়া করার অভিযোগ ওঠে। এ প্রতিবেদনে সে সত্যতাও মিলেছে। প্রধান অভিযুক্ত চারজনকে বরখাস্ত করা হয়। সে সময়ের কান্ট্রি ডিরেক্টর রোল্যান্ড ভ্যানসহ আরো তিনজন পদত্যাগ করেন এবং অক্সফাম কর্তৃপক্ষ হাইতি সরকারের কাছে ক্ষমা চায়। সেভ দ্যা চিলড্রেনের প্রধান নির্বাহী জাস্টিন ফরথিসের বিরুদ্ধে ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তার বেশ কয়েকজন নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি পদত্যাগ করেন এবং টুইটারে একটি পোস্ট করে ক্ষমা চেয়েছেন। আরেক সাহায্য সংস্থা রেড ক্রস জানায়, তারা ২০১৫ সালে অর্থের বিনিময়ে যৌনসেবা নেওয়ার অভিযোগে তাদের ২১ কর্মীকে বহিষ্কার করেছে।

প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যমতে, এই সাহায্য সংস্থাগুলোর কর্মীরা ২০ বছর ধরে এ ধরনের অপকর্মে লিপ্ত। আফ্রিকার কিছু দেশ— লাইবেরিয়া, গিনি ও সিয়েরা লিওনে ২০০১ সালে জাতিসংঘের সাহায্য সংস্থার কর্মীরা ১৩ থেকে ১৮ বছরের মেয়েদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছে। অনেক সময় একটি মেয়ে গর্ভবতী হয়ে গেলে অন্যজনের সঙ্গে আবার সম্পর্ক গড়ে তোলে সামান্য অর্থ ও সেবামূল্যের বিনিময়ে। এর ফলে অনেক নারী মানসিকভাবে বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়েছে, হারিয়েছে সামাজিক মর্যাদা। একাধিক নারীর সঙ্গে মিলনের ফলে অনেক নারী এইচআইভিতে (এইডস) আক্রান্ত হয়েছে। বর্তমানে এই পরিস্থিতি সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও ফিলিস্তিনেও বিরাজমান। এই দেশগুলোতেও সাহায্য ও সেবাদানের নামে মেয়েদের ওপর যৌন নির্যাতন হচ্ছে।

গত ২২ জুন সংবাদমাধ্যম বিবিসি ফরাসি দাতব্য সংস্থা এমএসএফ’র কর্মীদের বিদেশে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিগ্রহ থেকে পালানো লোকজনের স্বাস্থ্য সেবাদানের জন্য প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। এ সংস্থাটি বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরেও কাজ করছে। বিবিসিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে, সংস্থাটির কর্মীদের বিরুদ্ধে আফ্রিকায় স্থানীয় যৌনকর্মীদের ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে অল্পবয়সী মেয়েদের ওপর যৌন নির্যাতন করা হতো। এমনকি তাদের অনেক নারী সহকর্মীর ওপরও যৌন নির্যাতন চালানোর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। যৌন নির্যাতনের দায়ে সংস্থাটি গত বছর তাদের ১৯ কর্মীকে বহিষ্কার করে। তবু এর প্রতিকার দ্রুত সম্ভব নয় বলেও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ।

সম্প্রতি বার্তা সংস্থা এএফপি আমেরিকার পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের ক্যাথলিক চার্চগুলোতে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন নিয়ে ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড জুরি পেনসিলভেনিয়ার গির্জাগুলোতে সংরক্ষিত ৫ লাখ পৃষ্ঠার তথ্য ঘেঁটে গত সাত দশক ধরে ১ হাজারেরও বেশি শিশুর ওপর চালানো যৌন নির্যাতনের প্রমাণ সামনে আনে। ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠিত বিশপ অ্যাকাউন্টিবিলিটি অনুসারে, আমেরিকার ৫ হাজার ৭০০ থেকে ১০ হাজার ক্যাথলিক যাজকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র কয়েকশ’ যাজকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। চার্চগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন চললেও ২০০২ সালে দ্যা বোস্টন গ্লোব চার্চে শিশুদের নির্যাতনের ঘটনা প্রথম জনসম্মুখে আসে। তবে এই জঘন্য ঘটনাগুলোর বিচারের ক্ষেত্রে চার্চ কর্তৃপক্ষ অনেক সময় তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ফলে এমন ঘৃণ্য কাজ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।

নারী ও শিশু নির্যাতনের যে জঘন্য ও রোমহর্ষক তথ্য দেওয়া হলো, তা পড়ে ‘এমন ঘটনা কেন ঘটছে’- এ প্রশ্ন জাগে। যদি একটু গভীর দৃষ্টিতে তাকাই, তাহলে এর উত্তর সহজে মেলে। দাতব্য সংস্থাগুলো অসহায় মানুষের মানবিক দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। যেমন- কিছুদিন আগে সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনে যুদ্ধবিগ্রহের ফলে উদ্বাস্তু লোকদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের সময় নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালানোর ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ত্রাণ ও অন্যান্য জরুরি সহায়তার জন্য দ্বারস্থ নারীদের ওপর মানবিক দুর্বলতাকে জিম্মি করে তাদের থেকে যৌন ফায়দা নেওয়া হয়েছে। এমন ঘটনা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরেও ঘটছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। রোহিঙ্গা নারীরা ব্যাপক হারে যৌনকর্মীর কাজ করছে এমন তথ্যও প্রকাশিত হয়েছে। তেমনি আফ্রিকার দেশগুলোতেও এমন ঘটনা ঘটছে। মূলত মানবিক দুর্বলতা ও জীবন বাঁচানোর তাগিদকে পুঁজি করে এমন বর্বরতা চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে চার্চগুলোতে মানুষের ধর্মীয় আবেগ ও বিশ্বাসকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। চার্চগুলোতে বিশেষত ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মানুষ তাদের সন্তান ভর্তি করে। আর অসহায় ও এতিম শিশুদেরও এখানে পাঠানো হয়। এখানেও মানবতার আড়ালে ঘৃণ্যতা চলছে।

একটা বিষয় সামনে আসে যে, যদি যুদ্ধবিগ্রহ না হতো তাহলে যেসব দেশে মানবতার সেবার আড়ালে নারী নির্যাতন চলছে, সেগুলো কি আদৌ হতো? আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়, যেসব দেশ দাতব্য সংস্থাগুলো পরিচালনা করছে, তারাই বিশ্বের শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টির পেছনে মূল ইন্ধনদাতা। শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে যুদ্ধ বাধিয়ে লোকজনদের গৃহহীন ও আশ্রয়প্রার্থী করে তাদের সহায়তা দিয়ে মানবতার সেবা করা হচ্ছে। আর এটা করতে গিয়ে অসহায়ত্বকে পুঁজি করে নারীদের সম্ভ্রমহানি হচ্ছে দেদার। প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যিই যদি শান্তি প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে যে অর্থ ও শ্রম যুদ্ধ করে এবং শরণার্থী সেবায় ব্যয় করা হচ্ছে, সে অর্থ যুদ্ধ না করে শরণার্থী না বানিয়ে যদি সে দেশগুলোর শিক্ষা, চিকিৎসা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় করা হতো, তাহলে কি প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা হতো না? তখন না হতো রক্তপাত, না থাকত শরণার্থী। সেবা-সহায়তার নামে নারী নির্যাতনও হতো না। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহায়তার সময় যে নির্যাতন হয়, সেগুলো তো চলবেই। আমরা যদি মানবিক হই, তাহলে সেগুলোও হবে না। কারণ সংস্থাগুলো টুইটারে ও প্রজ্ঞাপন দিয়ে ক্ষমা ও কর্মীদের শুধু বহিষ্কার না করে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দিলে এসব ঘটনায় নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবসেবার আসল পদ্ধতি অবলম্বন করা। যুদ্ধ বন্ধ হলে বিশ্বে শরণার্থীর লাইন অনেক ছোট হয়ে যাবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads