• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

ভালোবাসার উৎসবে ‘সত্য-গ্রহ’

  • ফাইজুস সালেহীন
  • প্রকাশিত ২৫ আগস্ট ২০১৮

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। একদা তা-ই ছিল। এখন আর তেমনটি নেই। সময় বদলেছে। একালে তেরো পার্বণের খবর আমরা কমই রাখি। আবহমান বাংলায় তেরো পার্বণের জায়গায় কত উৎসব-আয়োজনের উপলক্ষ যে যোগ হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অতীতের নিস্তরঙ্গ বাংলার উৎসবগুলোর বেশিরভাগই আমরা ভুলে গেছি। দুয়েকটি এখনো বেঁচে থাকলেও আগের রূপে আর নেই। কোনো কোনো পার্বণ গ্রাম থেকে উঠে এসে শহুরে হয়ে গেছে। মেজাজটাও হয়ে গেছে নাগরিক। এই বাংলার প্রিয় অতিথি পয়লা বৈশাখ এখন আর হাটে-বাটে, ধূলিউড়া পল্লীর প্রান্তরে, বটের ছায়ায়, নদীর কূলে আমআঁটির ভেঁপু কিংবা বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে, পেটকাটা ঘুড়ি উড়িয়ে আসে না। কোথাও কোনো ঢাকের শব্দ শোনা যায় না ধলপহরে। এখানে এখন বাংলা নববর্ষ আসে কেতাদুরস্ত রূপে নাগরিক আবহে। মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়, পান্তা-ইলিশ খাওয়া হয়, দিনব্যাপী মেলাও হয়। নবান্ন কিংবা পৌষ-পার্বণও একালে শহুরে হয়ে গেছে। নগরের সংস্কৃতিবানরা পিঠা উৎসব করেন। পিঠা এখন দোকানেও কিনতে পাওয়া যায়। পঞ্চাশ বছর আগেও বাংলার গ্রামে প্রত্যেক ঘরেই শীতের পিঠা হতো। কত রকমের পিঠা বানাতেন আমাদের মা-বোনেরা, তার কোনো লেখাজোখা নেই। সেদিন ফুরিয়েছে। বর্তমানে প্রাচীনবাংলার দুয়েকটি উৎসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিকতার নানান উপলক্ষ। জাতিসংঘের ক্যালেন্ডারে বলতে গেলে প্রতিদিনই রয়েছে আয়োজনের উপলক্ষ। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে প্রধানত এই উৎসবগুলো পালন করে এনজিও সমাজ। আবার কোনো কোনো দিবসে ফেসবুকে দেখা যায় তুমুল তরঙ্গ। বন্ধুদিবস, পিতাদিবস, মাতাদিবস— এসব দিবসে ফেসবুকাররা খুব সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আর ভালোবাসা দিবস ও বসন্তের প্রথম দিনে তরুণ-তরুণীরা ঘরের বাইরে এসে মেতে ওঠে ফুলের উৎসবে। এই দুটি উৎসবে মুখর হয়ে ওঠে ফেসবুকও। এসব শেকড়চ্যুত আনন্দ-আহ্লাদের বাইরেও আছে বাঙালির মহান স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের অনন্যসাধারণ উৎসব ও উপলব্ধির দিন। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিও আমরা পালন করি উৎসবমুখর পরিবেশে। শোককে আমরা শক্তিতে পরিণত করেছি, নতুন উদ্দীপিত হওয়ার উপলক্ষ বানিয়ে নিয়েছি এই মাসটিকে।

এসব আনন্দ-আয়োজনের পাশাপাশি বাঙালি মুসলমানের আরো দুটি প্রধান উৎসব বছরে দুটি ঈদ। ঈদ মানেই খুশি। সত্য বটে, খুশির এই ঈদ কেবল বাঙালি মুসলমানের নয়। ঈদ বিশ্বমুসলিমের উৎসব। কিন্তু এই বাংলায় ঈদ আয়োজনের মেজাজ অনেকটাই ভিন্ন। আমাদের উৎসবের মধ্যে নিজস্বতার ছাপও রয়েছে। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটি দুনিয়ার খুব কম দেশেই আছে। অবকাশ যাপনের এই অসাধারণ রীতিটি বাঙালির একান্ত আপনার। বাঙালি নাড়ির টান উপেক্ষা করতে পারে না। বাপ-মা, ভাইবোন, গ্রামের পড়শি পরিচিতদের সঙ্গে পুনর্মিলনের উপলক্ষ বছরে এই দুটি ঈদ। অবশ্য সবাই যে পুনর্মিলন বা আপনজনের টানে ছুটে যান, তা নয়। কাচা টাকার ঝমক-চমক দেখানোর জন্যেও অনেকে গ্রামে যান। তাদের কাছে আত্মীয়দর্শন গৌণ। তবে বেশিরভাগই যান মনের গহিন-গভীর টানে।

বছরে দুই ঈদের মেজাজ বহিরাঙ্গে দুইরকম হলেও অন্তরে অভিন্ন। দার্শনিক তাৎপর্যে ব্যবধান নেই। সমর্পণ ও সৌভ্রাতৃত্বের তথা মানবিকতার চিরকালীন ডাক নিয়ে আসে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। সিয়াম-সাধনার মাহে রমজানের শেষে পশ্চিমাকাশে শাওয়ালের এক চিলতে বাঁকা চাঁদ বার্তা নিয়ে আসে পুণ্যস্নাত আনন্দ-অবগাহনের। মাসভরে কঠোর সংযম ও শুদ্ধাচারের মাধ্যমে মুসলিম নারী ও পুরুষ আবাহন করেন ঈদ-উৎসবের। আর এই উৎসবে ধনী-গরিব, ছোট-বড়র ভেদাভেদ ভুলে সবাই অংশগ্রহণ করেন এক অভিন্ন আবেগ ও মূল্যবোধ নিয়ে। অন্য যে কোনো সামাজিক উৎসবের তুলনায় ঈদ-উৎসবের ব্যাপকতা আরো অনেক বেশি। বহুমাত্রিক এর তাৎপর্য। এই উৎসব যতটা না উদযাপনের, তার চেয়ে বহুগুণে বেশি অনুভব ও অনুধাবনের। এই উৎসব ডাক নিয়ে আসে সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের। মুসলমানের আত্মিক পরিশুদ্ধির এক বিশুদ্ধ প্রকাশ ঈদুল ফিতর। সিয়াম-সাধনার মধ্য দিয়ে মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা সব গ্লানি বিমোচন হয়েছে কি-না, তারও পরীক্ষার দিন ঈদুল ফিতর। যাদের সামর্থ্য নেই, যারা দুঃখী-দরিদ্র, তারাও যাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে উৎসবের সমান ভাগীদার হতে পারেন, তার জন্যও রয়েছে অর্থনৈতিক বিধি-ব্যবস্থা। পবিত্র ইসলাম ঈদের জামাতে শরিক হওয়ার আগেই মাথাপিছু নির্দিষ্ট হারে দান করার বিধান দিয়েছে। ইসলামী পরিভাষায় একে ফিতরা বলা হয়। ন্যূনতম সামর্থ্য যে পরিবারের রয়েছে, তাদের ফিতরা আদায় করতে হয় নির্ধারিত হারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই দান ইসলামী বণ্টন ব্যবস্থার অংশবিশেষ। এই দানের ফলে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা প্রতিবেশীরা উপকৃত হন।

প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় যে, ইসলামী অর্থনৈতিক বণ্টন-ব্যবস্থাপনায় জাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ পালনীয় কর্তব্য। জাকাতের সঙ্গে মাহে রমজান বা ঈদুল ফিতরের কোনো সাক্ষাৎ সম্পর্ক নেই। জাকাত হচ্ছে সম্পদের ট্যাক্সস্বরূপ, যা বছর শেষে হিসাবমতো প্রদেয়। তবে সাধারণত রোজার মাসের শেষার্ধেই সামর্থ্যবানরা জাকাত বিতরণ করে থাকেন। ইসলামের এই ব্যবস্থাটিও বৈষম্য কমিয়ে আনতে সহায়তা করে। এটা দারিদ্র্যের বেদনা লাঘব করে। এর দ্বারা জাগরণ ঘটে ভ্রাতৃত্ববোধের। নামাজ, রোজা, দান-ধ্যান, ঈদের উৎসব ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পবিত্র ইসলাম ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। রোজার মাসে এই মহৎ শিক্ষার প্রবল প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। আর তা পরিপূর্ণতা পায় ঈদগাহে ধনী-দরিদ্রের প্রভেদ ভুলে এক কাতারে শামিল হওয়ার মধ্য দিয়ে।

ঈদুল ফিতরের দুই মাস দশ দিন পর বিশ্বমুসলিম উদযাপন করেন ঈদুল আজহা।

আমাদের দেশে এই ঈদকে বকরা ঈদ, কখনো কখনো বড় ঈদও বলা হয়ে থাকে। কোরবানির ঈদ বলে একে চেনা যায় খুব সহজেই। এই ঈদে সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানই ছোট-বড় কিংবা সাতভাগের একভাগ হলেও পশু কোরবানি করে থাকেন। হজরত ইব্রাহিমের (আ.) অনুসরণে মুসলমানরা পশু কোরবানি করে থাকেন আল্লাহর রাহে। এটি হচ্ছে আল্লাহতায়ালার জন্য ত্যাগ ও আল্লাহতে আত্মসমর্পণের নিদর্শন। ঈদুল আজহার সময়েই হজ অনুষ্ঠিত হয়। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা জীবনে একবার হলেও হজব্রত পালন করেন। আল্লাহতায়ালা সে রকমই আদেশ করেন। হজযাত্রী মক্কায় যথারীতি কোরবানির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। কোরবানিদাতারা বলেন, ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়্াইয়া ও মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। অর্থাৎ আমার সমর্পণ, আমার ত্যাগ, জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর জন্য। কিন্তু আল্লাহর কাছে জবাই করা পশুর গোশত, রক্ত বা চামড়া কোনো কিছুই পৌঁছায় না, আল্লাহর তাতে কোনো প্রয়োজনও নেই। আল্লাহ দেখেন মানুষের নিয়ত। আল্লাহর কাছে গোশত না পৌঁছালেও জবাই করা পশুর গোশত ও চামড়া মানবতার জন্য, মানবিক ভালোবাসার ও আত্মীয়তার দাবি মেটাতে ব্যয় করা হয়। চামড়া বিক্রি করে পুরোটাই বণ্টন করে দিতে হয় গরিব-দুঃখী অসহায়দের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কোরবানি কবিতা থেকে দুটি লাইন উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি লেখেন, ‘আজ আল্লার নামে জান-কোরবানে ঈদের মত পূত বোধন/ ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন।’ সত্য-গ্রহ মানে সত্য স্বীকার করে নেওয়া। সত্যাগ্রহের আরেক অর্থ ধর্মঘট। আর ধর্মের অর্থ অধর্মের বিপরীত। সহজ কথায় একে বলা যায় ন্যায়ের জন্যে কৃতসংকল্প হওয়া। আর ন্যায় হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাতের শুভবোধ। মুসলমান কোরবানির মাধ্যমে নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা যাবতীয় অশুভতা তথা পাশববৃত্তি বিসর্জন দেন, একে কোরবানি করেন। এ হচ্ছে মানবতার সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষা। ঈদুল ফিতরের মধ্যেও রয়েছে একই শিক্ষা।

ঈদের অবকাশে নাড়ির টানে বাড়ি যান শহুরে মানুষ। এও আরেক আবেগ, বাঙালির চিরকালীন ভালোবাসা। মানুষ ছুটে যান গ্রামে কিংবা কর্মস্থল থেকে দূরে অন্য কোনো শহরে, যেখানে রয়েছেন পিতা-মাতা, আত্মীয়-পরিজন। নিজের গ্রাম বা মহল্লাবাসী সর্বোপরি দূরে থাকা আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে ঈদ করার যে আকুলতা; তার মধ্যেও রয়েছে এক অনির্বচনীয় প্রাপ্তির আনন্দ। এই যে ভালোবাসা, এর সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনীয় হতে পারে না ভ্যালেন্টাইন ডে’র ভালোবাসার। ভ্যালেন্টাইন ভালোবাসা কৃত্রিম, ফ্যাশনসর্বস্ব। কিন্তু ঈদে যে ভালোবাসার স্পর্শ আমরা পাই, তা মানুষের আত্মার গভীর থেকে উঠে আসা পূত-পবিত্র এক অনুভব।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads