• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
পরিবর্তনের অভিজ্ঞতায় দেশের মানুষ

সমাজ-কাঠামোটা যেন সুস্থ পাটাতন পাচ্ছে না

আর্ট : রাকিব

মতামত

পরিবর্তনের অভিজ্ঞতায় দেশের মানুষ

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ২৭ আগস্ট ২০১৮

প্রায়ই কাজ চিনে কাজ করার প্রবণতা দেখি তার মধ্যে, একসময় সামাজিক দায়বদ্ধ মানুষের আন্দোলন করেছেন, এখন অভিজ্ঞতায় বদলে গিয়ে স্থানীয় ইতিহাস রচনায় মন দিয়েছেন, কাজ করছেন নেশায় বুঁদ হয়ে। এই ছুটিতে তার সান্নিধ্য পাই, যেহেতু তিনি সারাটা কাল মাটি-মানুষের সঙ্গে থেকেছেন, সেজন্য তার চোখে পরিবর্তনের ইঙ্গিতগুলো বুঝে নিই। বেছে নিই। তিনি বলেন, নানা কথা। মধ্যবিত্তের পরিবর্তনের কথা, বিত্তহীনদের বদলে যাওয়ার কথা, এদেশের মানুষের পরিবর্তনের কথা, রাজনীতির পরিবর্তনের কথা। এসব পরিবর্তনের আলোচনার ভেতরে তাকে পূর্ণ দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবেই আবিষ্কার করি। যদিও এ আবিষ্কার নতুন নয়। তবুও চিনতে চলার পথে নতুন তো বটেই! কারণ, ভোল পাল্টানো শিক্ষিত মানুষের দল তো কম নেই— কোথাও। ঢের দেখে চলছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সর্বপর্যায়ে। বোধ করি আজকাল, শিক্ষিত লোকেরাই সবচেয়ে ‘অশিক্ষিত’ কর্ম-প্রাবল্যে নিমজ্জিত। শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রায় সেন্টপার্সেন্ট দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। নীতিবান যে দু’চারজন আছেন তারা সংখ্যালঘু, অচল, ‘পাগলপ্রায়’ (?)। গ্রামে কাটাচ্ছি এখন। ফলে ওই শিক্ষিত মানুষদের এখানে তেমন প্রহরা নেই। বেসাতি নেই। খ্যাতি, প্রসিদ্ধির তাড়াহুড়ো এখানে নেই। খুব অন্য মুখ সব। প্রায় সাধারণ মানুষ। এখানে বদলানো মুখের সংখ্যা কম। ভেতরে-বাইরে আলাদা নেই। এক, সবটা একরকম। নাম তার মধু। সে রিকশাচালক। এখন প্যাডেল রিকশা গ্রামে নেই। চার্জার। চার্জ দেয়, বাড়িতেই। বিদ্যুৎ আছে। আগের চেয়ে ওদের গ্রামে এখন বিদ্যুৎ ভালো। আমাদের আর এক বন্ধু ন্যাদো— সে এখন বেকার। কিন্তু এক রকম করে চলে যায়। ঈদের মাঠে সুগন্ধি মেখে এসেছে সে। অন্য বন্ধুরা, কেউ কাঠের ব্যবসা, কেউ স্কুলমাস্টার, কেউবা ছোট চাকরি করে। ছিমছাম জীবন। খুব সীমিতও। সন্তান মানুষ করে, নিজেরা চলে। কেউবা দোকানদার। কোনো পরিত্যক্ত জায়গা এখন নেই। আমাদের বন্ধু মজনু এখন প্রাণিসম্পদ অফিসের সামনে প্রাণীর ওষুধ বিক্রি করে। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগে। কিন্তু এ বিষয়ে তার এন্তার অভিজ্ঞতা। আর সিজনে গরু-বকরির কোন রোগ কখন হয়, কীভাবে কোন ওষুধ দিতে হয়— তা মুখস্থ। খুব ব্যস্ত সে। আশ্চর্য, মানুষের মেধা। রাস্তায় চলতেফিরতে এমন মেধাসম্পন্ন মানুষের সামাজিক সক্রিয়তা আমাকে অবাক করে। এ রকম অভিজ্ঞতা বগুড়ায় বেশি চোখে পড়ে। কী নেই সেখানে! কর্মক্ষেত্রে সব প্রায় অশিক্ষিত মানুষদের নেতৃত্ব যেন। ওখানকার দই কিনলে, সঙ্গে যে প্যাকেট করার প্রক্রিয়া— সেটি অসাধারণ। ওই প্যাকেট দিল্লি-লন্ডন গেলেও সবটা অবিকৃত থাকবে। এসব সস্তা হাতের কাজ। আর উপকরণ সরবরাহের জন্য গ্রামে গ্রামে লোক আছে। ওখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভটভটি, নসিমনসহ লোহার কাজের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস নির্মাণ ও সরবরাহ চলে। দিনমান চব্বিশ ঘণ্টা। প্রচুর লোক কাজ করে। তাদের আয় ভালো। দেশ বা রাজনীতি নিয়ে ভাববার বিন্দুমাত্র সময় তাদের নেই। আমাদের এলাকার প্রায় সব ব্যক্তিচালিত ইঞ্জিনবিহীন যানবাহনের সরবরাহকারী এই বগুড়া শহর। আশ্চর্য সব কর্মকাণ্ড। পরিবর্তনের কী ধারা! আর তাতে কীভাবে যুক্ত হয়ে পড়ছে আমজনতা! এরা অধিকাংশই কৃষক, সর্বহারা, খেটে খাওয়া মজুর। স্বউদ্যোগী এসব ব্যাপার অনেকটা সাশ্রয়ী, ইকোনমি। এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে সড়ক পাকা। ফলে লোকচলাচল বেশুমার। এসব যানবাহনের কারণে যাওয়া-আসা সহজতর। একটু প্রয়োজনেই তা করা যায়। মূল্যও কম। সবার পুষিয়ে যায়। যা হোক, কথাগুলো ঠিক রিপোর্টিংয়ের মতো শোনালেও পরিবর্তনের হাওয়াটা অনুধাবনের প্রয়াস থেকে এ প্রসঙ্গগুলো আনা।

প্রথমেই বলি, রাজনীতির নির্বাসন হয়েছে এখন সাধারণ অনেকের মধ্যে। ওসব নিয়ে ভাববার সময় ওদের তুলনামূলক কম। কিছু গুচ্ছ মানুষ রাজনীতি করছে। কারণ, তাদের অর্থ-প্রতিপত্তির মোহ ও প্রতিপাদ্য অকুস্থল রাজনীতি। ওটা তাদের ব্যবসা। কার্যত, রাজনীতি বা রাজার নীতি এখন সাধারণ মানুষকে কিছু দিচ্ছে না। সে পরোয়াও কেউ করছে না। করবে কেন? সে পর্যায়ে রাজনীতিটা নেই এখন। পৌঁছাচ্ছেও না। রাজনীতি করায়ত্ত হয়ে গেছে। কারা ওটা করে, কেন করে— সাধারণ মানুষ তা বুঝে গেছে। ছেড়েও দিয়েছে তারা। যদি বলা হয়, সামনে তো নির্বাচন— ভোট কাকে দিবি? কই, কোনো উত্তর পাই না। কারো কারো উত্তরের মধ্যে বেপরোয়া ভাব। ওসব দিয়ে কী হয়! গ্রামের এমন চিত্র যখন, তখন শহরে অন্য চিত্র। সেখানে কাড়াকাড়ি, টানাটানি। হাতাহাতিও। একটা অলস জীবনের প্রত্যাশা— তাদের মধ্যে। ধরে-বেঁধে একটা চাকরি পেলে, বসে খাওয়া। সেজন্য লাইন লবিং করা। আবার হুটহাট করে এখানে-ওখানে পরীক্ষা দিয়ে একটা সার্টিফিকেট বাগানোর চেষ্টা। ওটা বাগিয়ে নিলে একটা চাকরি। আর সেজন্য রাজনীতি। এখন ছাত্র রাজনীতি হোক, পাড়ার রাজনীতি হোক, শহরের রাজনীতি হোক— এটাই ধারা। স্বার্থ হাসিল। ইনভেস্টমেন্ট। পপুলারিটি বা জনসমর্থন তেমন প্রয়োজন হয় না। জনগণের কাছে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। এর দুটো কারণ, টাকা দিয়ে ভোট কেনা অথবা পার্টিজান হয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করা। কোনোটার জন্যই জনসমর্থন তেমন প্রয়োজন নেই। আশ্চর্য হয়ে বোঝা যায়, করপোরেট ব্যবস্থাটা শুধু ব্যক্তিকে ধ্বংস করে না, প্রতিষ্ঠানকেও ধ্বংস করে, ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। ফলে গণতন্ত্র এখন বিপত্তির মুখে। আর গণতন্ত্র বিপত্তির মুখে পড়লে, সংস্কৃতি বলে কিছু থাকে না। একই সঙ্গে অনেক কিছু বাঁধা। সংস্কৃতি না থাকলে নীতি-মূল্যবোধ বিব্রত হয়, বিচলিত প্রক্রিয়া শুরু হয়, তাতে অস্থিরতা বাড়ে, আগ্রাসন তৈরি হয়। অধিকার অপসৃত হয়। চতুর্দিকে নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করে। ছুঁয়ে যায় বিষাদ আর হতাশা। এগুলো সামষ্টিক থেকে ব্যষ্টিকের দিকে ধাবিত হয়। অন্ধকার ছেয়ে নেয়। আলো নিভে যায়। রাজনীতির জগৎটা যেন উঠে দাঁড়ানোর সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছে। ফলে অন্ধকার আর অনিরাপত্তা ব্যক্তি ও সমাজে প্রসারতা লাভ করে। এখানে উপরে যে পরিবর্তনের ধারার দিকে ইঙ্গিত করেছি তার সবটাই রাজনীতি ছাড়া, ব্যক্তি উদ্যোগের ফল। এটা দেখতে ভালো লাগে, ব্যক্তি-পরিশ্রমের ভেতর থেকে গড়ে ওঠা, কিন্তু তাতেও নিরাপত্তা নেই। ওর ভেতরে হতাশা আছে। অনিরাপত্তাও লুকিয়ে আছে। এখান থেকে বেরুনোটা খুব জরুরি। এই জরুরিত্ব চলতি রাজনীতিবিদরা বুঝছেন না। সেটার শুভ নেতৃত্ব হাতে নিচ্ছেন না। ফলে চতুর্দিকে নাভিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিব্রত ও অস্বস্তিও আছে। সমাজ-কাঠামোটা যেন সুস্থ পাটাতন পাচ্ছে না।

অনেক পরিবর্তন আছে, প্রকৃতির নিয়মে ঘটে। বাধ্যগত হয়ে ঘটে। অনিবার্যতার তাগিদে ঘটে। বাংলাদেশের পরিবর্তন হচ্ছে। আগেই বলেছি, যোগাযোগ বেড়েছে। কিন্তু মৌলিক সত্যটি যেন খুব দুর্বল, দুর্বলতরও বটে। অর্থনীতির মূল কাঠামো সবল নয়। আইনের শাসন কাঙ্ক্ষিত নয়। সুশাসন প্রত্যক্ষগোচর হয় না। সবার জন্য সমান কিছু প্রতিষ্ঠিত হয়নি, আজো। শিক্ষাব্যবস্থা নাজুক। নাগরিক সচেতনতা নেই। বাংলাদেশের মানুষ দ্বিতীয় জেনারেশনে পৌঁছেছে, তাদের অভিঘাত যথোচিত নয়। ফলে, দুর্নীতির প্রকোপ তীব্র। সুযোগের অপেক্ষা করে সবাই— যেখানে বঞ্চনা আর অন্যায় ওই সুযোগকে প্রশ্রয় দেয়। স্বার্থকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি জরুরি। পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা সর্বস্তরে কায়েম অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সেখানেও আবার রাজনীতির কথা আসে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হলে ওটা প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। সেটা সবাই বলছেন, করতেও পরামর্শ দেন, কিন্তু সদিচ্ছা নেই। কার্যকর পদক্ষেপও নেই। কথা ও কাজে মিল নেই। ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থা কণ্টকমুক্ত হওয়ার পথ পাচ্ছে না। এটার জন্য একজন সুবিবেচক, দার্শনিক প্রয়োজন। যার হাতে কঠোর ও কঠিন বীরত্ব থাকবে। চক্ষু অন্ধ, উন্মুক্ত সব দুয়ার, সবকিছু সমান তালে বাজবে। এই বাজানোর বাঁশি হাতে নিলে— রিকশাচালক মধু বা আমার গরুর ওষুধ বিক্রেতা বন্ধু তার প্রকৃত প্রবৃদ্ধিটা ঘটাতে সক্ষম হবে। বগুড়ায় সাধারণ বুদ্ধিতে ইঞ্জিন বানানো মানুষটিও বিরাট অর্থনীতির অংশীদার হয়ে সবার সঙ্গে দেশকে এগিয়ে নেবে। তাই চাই একজন বংশীবাদক এবং এই এক্ষণে তা প্রয়োজন।

টীকা : ট্যানারির ব্যবসা এবার মন্দা, খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা অসন্তুষ্ট। হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তরের ফলে আবার কোন মাসুল গুনতে হচ্ছে কারবারিদের! ব্যাংকে মূলধনের সুদের হার কম। পোস্টাফিস নাকি টাকা নেয় না। কৃষক ধানের দাম পায় না। চাল-চিনি আমদানি হয়। সাধারণ ক্রেতারা ক্ষুব্ধ। চাষি-শ্রমিক বিচলিত। মাদকের নেশা প্রসারিত। কেন এ রাষ্ট্রীয় অক্ষমতা সাধারণ মানুষ টের পাচ্ছে, মফস্বলের মানুষ শোষিত হয়, শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়, শ্রম দিয়ে মর্যাদাসূচক দাম পায় না— এগুলো নিত্যদিনের কথা। সবাই বলে। সবার মুখে শুনলাম। তবুও উন্নয়ন অদৃশ্য নয়। উন্নয়নের ধারায় মানুষ আছে। জাতির পিতার প্রতি অসম্মান শোনা যায় না। স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারে অনেকেই আশ্বস্ত। তবে আর পেছানো কেন!

২.

আর পুরনো কথা নয়। ওই দরিদ্র মানুষদের কাছে রাষ্ট্র পৌঁছাক। সমস্যার সমাধানের পথ পাক। সব বৈষম্য দূর হোক। বুদ্ধিজীবীরা জীবিত থাকেন, পরিকল্পিত রাষ্ট্র গঠনের তরে। সরকার তাদের আমলে নিক। অর্থ-পুঁজিতে সব চলে না। অন্তত, মেধাটা যার যে স্তরে, সেখানে কাজে লাগাক। এটা হচ্ছে না, তা বড় হতাশার। যে বুয়েট পাস করে প্রশাসনে আসবে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায়ী হবে— এটা কি কাম্য! এক্সপার্ট ব্যক্তির এক্সপার্টনেসের বুঝি এদেশে দাম নেই! সবার সামর্থ্যকে কাজে লাগালে ব্যবস্থার বিন্যাসটা সহজ হয়। সে সহজটা ‘সর্বাধিক লোকের সর্বাধিক সুখের মতো’। আর বিপরীতে অন্য কেউ যদি দখলি নিয়ে বা খবরদারি করে, তাহলে কিছুই হবে না। আমাদের দেশে ক্ষমতার খবরদারি চলে। কেউ কারো মেধাকে দাম দেয় না, সবজান্তা যেন সবাই; তাই অন্তত সরকার তা যদি গ্রহণ না করে তবে সবচেয়ে ভালো হয়। সিস্টেমটা যুগোপযোগী করা আশু প্রয়োজন। সরকারের এখন অন্তত তা বোঝা জরুরি। কারণ, ডিজিটালাইজেশন বা চলতি ‘উন্নয়ন’ রোডম্যাপে এই বাস্তব বুদ্ধিটার কোনো ব্যত্যয় নেই। এটা সরকারকে বুঝতে হবে। কথার কথা করে চলার আর সময় নেই। কারণ, ক্ষোভ যে অস্থির তার প্রকাশ তো মাঝেমধ্যে হচ্ছে, তা থেকে কর্তাব্যক্তিদের শিক্ষা নেওয়াটা জরুরি। এই সরকারকে বাঁচানোর কাজটা সবাই মিলেই করতে হবে। নইলে, স্তাবকদের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষও যে বিপদে পড়তে পারে, সেটা কী কেউ সত্য মনে করছে! কিছু না হলে অন্তত সে বিশ্বাসের পথটুকু আলোকিত হোক।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads