• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
শৃঙ্খলার জন্য চাই আইনি বাধ্যবাধকতা

পথ চলতে মানুষ প্রতিনিয়ত ট্রাফিক আইন ভাঙছেন

আর্ট : রাকিব

মতামত

শৃঙ্খলার জন্য চাই আইনি বাধ্যবাধকতা

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ২৭ আগস্ট ২০১৮

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার সম্প্রতি বলেছেন, বিদেশে ৯৮ শতাংশ মানুষ আইন মানলেও আমাদের দেশে ৯০ শতাংশ মানুষ ট্রাফিক আইন মানে না। তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটি অপ্রিয় হলেও সত্য। অতিসম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন এক আন্দোলন আমাদের বোধের দরজায় টোকা দিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, আবেগের উত্তেজনায় যে শিক্ষার্থীরা সড়কে শৃঙ্খলা আনতে বড়দের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সদিচ্ছা থাকলে নিয়ম কার্যকর করা সম্ভব। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, আন্দোলনকে ঘরে পাঠিয়ে দেশে চলমান ট্রাফিক সপ্তাহ চললেও দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন আসেনি। আসলে সমাজে আইন না মানার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। কথায় কথায় মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। যারা সুযোগমতো আইন মান্য করার বিষয়ে ভালো কথা বলছেন, তারাই নিজের প্রয়োজনের স্বার্থে সেই আইন অবলীলায় ভঙ্গ করছেন। সাধারণ মানুষের বেলায়ও একই কথা। যে শিক্ষার্থীরা আইনশৃঙ্খলার নজির স্থাপন করে দেখিয়েছে তারাও আইন ভঙ্গ করছে। আবার সাধারণ মানুষের পাশাপাশি যারা আইনের রক্ষক তারাও আইন অমান্য করে সর্বসাধারণকে আইন ভঙ্গে পরোক্ষভাবে সহায়তা করছেন।

পথ চলতে মানুষ প্রতিনিয়ত ট্রাফিক আইন ভাঙছেন। আইন ভেঙে উল্টোপথে গাড়ি চালাচ্ছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী-এমপি, ভিআইপি এবং শিক্ষার্থীরাও। ভাড়া আদায়ে গণপরিবহনে চলছে অরাজকতা। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশাচ্ছেন অসাধু অতিলোভী ব্যবসায়ীরা। হাসপাতাল-ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা, ভর্তি ফি এবং শয্যা ভাড়া  ইচ্ছামতো আদায় করা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে টাকার খেলা। ফাঁস হচ্ছে প্রশ্নপত্র। ফেসবুকে চলছে আইন অবমাননার প্রচারণা। সরকারি দফতরে চলছে ঘুষ আর অনিয়ম। কোনো ব্যক্তিকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করার বিধান থাকলেও তা মানছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আইন হাতে তুলে নিয়ে একের পর এক পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুনখারাবির মতো নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ যেন আইন ভঙ্গের প্রতিযোগিতা। সিগন্যাল না মেনে রাস্তায় চলাচল, ওভারব্রিজ থাকার পরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হওয়া, ফুটপাথে মোটরসাইকেল চালানো নিষেধ হলেও অবাধে চালানো, পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষেধ থাকা সত্ত্বেও হরদম চলছে যত্রতত্র ধূমপান। মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে কোথায় ঘুমিয়ে আছে আইন! মুখে বড় বড় নীতিকথা বললেও সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী, সচিব, সংসদ সদস্য, পুলিশ, সাংবাদিক, শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্রতিনিয়তই আইন ভঙ্গ করতে দেখা যায়। এসবের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হয় না। জেল, জরিমানা করে শাস্তি কার্যকর করা হয় না বলেই আইনের প্রতি সাধারণের ভয় উঠে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চপর্যায়ের কারো কারো আইন না মানার প্রবণতা থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগে শৈথিল্য এবং শহরে বসবাসের নিয়ম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই এসব ঘটছে। অনেক গবেষক-বিশ্লেষকের মতে ছোট অপরাধের জন্য বড় শাস্তির ব্যবস্থা কার্যকর হলে সমাজ থেকে অপরাধপ্রবণতা ৭৫ ভাগ কমে আসবে। যেমন আইন মানতে বাধ্য করা, অপরাধ প্রমাণিত হওয়া মাত্র শাস্তি দেওয়া, ভেজাল-ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম-দায়িত্বে অবহেলা-প্রতারণা-দখল-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ইত্যাদির ক্ষেত্রে অপরাধ যত ছোট পর্যায়ের হোক না কেন শাস্তি আর জরিমানা বেশি হলে এমন প্রবণতা কমতে পারে।

আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনায় যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে, তা শুধু উদ্বেগজনকই নয় কেউ কেউ এই অবস্থাকে ক্যানসারের চেয়েও ভয়াবহ ঘাতক হিসেবে অবিহিত করেছেন। কারণ বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় কমবেশি ১০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। পঙ্গুত্ববরণ করছে আরো চার গুণ বেশি মানুষ। আইন বা নিয়ম না মানার কারণে শুধু সড়ক দুর্ঘটনাই নয়, প্রতিদিন ঘটছে হাজারো অনিয়ম। মানুষের ভেতর সহমর্মিতা, ভালোবাসা, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতার বোধ কমে গেছে। আবার বেড়ে গেছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা। দুর্বল হয়ে পড়েছে সহানুভূতির জায়গাগুলো, অসহিষ্ণুতার মনোভাব প্রকট হয়ে উঠছে। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আস্থার সঙ্কট এই পরিস্থিতিকে আরো উসকে দিচ্ছে। এসব থেকে পরিত্রাণের জন্য দরকার সরকারের নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।

উন্নত বিশ্বে অপরাধ করলে তৎক্ষণাৎ শাস্তি দেওয়া হয় বলে সেসব দেশে রাস্তায় কেউ কলার বাকল বা চিপসের প্যাকেট ফেলার কথা ভাবতেও পারে না। আমাদের দেশে সময় লাগলেও আইন মান্যতার প্রবণতা সৃষ্টি করা অসম্ভব নয়। তবে এজন্য জনসংখ্যা অনুপাতে ট্রাফিক পুলিশসহ পুলিশ বাহিনী এবং অন্যসব নিয়ন্ত্রক সংস্থার জনশক্তির কলেবর বাড়াতে হবে।  তা না হলে শুধু আইন প্রণয়ন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। আইনের প্রতি জনগণের সচেতনতা, শ্রদ্ধা ও ভীতি বোধকে জাগরিত করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, নিয়ম না মানা বা নিয়ম ভঙ্গ করার প্রবণতা আমাদের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই জীবনচর্চায় আইনি বাধ্যকতা মানতে সবার আগে আমাদের অভ্যাস পরিবর্তন জরুরি। নিয়ম মানার মানসিকতা তৈরি করতে হবে সর্বস্তরে, সবার মাঝে। সর্বতোভাবে দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে। নিয়ম মেনে চললে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, অপরাধপ্রবণতা কমবে।

একটি সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থায় সরকার অন্যায় করলে প্রতিবাদ করার সুযোগ থাকবে, ভালো কাজ করলে সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিতে হবে। আবার বিরোধী দল সরকারের খারাপ কাজের প্রতিবাদ না করলে বা জনগণের পক্ষে ভূমিকা না রাখলে নিন্দা করা এবং সরকারের ভালো কাজে পাশে না থাকলেও নিন্দা জানানোর সুযোগ থাকবে। সর্বস্তরে অভ্যাসগত পরিবর্তনেই হতে পারে নৈতিক পরিবর্তনের চাবিকাঠি।

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads