• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

চামড়া শিল্প এবং ট্যানারির সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

  • শতাব্দী জুবায়ের
  • প্রকাশিত ২৮ আগস্ট ২০১৮

বাংলাদেশ যে কয়টি পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, তার মধ্যে চামড়া শিল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই চামড়া শিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর পালিত হওয়া ঈদুল আজহাই মূলত চামড়া শিল্পের প্রধান মৌসুম। সারা দেশে এই ঈদে লাখ লাখ গরু, মহিষ, ছাগল, উট জবাই হয়ে থাকে। এসবের চামড়া সংগ্রহ করে চামড়া ব্যবসায়ীরা। সারা দেশে সংগৃহীত চামড়া নিয়ে আসা হয় সাভারের ট্যানারিতে। এর আগে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ট্যানারি ছিল রাজধানীর হাজারীবাগে। কিন্তু সেখান থেকে প্রায় দেড় বছর আগে সাভারে এটি স্থানান্তর করা হয়। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। কিন্তু বিভিন্ন সময় সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বলা যাবে না যে, এখানে আসায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটেছে।

এখনো কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক ক্রোমিয়াম পুনরুদ্ধার বা রিকভারি ইউনিটও চালু হয়নি। বর্জ্যে বছরখানেক আগে যেভাবে নদী দূষিত হতো এখনো সেভাবেই হচ্ছে। বর্জ্যের বাঁধ ভেঙে বর্জ্য উপচে পড়ছে নদীতে। ফলে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে।

আবার অনেক পাইপলাইনের বর্জ্যও নদীতে গিয়ে পড়ছে। এই বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের রাসায়নিক পর্দাথ, যা পরিবেশের ক্ষতি করছে মারাত্মকভাবে। নদী দূষণের ফলে জীববৈচিত্র্যের খাদ্য-শৃঙ্খলে প্রভাব পড়ছে। ফলে নদীতে থাকা নানা প্রাণী মারা যাচ্ছে। এই দূষণের হাত থেকে নদী এবং পরিবেশ রক্ষা করা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। চামড়ার বর্জ্যে নদী দূষিত হচ্ছে তিনভাবে। প্রথমত, ভাগাড়ের বাঁধ বার বার ভেঙে বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। দ্বিতীয়ত, পাইপলাইন উপচে বর্জ্য বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের নালা দিয়ে নদীতে গিয়ে পড়ছে। তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারে রাসায়নিকের যথাযথ ব্যবহার না হওয়ায় বর্জ্য পুরোপুরি পরিশোধিত হচ্ছে না। মোটামুটি এই তিন কারণেই নদী দূষিত হয়। এখন এই তিনটি কারণ থেকে নদীকে রক্ষা করার জন্য মালিক পক্ষের দৃষ্টি দরকার। তারা চাইলেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, তরল বর্জ্য পরিশোধন করে যে পানি বের হয় তার মধ্যে ক্যানসার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক ক্রোমিয়াম রয়েছে। যেটি আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। এই দিকে ট্যানারি মালিকদের বিশেষভাবে নজর দেওয়া দরকার। আবার অন্যদিকে যারা চামড়া নিয়ে কাজ করে থাকে, সেই শ্রমিকরাও রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। অধিকাংশ শ্রমিকই নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছে। এ বিষয়টি নিয়ে যেমন মালিকরা সচেতন নয়, তেমনি শ্রমিকরাও। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার দিকে মালিকদের নজর দিতে হবে। তা না হলে শ্রমিক অসুস্থ হলে মালিকদের কারখানায় কাজই বন্ধ হয়ে যাবে।

দেখা যায়, যেদিন কোরবানি হয় সেদিন যাতায়াত সমস্যার কারণেই পশুর চামড়া ট্যানারিতে আসতে অনেক বিলম্ব হয়ে যায়। ফলে চামড়া নষ্ট হতে শুরু করে। তাই চামড়া যাতে দ্রুত ট্যানারিতে আসতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বসাকুল্যে ট্যানারির নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ মালিক-শ্রমিক সবাইকে সচেতনভাবে কাজ করতে হবে। তাহলেই চামড়ার বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব। আর দেশ চামড়া রফতানি করে পাবে বৈদেশিক মুদ্রা।

তবে কোরবানির পশুর চামড়ার একটি নির্ধারিত মূল্য ধরে দেওয়া হলেও প্রতিবারই শোনা যায় বেশি দামে চামড়া বেচাকেনার কথা। এর মাধ্যমে চামড়া বিদেশে পাচার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আমাদের দেশের ব্যবসায় অসততার কারণে সিন্ডিকেট গঠনের মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ঠকিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতাও অস্বীকার করা যাবে না।

সাধারণ মানুষ কিংবা ছোট ব্যবসায়ীদের পক্ষে পশুর চামড়া ধরে রাখা সম্ভব নয়। তার সুযোগ কোনো সিন্ডিকেট নিচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। পাশাপাশি পরিবেশগত মানদণ্ড মেনে চলার ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেগুলোকে দ্রুত মোকাবেলা করা এবং একটি কমপ্লায়েন্ট ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে পুরো চামড়া শিল্পকে উন্নীত করা দরকার। নানা সমস্যার পরও যখন চামড়া শিল্পে বিপুল সম্ভাবনা বিদ্যমান, তখন এর পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি। কেননা, বাংলাদেশের চামড়া শিল্পে ভালোমানের কাঁচামালের প্রাপ্যতা রয়েছে। ফলে ট্যানারির সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি চামড়া শিল্পের মতো এ সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে পারলে দেশের অর্থনীতি আরো সুদৃঢ় হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এদিকে নজর রাখা দরকার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads