• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক উন্নয়নে করণীয়

সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে আমরা কীভাবে কথা বলি, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ

আর্ট : রাকিব

মতামত

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক উন্নয়নে করণীয়

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ২৯ আগস্ট ২০১৮

ছাত্র-শিক্ষক সৌহার্দ্যপূর্ণ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শিক্ষণ-শেখানো পরিবেশের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ইংরেজিতে এটিকে বলে ‘র্যাপোর্ট বিল্ডিং’। বিষয়টি অবশ্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কম আলোচিত ও কম প্রশংসিত। কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুসম্পর্ক এবং একে অপরের সান্নিধ্যে আসা কার্যকর শিক্ষণ-শেখানো নিশ্চিত করে। আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা অনেক খ্যাতিমান, জ্ঞানী এবং বহুজান্তা শিক্ষক দেখেছি। কিন্তু তাদের সংস্পর্শে আসতে পারিনি, তাদের সঙ্গে খোলামেলা কোনো কথা বলতে পারিনি, কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারিনি। ফলে তারা যা পড়াতেন, তা না বুঝলেও কোনো প্রশ্ন করতে পারতাম না। অর্থাৎ বিশাল একটা পার্থক্য থেকেই যেত যা প্রকৃত শিক্ষণ-শেখানোর ক্ষেত্রে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখে না। তাই আধুনিক টিচিং-লার্নিংয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক থাকার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এটি হলে শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি আগ্রহী ও ইতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠে, শিক্ষকের প্রতিও একই ধরনের মনোভাব গড়ে তোলে। শিক্ষার্থীদের উন্নত প্রেষণা জোগায় এবং তাদের একাডেমিক সাফল্যেও তার প্রভাব পড়ে, যা নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই ব্যস্ত, চিন্তিত থাকে। শিক্ষকের প্রাপ্তি হচ্ছে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে পাঠে অংশগ্রহণ করানো। যত বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবে, সেটি তত ভালো পাঠদানের স্বীকৃতি। শিক্ষাদান একটি সামাজিক প্রচেষ্টা। শিক্ষণ-শেখানোর সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের ওপর। ব্যক্তিগত জীবনে আমরা দেখেছি অনেক শিক্ষককে রিটায়ারমেন্টের পর শিক্ষার্থীরা খুব একটা মনে রাখে না, আবার কিছু শিক্ষককে তারা জীবনভর স্মরণ করে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন পর্যায়ে।

সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ঘোষণা দিয়ে হয় না, এটি শিক্ষকের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। এই সম্পর্ক আমাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কর্মী সম্পর্ক স্থাপনে সিদ্ধহস্ত, কোম্পানি তাকে একটু বেশি পছন্দ করে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব অনেক কঠিন কাজকে সহজ করে দেয়। অনেক সময় অনেক অসম্ভবকেও সম্ভব করে তোলা যায়। সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে আমরা কীভাবে কথা বলি, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন নার্ভাস কিংবা মানসিক চাপের মধ্যে থাকি, তখন আমরা দ্রুত কথা বলি কিংবা অস্পষ্ট কথা বলি। এক্ষেত্রে আমাদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করে পরিস্থিতি সামলে নিতে হবে। মুক্তভাবে ও বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে কথা বলতে হবে। নরম স্বরে, শিক্ষার্থীরা যেভাবে কথা বললে বোঝে, সেভাবে কথা বলতে হবে। এতে র্যাপোর্ট বিল্ডিং করা সহজ হয়। জাপানের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের জীবনধর্মী ও বাস্তবমুখী কিছু দক্ষতা শেখানো হয়। নাচ, গান, ছবি আঁকা ইত্যাদি শেখানো হয়। বিপরীতে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমরা এগুলো থেকে অনেক দূরে। শুধু তা-ই নয়, আমরা বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা চালু করে দিয়েছি যা নিয়ে শিক্ষক, স্কুল, অভিভাবক সবাই ব্যস্ত, মহাব্যস্ত। শিক্ষার্থীরা আনন্দের চেয়ে বেশি থাকে চাপের মধ্যে, ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ভালো কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। বরং তৈরি হয় ভয়, টেনশন ও মেকি তথা লোক দেখানো একটি সম্পর্ক যা প্রকৃত শিক্ষার কথা বলে না।

 

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে কিছু কৌশল অবলম্বন করা উচিত : (ক) সব শিক্ষার্থীকে নাম ধরে ডাকতে পারা একটি চমৎকার কৌশল। শিক্ষার্থীদের নাম ধরে ডাকলে তারা সম্মানিত বোধ করবে। তখন শিক্ষার্থীও ভাববে, স্যার আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। কাজেই আমি যা করি তা তিনি খেয়াল করবেন। (খ) শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, পছন্দের বিষয় এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে জানতে হবে। তাতে তারা ভাববে, স্যার আমার প্রতি বিশেষ নজর দেন। (গ) সুযোগ হলে শ্রেণিকক্ষে আগে আসতে হবে, দেরিতে শ্রেণিকক্ষ ছাড়তে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গল্প করা যায়, অধিকক্ষণ কথা বলা যায়, তাতে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। (ঘ) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্ভব হলে অনলাইনেও যোগাযোগ রাখা যেতে পারে। (ঙ) লেকচার কমিয়ে আলোচনা বেশি করতে হবে, অ্যাকটিভ লার্নিংয়ে জোর দিতে হবে। (চ) মৌখিক প্রশংসার দ্বারা শিক্ষার্থীদের মন্তব্য ও প্রশ্ন করাকে পুরস্কৃত করতে হবে। (ছ) শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে খুব আনন্দিত ও উৎফুল্ল থাকবেন, যেন শিক্ষার্থীরা বোঝে শিক্ষাদানের বিষয় নিয়ে তাদের সংস্পর্শে এসে তিনি খুবই আনন্দিত এবং উৎফুল্ল। (জ) শিক্ষার্থীদের চোখে চোখ রাখতে হবে শুধু চেয়ে থাকার জন্য নয়, রাগ প্রকাশ করার জন্য নয়; বরং তার সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য। এতে শিক্ষকের উন্মুক্ততা, সততা এবং শিক্ষার্থীদের নজরে রাখার বিষয়টি প্রকাশ পায়। (ঝ) শিক্ষার্থীদের সম্মান দেখাতে হবে, তাদের সঙ্গে হাসতে হবে, মুখ ভার করে কিংবা গম্ভীর হয়ে থাকা ঠিক নয়। (ঞ) শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরেও চিনতে হবে। থাকতে হবে উচ্ছল, উৎফুল্ল যা বন্ধুত্বকে প্রদর্শন করে। (ঠ) এক জায়গায় বসে না থেকে শ্রেণিকক্ষের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে হবে যাতে শিক্ষকের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাহলে ভয়ের সম্পর্কটি, দূরত্বের বিষয়টি কেটে যাবে। (ড) শিক্ষার্থীদের অসুবিধা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। শিক্ষকের কাছে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ‘আই কন্টাক্ট’ কিছু কিছু শিক্ষার্থীর কাছে অস্বস্তির কারণ হতে পারে। ক্লাসে কাদের ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছে, তা জানার চেষ্টা করতে হবে এবং এক্ষেত্রে সময় দিতে হবে, যাতে তারা নিরাপদ বোধ করে এবং ধীরে ধীরে বিষয়টিতে অভ্যস্ত হয়। এতে শিক্ষার্থীরা  সম্মানিতবোধ করবে। (ঢ) শ্রেণিকক্ষের ভেতরের দেয়ালে থাকা উচিত পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক চিত্র যা একজন  শিক্ষক শিক্ষার্থীদের দিয়ে করিয়ে নেবেন। এটিও সম্পর্ক  স্থাপনের একটি চমৎকার উপায়।

একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উপরিউক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া জরুরি বলেই মনে করছি। আশা করি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক উন্নয়নে আমাদের শিক্ষকমণ্ডলীও আগামীতে যত্নবান হবেন।

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি ও সাবেক শিক্ষক, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads