• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ওঝা ও একটি গুহার কাহিনী

যুগ যুগ ধরে গুহা মানবজাতির অসংখ্য কল্যাণের পথ খুলে দিয়েছে

আর্ট : রাকিব

মতামত

ওঝা ও একটি গুহার কাহিনী

  • সালেহ মাহমুদ রিয়াদ
  • প্রকাশিত ৩০ আগস্ট ২০১৮

বাংলাদেশে গুহাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কেননা প্রায় পুরো দেশটি সমতলভূমি হওয়ায় গুহা সৃষ্টির তেমন সুযোগ হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কিছু গুহা রয়েছে। তবে এর মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের কাছে আলুটিলায় একটি গুহা দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। আসলে অনেক পর্যটক আলুটিলায় যান কেবল ওই গুহাটির একদিক থেকে ঢুকে অপরদিক দিয়ে বেরিয়ে আসার ‘দুঃসাহসিক’ অভিযান প্রদর্শন করার জন্য। শোনা যায়, একসময় ওই গুহায় একজন বিদ্রোহী আদিবাসী বীর লুকিয়ে থেকে যুদ্ধকৌশল নির্ধারণ করতেন।

যুগ যুগ ধরে গুহা মানবজাতির অসংখ্য কল্যাণের পথ খুলে দিয়েছে। একসময় মানুষ গুহাতেই বসবাস করত। আমরা ছিলাম গুহাবাসী। গুহা শব্দটি এসেছে ‘গুহ্য’ অর্থাৎ ‘গোপন’ শব্দ থেকে। আমরা একসময় হিংস্র প্রাণীদের ভয়ে গুহায় লুকিয়েছি। সভ্যতার সামনে পেছনে আসা-যাওয়ার পথে আমরা গুহা থেকে বেরিয়ে উদার আকাশের নিচে ঘরবাড়ি তৈরি করলাম আর অনেক প্রাণী আমাদের বাইরে আসতে দেখে গুহার ভেতর আশ্রয় নিয়েছে। কেননা মানুষের দুষ্ট স্বভাবের কথা ওরা ভালো করেই জানে। সমাজের সঙ্গে গোলমাল করে অথবা পরিবারের সঙ্গে বনিবনা না হলেও অনেকে ঘর ছেড়ে পাহাড় পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নেন। তাদের অনেকেই গুহার নিরাপদ আশ্রয়ে থাকাটাই নিরাপদ মনে করেন। পত্নীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে গুহাজীবনে শান্তির নীড় রচনা করেছেন— এমন লোকের সংখ্যাও নাকি একেবারে কম নয়। তবে বিপরীত দিক থেকে তাকিয়ে দেখলে আজ অবধি কোনো পত্নীকে নিজের ইচ্ছায় গুহাবাসী হতে দেখা যায়নি। জোর করেও কাউকে আজো গুহাবদ্ধ করা যায়নি।

তাই বলে গুহার গুরুত্ব কোনোভাবেই অবহেলা করার নয়। প্রাচীনকালে জ্ঞানলাভের একটি অন্যতম উপায় ছিল গুহায় বসে ধ্যান করা। ভারতবর্ষের প্রায় সব ঋষি, মুনি, সাধক, যাজক গুহায় বসেই তাদের কাঙ্ক্ষিত সিদ্ধি লাভ করেছেন। সম্ভবত তারা স্থানটির শান্ত নির্জন পরিবেশ, কোলাহলবিহীন নিস্তব্ধতা এবং লোকজনের হইচই না থাকায় সেখানে ধ্যান করতে বসতেন। আজকাল সাউন্ড পলুশন নামে একটি ভয়াবহ সাধনা-বিরোধী শব্দসাগরের ঢেউ এসে আমাদের জীবন প্রায় নিঃশেষ করে দিয়েছে। গুহার আশপাশে খুব বেশি না হলেও মাঝে-মধ্যে বানরের চিৎকার ও পাখিদের কূজন শোনা যেত। পাখির কল-কাকলি সাধকদের মনে হয়তো এক ধরনের প্রশান্তি এনে দিত। তবে হ্যাঁ, বানরের বাঁদরামি সবসময় সুখকর হবে— এমন কথা বলা যায় না। আরে, এরা তো সাধকদেরই পূর্বপুরুষ— গুহার ভেতর ধ্যানমগ্ন উত্তরপুরুষ মানবকে একটু বিরক্ত তো করতেই পারে!

ব্যতিক্রম ছিলেন গৌতমবুদ্ধ। তিনি ধ্যান করেছিলেন বোধিবৃক্ষের নিচে বসে, কখনো কোনো গুহার ভেতর নয়। আমাদের নবীজী অবশ্য হেরাপর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় আল্লাহর কাছ থেকে আদেশপ্রাপ্ত হন। আত্মরক্ষার জন্যও তিনি গুহার নিরাপদ আশ্রয় নির্বাচন করেছেন। এহেন গুহা কখনো কখনো ভয়ানক বিপদ ডেকে আনে। এই তো সম্প্রতি থাইল্যান্ডের গুহার ভেতর আটকে পড়েছিল দেশটির একটি কিশোর ফুটবল দল। এক্ষেত্রে অবশ্যই আমরা গুহাকে দায়ী করতে পারি না। দলটির কোচ তার কিশোর শিষ্যদের নিয়ে গুহাদর্শনে গুহার ভেতর যাত্রা করেছিলেন। তিনি গুহারূপে এতই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে, একসময় দেখা গেল তারা প্রায় তিন কিলোমিটার অভ্যন্তরে ঢুকে গেছেন। এদিকে শুরু হয়েছে মৌসুমি বৃষ্টিপাত। ফিরে আসার পথ হয়েছে রুদ্ধ। পরের শ্বাসরুদ্ধকর উদ্ধার অভিযানের কথা আমরা সবাই জানি। শেষপর্যন্ত সবাইকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও উদ্ধারকারীদের একজন অভিযানকালে মৃত্যুবরণ করেন। ব্যাপারটি অতিশয় বেদনাদায়ক তবে এতে গুহার নিজের কোনো ভূমিকা ছিল না। মানুষসহ জীবজগতের অসংখ্য প্রাণী গুহাকে নানাভাবে ব্যবহার করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অধিকাংশ ব্যবহারেই ব্যবহারকারী নিজের ভালোর জন্যই করে। তাই বলে গুহাকে কুমতলবে কাজে লাগানো হয় না— এমন নয়। সম্প্রতি আমরা এমন এক গুহা-ব্যবহারকারীর সংবাদ পেয়েছি, যে অতিশয় হীন উদ্দেশ্যে গুহাকে কাজে লাগিয়েছে।

গত ৯ আগস্ট ২০১৮ বাংলাদেশের খবর পত্রিকায় সংবাদটি প্রকাশিত হযেছে। খবরে প্রকাশ— ইন্দোনেশিয়ার এক ওঝা একজন মহিলাকে গুহার ভেতর আটকে রেখে পনেরো বছর ধরে যৌন নির্যাতন চালিয়েছে। মাত্র তেরো বছর বয়সের এক কিশোরীকে ‘জিনে ধরেছে’ বলে তার পরিবার এই ওঝার কাছে নিয়ে আসে। ‘জিন তাড়ানোর’ কথা বলে ওঝা মেয়েটিকে একটি গুহার ভেতর আটক করে। যা হোক, পুলিশ ২৮ বছর বয়সী মেয়েটিকে উদ্ধার করেছে। ঘটনার বিবরণ খুবই বেদনাদায়ক। নির্যাতনকারী ওঝা মেয়েটির মস্তিষ্কে এই মিথ্যা এমন শক্তভাবে সত্য করে গেঁথে দেয় যে, ওঝার সঙ্গে জিন আছে। এই জিন সবকিছু দেখতে পায়।

এক ভয়াবহ মিথ্যার জালে ফেলে ওঝা মহাশয় পনেরো বছর ধরে মেয়েটিকে গুহার ভেতর পাথর চাপা দিয়ে আটকে রাখে। এই ওঝা সম্ভবত মন্ত্রওঝা। দু’ধরনের ওঝার কথা শোনা যায়— এক ধরনের ওঝাদের বলা হয় বৈদ্যওঝা। এরা গাছ-গাছড়া, লতাপাতা ইত্যাদি ব্যবহার করে ভেষজ চিকিৎসা করে থাকে। আমাদের দেশের পার্বত্য এলাকায় এ ধরনের ওঝাদের দেখা যায়। দ্বিতীয় ধরনের ওঝারা মন্ত্রওঝা। এরা তন্ত্রমন্ত্র, দেব-দেবতা, ভূত-প্রেত প্রভৃতি লৌকিক-অলৌকিক বিশ্বাস এবং কুসংস্কারের কুহক সৃষ্টি করে চিকিৎসাবিদ্যা চালিয়ে থাকে। ইন্দোনেশিয়ার নির্যাতনকারী ওঝাটি এই দ্বিতীয় ধরনের।

মন্ত্রওঝাদের একটি অন্যতম ‘ওষুধ’ হচ্ছে জিনপরী ও ভূতপ্রেত। রোগী মহিলা হলে ‘ওর সঙ্গে জিন আছে’ আর রোগী পুরুষ হলে ‘ঘাড়ে পরী আছে’— এই দুটি মোক্ষম রোগচিহ্নের কথা বলে ‘চিকিৎসা’ চালায়। দরিদ্র অসহায় রোগীদের কাছে ভূত-পেত্নীর আসা-যাওয়া নিয়ম। এদের কাছে পরীটরী আসে না। পরীদের আবার এমন রূপের বর্ণনা দেওয়া হয় যে, অনেক পুরুষ রোগী পরীধরা রোগে ‘আক্রান্ত’ হওয়ার বাসনায় মগ্ন থাকে। আমরাও ছোটবেলায় জিনপরী আক্রান্ত রোগী দেখেছি; একইসঙ্গে দেখেছি মন্ত্রওঝাদের ভয়ানক সব ‘চিকিৎসা’ পদ্ধতি। সেসব পদ্ধতি এমনই অদ্ভুত ও ভূতপ্রেতমার্কা যে, মনে পড়লে আজো ভয়ে শিউরে উঠি। আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসগুলোতে ভূতপ্রেতের সীমাহীন প্রভাবের বহু কাহিনী এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ভূতপ্রেতের ভীতি ও করুণা ছাড়া আমরা যেন বাঁচতে পারি না। আমাদের দূরসম্পর্কিত এক পরমসুন্দর আত্মীয় আমৃত্যু একটি ঘরে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন এই তথ্য প্রচার করে যে, তার সঙ্গে পরী আছে। সুতরাং তিনি আর কোনো নারীকে বিয়ে করতে পারেন না। পরীমোহে নিমগ্ন পুরুষটি সত্য-সত্যই বিয়ে করেননি। আমরাও কোনো পরমরূপসী পরী তার ঘরে কিংবা আশপাশে দেখতে পাইনি। কুসংস্কারের প্রভাব কত প্রবল হতে পারে যে, আমাদের এই পরী-মোহিত শিক্ষিত আত্মীয়টি মৃত্যুর আগে একটি ইচ্ছাপত্রও রচনা করেছিলেন। তিনি সেই উইলে পরীবিবির সন্তানদের নামধাম লিখে তার সম্পত্তি ভাগবাঁটোয়ারা পর্যন্ত করে গিয়েছিলেন।

আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম গুহার গুণগান ও গুহা ব্যবহারের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক কাহিনী দিয়ে। গুহাকে কলঙ্কিত করার ইতিহাস যে নেই— এমন নয় তবে ইন্দোনেশিয়ার ওঝার দ্বারা গুহা এমনভাবে কলঙ্কিত হয়েছে যে, আমাদের বহুনন্দিত সভ্যতার অহঙ্কার ধুলোয় মিশে গেছে। গুহা অন্ধকারের প্রতীক হলেও অনেক আলোকিত ইতিহাসের আশ্রয় দিয়েছে। আমরা গুহা থেকে আমাদের সভ্যতা বের করে এনেছি বহু শতাব্দী আগে। আজো তবু গুহার টানে আমরা ছুটে যাই গুহার ভেতরে। তবে সেই গমন হয় কৌতূহলের আর আবিষ্কারের, গুহাকে অপকর্মে ব্যবহারের অভিপ্রায়ে নয়। ইন্দোনেশিয়ার ধর্ষক ওঝা অপরাধী প্রমাণিত হলে সে দেশের আইনে পনেরো বছর কারাবাসের সাজা পাবে। আমাদের প্রত্যাশা— সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে যেন কারাগারেই রাখা হয়— কোনো গুহার ভেতর নয়।

লেখক : রম্য লেখক

salehmahmoodriadh@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads