• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
দাম্পত্য অধিকার : আইন ও বাস্তবতা

দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতার ব্যাপার

আর্ট : রাকিব

মতামত

দাম্পত্য অধিকার : আইন ও বাস্তবতা

  • প্রকাশিত ৩০ আগস্ট ২০১৮

দম্পতি রকি ও মুক্তা (ছদ্মনাম)। বিয়ে হয় পারিবারিকভাবেই। উভয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছে। রকি প্রথম থেকেই স্ত্রীর প্রতি সন্দেহপ্রবণ। অফিস থেকে এসেই মোবাইল ফোন চেক করে। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে কেউ বাসায় এসেছিল কি-না। মুক্তা বুঝতে পারছে সে একটা বৃত্তের মধ্যে আটকা পড়েছে। তার সব যৌক্তিক ইচ্ছা, স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তার অধিকার স্বামী কেড়ে নিচ্ছে। ফলে মুক্তার জীবন যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। একদিন মুক্তা প্রতিবাদ করতেই স্বামী রকি শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। এ ঘটনার জের ধরে মুক্তা চলে যায় বাবার বাড়ি। মুক্তাকে ফিরিয়ে আনতে রকি দ্বারস্থ হয় শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু কিছুতেই মুক্তা আর ফিরে আসে না।

পারিবারিকভাবেই শান্ত’র সঙ্গে সুমির (ছদ্মনাম) বিয়ে হয়েছে মাস ছয়েক হতে চলল। কথা ছিল বৌভাত অনুষ্ঠান করে দু-এক মাসের মধ্যেই স্ত্রীকে ঘরে তুলে নেবেন। কিন্তু ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও সুমির শ্বশুরবাড়ি দেখা হয়নি। এদিকে সুমির পরিবার শান্ত’র পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সদুত্তর পাচ্ছে না। শান্তও সুমিকে স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। সুমির পরিবার খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তারা আইনগতভাবে এর সমাধান চায়।

বিয়ের পর স্ত্রী বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসে স্বামীর সংসারে ফিরতে চায় না। আবার স্ত্রীকে নাইওরে পাঠিয়ে স্বামীও আর তাকে সংসারে ফিরিয়ে নিতে চায় না। এটা আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র। তবে স্ত্রী সঙ্গত কারণ ছাড়া যদি স্বামীর সঙ্গে বসবাস বন্ধ করে দেয়, সেক্ষেত্রে স্বামী দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে (মুন্সী বজলুর রহিম বনাম সামসুন্নেসা বেগম, ১৮৬৭, ১১ এমআইএ, পৃষ্ঠা-৫৫১)। এ অবস্থায় অনেকে আবার তালাকও দিয়ে দেন। কিন্তু সেই তালাক কার্যকর হওয়ার আগে পারিবারিক আদালতের অধ্যাদেশ ১৯৮৫-এর বলে স্বামী বা স্ত্রীকে দাম্পত্য সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা মামলা করতে হয়।

দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতার ব্যাপার। এক্ষেত্রে যে পক্ষ মামলাটি করে তাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি স্বচ্ছ মনোভাব নিয়েই আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং তার জীবনসঙ্গী কোনো কারণ ছাড়াই ঘরে ফিরতে চান না। তবে স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে তালাক প্রক্রিয়া সম্পন্নকালে তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার করা না হলে এ মামলা চলে না (মুলখান বিবি বনাম ওয়াজির খান, ৫৯, পি.লাহ. পৃষ্ঠা-৭১০)।

এ মামলায় আদালত বিবেচনা করবেন যে, স্বামী বা স্ত্রী পরস্পরের প্রতি আরোপিত দায়িত্ব পালন করছেন কি-না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে ঘরে ফেরা সম্ভব নয়। এরকম হলে তালাক নেওয়ার ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী যেসব অধিকার দেওয়া হয়েছে তা প্রমাণ করতে পারলে স্বামী অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। আবার স্বামী যদি স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ সত্য প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আদালত আদেশ বা ডিক্রি জারি করতে পারেন (মোছা. মকবুলান বনাম রমজান, ১৯২৭, ২ লাক. পৃষ্ঠা-৪৮২)।

তবে স্বামী যদি সমাজচ্যুত কোনো কুখ্যাত সন্ত্রাসী বা মাস্তান হয়, সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর বিরুদ্ধে দাম্পত্য অধিকার মামলা চলে না এবং স্ত্রী স্বামীর ঘরে ফিরতে বাধ্য নয়। এ ছাড়া তাৎক্ষণিক দেনমোহর পরিশোধ করা না হলে স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য মিলনে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন স্ত্রী। এক্ষেত্রে স্বামী যদি দাম্পত্য অধিকার ফিরে পেতে মামলা করেন, তাহলে আনীত মামলাটি নাকচ করা হবে (রাহিলান বনাম সানাউল্ল্যা, ১৯৫৯, পি.লাহ. পৃষ্ঠা-৪৭০)।

আর স্বামী-স্ত্রীর ঘরসংসার করার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যদি শ্বশুরবাড়ির লোকজন এতে বাধা দেয়, তাহলে ফৌজদারি আদালতের আশ্রয় নেওয়া যায়। ফৌজদারি কার্যবিধি ১০০ ধারার বিধান অনুযায়ী তল্লাশি পরোয়ানার মামলা করে বন্দিদশা স্ত্রীকে মুক্ত করানো সম্ভব। তবে এ মামলায় দুটি ব্যতিক্রম রয়েছে— ক. বিয়েটি স্ত্রীর ইদ্দতকালে অনুষ্ঠিত হলে, দাম্পত্য মিলন ঘটে থাকলেও স্বামী দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য কোনো আদেশ বা ডিক্রি পাবে না; এবং খ. স্ত্রীর নাবালকত্বকালে বিয়েটি সম্পন্ন হওয়ার পর যদি বৈধভাবে তার বিচ্ছেদ ঘটে থাকে, তাহলে স্বামী তার বিরুদ্ধে কোনো ডিক্রি পাবে না। আবার স্ত্রী নিম্নোক্ত কারণে স্বামীর দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার দাবি অস্বীকারকরত বিপরীত দাবি করতে পারে। সেগুলো হচ্ছে— স্বামীর নিষ্ঠুরতা; স্বামী থেকে পৃথক থাকার ক্ষমতা দান; আশু মোহরানা পরিশোধ না করা; স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামী কর্তৃক মিথ্যা অভিযোগ আনয়ন; স্বামীকে সমাজচ্যুতকরণ; বিয়ের মিথ্যা দাবি-সংক্রান্ত মামলা; ওয়াদা ভঙ্গের দাবি; এবং স্ত্রী অপহরণ।

দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবির ক্ষেত্রে আইনবিদদের মধ্যে রয়েছে দ্বিমত। বিভিন্ন মামলার নজিরেও ভিন্নমত পাওয়া গেছে। এতে অভিযোগ উঠেছে, কেউ যদি স্বাধীনচেতা হন, পূর্ণাঙ্গভাবে আলাদা থাকতে চান তাহলে সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একতরফা দাবির কোনো সংঘাত হবে কি-না। এক্ষেত্রে ১৮ বিএলডি, ১৯৯৮, হাইকোর্ট, পৃষ্ঠা ৩১-এ খোদেজা বেগম বনাম মো. সাদেক মামলার রায়ে বলা  হয়েছে, ‘দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য একটি পারস্পরিক অধিকার। সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদের সঙ্গে এটি বৈষম্যমূলক কিংবা অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’ অন্যদিকে হোসেন জাহান বনাম মো. সাজাহান মামলায় (১৮ বিএলডি, ১৯৯৮, হাইকোর্ট, পৃষ্ঠা-৩২১) বলা হয়, ‘বিনা কারণে যদি কোনো স্ত্রী দাম্পত্য মিলনে অস্বীকার করেন তাহলে স্বামী মামলা করতে পারেন।’ তবে ‘কোনো দেওয়ানি বা ধর্মীয় আইনের চোখে ইসলামী আইন অধিক কঠোর, যা একজন মহিলাকে তার বিবাহিত জীবনের অত্যাচার থেকে রক্ষা করে। ইসলামী আইনে এ অত্যাচার স্বামী কর্তৃক কেবল দৈহিক বা মানসিক অত্যাচার বোঝায় না, স্বামীর সঙ্গে বসবাসে স্ত্রীর অনিচ্ছুকতাও বোঝায়।’

দাম্পত্য পুনরুদ্ধার মোকদ্দমার ক্ষেত্রে স্বামীরা এ প্রতিকার বেশি চাইলেও ৯০ শতাংশ ডিক্রিই স্ত্রীর পক্ষে যায়। আর এ ধরনের প্রতিকারে স্বামী বা স্ত্রীর দাম্পত্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডিক্রি কোনো পক্ষ পেলেও সাধারণত ডিক্রি কার্যকর হয় না। এ ডিক্রি প্রাপ্তির ফলে কেবল স্বামী বা স্ত্রীর ওপর দাম্পত্য অধিকারটি স্থাপন করা যায়, যাতে অপর পক্ষ দ্বিতীয় বিয়ে কিংবা বিনা কারণে তালাক না চান। তবে তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জোর করা যায় না। এতে সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়। কিন্তু কেউ যদি তালাক চান, তাহলে আলাদাভাবে তা কার্যকর করতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর ঘর-সংসার করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যদি শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাতে বাধা দেয়, তাহলে ফৌজদারি আদালতের আশ্রয় নেওয়া যাবে।

সিরাজ প্রামাণিক

আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

seraj.pramanik@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads