• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
মকবুল হোসেনের সেঁওতি গ্রন্থাগার

মকবুল হোসেন ও তার সেঁওতি গ্রন্থাগার

সংগৃহীত ছবি

মতামত

মকবুল হোসেনের সেঁওতি গ্রন্থাগার

  • প্রকাশিত ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আজহারুল আজাদ জুয়েল

বাড়ি নয় যেন লাইব্রেরি, ঘর নয় যেন বইয়ের বাগান। পুরো বাড়ির যত ঘর আছে সবটিতেই বই আর বই। কতগুলো বই? এর সঠিক হিসাব নেই। হতে পারে সেটা দশ থেকে পনেরো হাজার। তবে মকবুল হোসেনের ভাষ্য অনুযায়ী দশ হাজারের নিচে নয়। ঘরে ঘরে ঠাসা, আলমারির পর আলমারিতে থরে থরে সাজানো-গোছানো হাজারো বই। যেন বইয়ের খনি। একজন সাধারণ ব্যক্তির বাড়িতে এত বই একসঙ্গে দেখে যে কারোই ভালো না লেগে পারে না।

একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত পাঠাগার এটা, যার নাম রাখা হয়েছে সেঁওতি গ্রন্থাগার। এই পাঠাগার যার, তিনি দিনাজপুর জেলা শহরের পরিচিত মুখ। একদা রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশের বহুমুখী আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। এখন রাজনীতিতে নেই, আছেন লাইব্রেরিতে। ব্যক্তিগত বিশাল লাইব্রেরিতে বিশাল বইয়ের ভান্ডার তার। সেখানে গল্প, ছোট গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, ভ্রমণ, ধর্মীয় বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়ের বিশাল বইয়ের ভান্ডারে সময় কাটে তার। মকবুল হোসেন বলেন, ‘যখন হাফ প্যান্ট পরে স্কুলে যেতাম, সেই সময় থেকেই দিনাজপুরের বিখ্যাত আর্য পুস্তকাগারে বসতাম। সেখানে পিটি হতো। সেই পিটিতে অংশ নিতাম। পিটি শেষে সেখানে বসে বই পড়তাম। যখন একটু বড় হলাম, তখন বই পড়াটা নেশায় পরিণত হলো। সেই থেকে বই পড়ছি তো এখনো বইয়ের মধ্যেই আছি।’

৭২ বছর বয়সী বই সংগ্রাহক মকবুল হোসেন নিজে সক্রিয় থেকেছেন রাজনীতি, বইপড়া, একাডেমিক শিক্ষাসহ নানান কর্মকাণ্ডে। তিনি দিনাজপুর একাডেমি থেকে ম্যাট্রিক, ঠাকুরগাঁও বিডি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রি পাস করেন। ঠাকুরগাঁও বিডি কলেজ ছাত্র সংসদের ম্যাগাজিন সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে ছিল তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অনেক উত্থান-পতন। এখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে আছেন।

মকবুল হোসেনের শিক্ষাজীবনের একটি বড় অংশ ছিল দিনাজপুরের আর্য পাঠাগার। এখানে সাহিত্য, ধর্মীয় ও রাজনীতির বই বেশি পড়েছেন। মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, মুজিববাদ, এঙ্গেলস, গান্ধীসহ বিশ্বের অনেক খ্যাতিমান রাজনীতিকের জীবনী সংবলিত বই ছিল এই পাঠাগারে। এসব বই পড়ার ঝোঁক ছিল মকবুল হোসেনের। বই পড়ার ঝোঁক থেকেই বই সংগ্রহের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং দিনাজপুর শহরের সর্দারপাড়ার বাড়িতে ব্যক্তিগত পাঠাগার গড়ে তোলেন। তার পাঠাগারে মুসলমানদের পবিত্র কোরান শরীফ যেমন আছে, তেমনি আছে হিন্দুদের পবিত্র গীতা, খ্রিস্টানদের পবিত্র বাইবেল, বেদ, ইঞ্জিলসহ প্রধান প্রধান সব ধর্মের বই। কবিতা, গল্প, উপন্যাসসহ শিশু সাহিত্য, সাহিত্যের নানান দিগন্তের বহুবিধ বিষয়ভিত্তিক বই।

বই পড়ার পাশাপাশি এই পাঠাগারে মঝে মাঝে সাহিত্যের আসর বা আড্ডা বসিয়ে থাকেন মকবুল হোসেন। আসরে স্বরচিত গল্প, কবিতা পাঠ করে থাকেন স্থানীয় সাহিত্যকর্মীরা। ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর সেঁওতি গ্রন্থাগারে অনুষ্ঠিত এক আড্ডায় ভারতের বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষক অধ্যাপক অভ্র বসু ও অধ্যাপক শ্রীলা বসু উপস্থিত ছিলেন। তারা নিজেরাও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি এবং দুই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। সেদিন অধ্যাপক অভ্র মণ্ডল বলেছিলেন, দুই বাংলার মানুষ পলিটিক্যালি বিচ্ছিন্ন হলেও সংস্কৃতিতে বিচ্ছিন্ন নয়। যখন পলিটিক্যালি এক ছিলাম তখন বাঙালিও এক ছিলাম। ১৯ শতকে ঠাকুর পরিবার ‘ভারতী’ আর বঙ্কিম চন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ বের করতেন। এভাবে আমাদের সংস্কৃতির লড়াই এগিয়ে চলত।

শ্রীলা বসু বলেন, আমরা আমাদের বাংলাকে খুঁজছি। বিভিন্ন মন্দির, শিল্প ও ইতিহাসের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের ঐতিহ্যের বাংলাকে খুঁজছি। আমরা রাজশাহী, দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় যে মন্দির দেখেছি তাতে ঐতিহ্যগত মিল খুঁজে পেয়েছি। মন্দিরের কারুকার্যে ইসলামিক টেকনিক, ইসলামী শিল্প ব্যবহার করা হয়েছে। যারা এটা করেছেন তাদের মধ্যে এটা হিন্দু, ওটা মুসলিম এ ধরনের ভাবনা কাজ করেনি। কিন্তু ইংরেজরা এদেশে আসার পর এই ভাবনা ঢুকিয়ে দিয়েছে। একটা সময় গ্রাম এবং শহরের পার্থক্য বোঝা যেত না। কিন্তু ইংরেজ এসে কলকাতাকে রাজধানী করার পর থেকে শহর আর গ্রামের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিয়ে আমাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে দিয়েছে।

সেঁওতি গ্রন্থাগারের সেই সাহিত্য আড্ডায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মকবুল হোসেন নিজেই। আড্ডায় আরো অনেক গুণী মানুষ উপস্থিত ছিলেন। ওই আয়োজনটিকে এই গ্রন্থাগারের সেরা অধ্যায় বলে মনে করেন মকবুল হোসেন। তার মৃত্যুর পর গ্রন্থাগারের বইগুলো যেন সংরক্ষিত থাকে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।

সেঁওতি গ্রন্থাগার প্রসঙ্গে ড. মাসুদুল হক বলেন, ব্যক্তিগত সংগ্রহের বই দিয়ে মকবুল হোসেন যে বিশাল পাঠাগার গড়েছেন তা অনন্য নজির হিসেবে কাজ করবে এবং এই কাজের মধ্য দিয়ে তিনি দীর্ঘ জীবন মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। দিনাজপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্বরূপ বকসী বাচ্চু বলেন, মকবুল ভাইকে সবাই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সম্প্রতি একজন কবি হিসেবেও জানে। কিন্তু তিনি যে একজন বড় বই সংগ্রাহক সে বিষয়টি সাধারণ লোকেরা জানত না। মকবুল হোসেনের এই অনন্য কর্ম সমাজকে আলোকিত করবে তাতে সন্দেহ নেই।

মকবুল হোসেনের সেঁওতি গ্রন্থাগার

আজহারুল আজাদ জুয়েল

বাড়ি নয় যেন লাইব্রেরি, ঘর নয় যেন বইয়ের বাগান। পুরো বাড়ির যত ঘর আছে সবটিতেই বই আর বই। কতগুলো বই? এর সঠিক হিসাব নেই। হতে পারে সেটা দশ থেকে পনেরো হাজার। তবে মকবুল হোসেনের ভাষ্য অনুযায়ী দশ হাজারের নিচে নয়। ঘরে ঘরে ঠাসা, আলমারির পর আলমারিতে থরে থরে সাজানো-গোছানো হাজারো বই। যেন বইয়ের খনি। একজন সাধারণ ব্যক্তির বাড়িতে এত বই একসঙ্গে দেখে যে কারোই ভালো না লেগে পারে না।

একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত পাঠাগার এটা, যার নাম রাখা হয়েছে সেঁওতি গ্রন্থাগার। এই পাঠাগার যার, তিনি দিনাজপুর জেলা শহরের পরিচিত মুখ। একদা রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশের বহুমুখী আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। এখন রাজনীতিতে নেই, আছেন লাইব্রেরিতে। ব্যক্তিগত বিশাল লাইব্রেরিতে বিশাল বইয়ের ভান্ডার তার। সেখানে গল্প, ছোট গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, ভ্রমণ, ধর্মীয় বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়ের বিশাল বইয়ের ভান্ডারে সময় কাটে তার। মকবুল হোসেন বলেন, ‘যখন হাফ প্যান্ট পরে স্কুলে যেতাম, সেই সময় থেকেই দিনাজপুরের বিখ্যাত আর্য পুস্তকাগারে বসতাম। সেখানে পিটি হতো। সেই পিটিতে অংশ নিতাম। পিটি শেষে সেখানে বসে বই পড়তাম। যখন একটু বড় হলাম, তখন বই পড়াটা নেশায় পরিণত হলো। সেই থেকে বই পড়ছি তো এখনো বইয়ের মধ্যেই আছি।’

৭২ বছর বয়সী বই সংগ্রাহক মকবুল হোসেন নিজে সক্রিয় থেকেছেন রাজনীতি, বইপড়া, একাডেমিক শিক্ষাসহ নানান কর্মকাণ্ডে। তিনি দিনাজপুর একাডেমি থেকে ম্যাট্রিক, ঠাকুরগাঁও বিডি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রি পাস করেন। ঠাকুরগাঁও বিডি কলেজ ছাত্র সংসদের ম্যাগাজিন সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে ছিল তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অনেক উত্থান-পতন। এখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে আছেন।

মকবুল হোসেনের শিক্ষাজীবনের একটি বড় অংশ ছিল দিনাজপুরের আর্য পাঠাগার। এখানে সাহিত্য, ধর্মীয় ও রাজনীতির বই বেশি পড়েছেন। মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, মুজিববাদ, এঙ্গেলস, গান্ধীসহ বিশ্বের অনেক খ্যাতিমান রাজনীতিকের জীবনী সংবলিত বই ছিল এই পাঠাগারে। এসব বই পড়ার ঝোঁক ছিল মকবুল হোসেনের। বই পড়ার ঝোঁক থেকেই বই সংগ্রহের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং দিনাজপুর শহরের সর্দারপাড়ার বাড়িতে ব্যক্তিগত পাঠাগার গড়ে তোলেন। তার পাঠাগারে মুসলমানদের পবিত্র কোরান শরীফ যেমন আছে, তেমনি আছে হিন্দুদের পবিত্র গীতা, খ্রিস্টানদের পবিত্র বাইবেল, বেদ, ইঞ্জিলসহ প্রধান প্রধান সব ধর্মের বই। কবিতা, গল্প, উপন্যাসসহ শিশু সাহিত্য, সাহিত্যের নানান দিগন্তের বহুবিধ বিষয়ভিত্তিক বই।

বই পড়ার পাশাপাশি এই পাঠাগারে মঝে মাঝে সাহিত্যের আসর বা আড্ডা বসিয়ে থাকেন মকবুল হোসেন। আসরে স্বরচিত গল্প, কবিতা পাঠ করে থাকেন স্থানীয় সাহিত্যকর্মীরা। ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর সেঁওতি গ্রন্থাগারে অনুষ্ঠিত এক আড্ডায় ভারতের বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষক অধ্যাপক অভ্র বসু ও অধ্যাপক শ্রীলা বসু উপস্থিত ছিলেন। তারা নিজেরাও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি এবং দুই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। সেদিন অধ্যাপক অভ্র মণ্ডল বলেছিলেন, দুই বাংলার মানুষ পলিটিক্যালি বিচ্ছিন্ন হলেও সংস্কৃতিতে বিচ্ছিন্ন নয়। যখন পলিটিক্যালি এক ছিলাম তখন বাঙালিও এক ছিলাম। ১৯ শতকে ঠাকুর পরিবার ‘ভারতী’ আর বঙ্কিম চন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ বের করতেন। এভাবে আমাদের সংস্কৃতির লড়াই এগিয়ে চলত।

শ্রীলা বসু বলেন, আমরা আমাদের বাংলাকে খুঁজছি। বিভিন্ন মন্দির, শিল্প ও ইতিহাসের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের ঐতিহ্যের বাংলাকে খুঁজছি। আমরা রাজশাহী, দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় যে মন্দির দেখেছি তাতে ঐতিহ্যগত মিল খুঁজে পেয়েছি। মন্দিরের কারুকার্যে ইসলামিক টেকনিক, ইসলামী শিল্প ব্যবহার করা হয়েছে। যারা এটা করেছেন তাদের মধ্যে এটা হিন্দু, ওটা মুসলিম এ ধরনের ভাবনা কাজ করেনি। কিন্তু ইংরেজরা এদেশে আসার পর এই ভাবনা ঢুকিয়ে দিয়েছে। একটা সময় গ্রাম এবং শহরের পার্থক্য বোঝা যেত না। কিন্তু ইংরেজ এসে কলকাতাকে রাজধানী করার পর থেকে শহর আর গ্রামের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিয়ে আমাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে দিয়েছে।

সেঁওতি গ্রন্থাগারের সেই সাহিত্য আড্ডায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মকবুল হোসেন নিজেই। আড্ডায় আরো অনেক গুণী মানুষ উপস্থিত ছিলেন। ওই আয়োজনটিকে এই গ্রন্থাগারের সেরা অধ্যায় বলে মনে করেন মকবুল হোসেন। তার মৃত্যুর পর গ্রন্থাগারের বইগুলো যেন সংরক্ষিত থাকে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।

সেঁওতি গ্রন্থাগার প্রসঙ্গে ড. মাসুদুল হক বলেন, ব্যক্তিগত সংগ্রহের বই দিয়ে মকবুল হোসেন যে বিশাল পাঠাগার গড়েছেন তা অনন্য নজির হিসেবে কাজ করবে এবং এই কাজের মধ্য দিয়ে তিনি দীর্ঘ জীবন মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। দিনাজপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্বরূপ বকসী বাচ্চু বলেন, মকবুল ভাইকে সবাই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সম্প্রতি একজন কবি হিসেবেও জানে। কিন্তু তিনি যে একজন বড় বই সংগ্রাহক সে বিষয়টি সাধারণ লোকেরা জানত না। মকবুল হোসেনের এই অনন্য কর্ম সমাজকে আলোকিত করবে তাতে সন্দেহ নেই।

লেখক :  সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads