• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস

শিক্ষা নিয়ে সামান্য কথন

  • মো. কায়ছার আলী
  • প্রকাশিত ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

‘বিদ্যা বড় অমূল্য ধন, সবার চেয়ে দামি। সকাল বিকাল পড়তে এসে জেনেছি তা আমি। মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই। কোনোদিন কেউ যেন বলতে না পারে তোমার কোনো বুদ্ধি নাই, ও রহমত ভাই।’

আজ থেকে প্রায় ৪০-৪২ বছর আগে এদেশে  াধারণ মানুষের মুখে মুখে ছিল ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার এই কালজয়ী গানটি। দস্তখত শব্দের অর্থ স্বাক্ষর বা সই বা ঝরমহধঃঁৎব যারা পড়তে ও লিখতে পারে, সাধারণত তাদেরকেই খরঃবৎধঃব হিসেবে গণ্য করা হয়। আজ ৮ সেপ্টেম্বর, আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। ১৯৬৫ সালে ইরানের তেহরানে ইউনেস্কোর উদ্যোগে ৮৯টি দেশের শিক্ষাবিদ, শিক্ষামন্ত্রী ও পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে আলোচনা করা হয় পৃথিবীর বর্তমান বিস্ময়কর সভ্যতা শিক্ষার অবদান নিয়ে। শিক্ষা উন্নয়নের পূর্বশর্ত, শ্রেষ্ঠত্বের নিয়ামক। মানবসম্পদ উন্নয়নে এর কোনো বিকল্প নেই। আধুনিক বিশ্বে সব আবিষ্কার ও উন্নয়নের মূূলমন্ত্র হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাহীন মানুষ আর পশুতে কোনো তফাত নেই। যার শিক্ষা নেই, বলা যায় তার কিছু নেই। সম্মেলনে বিশ্বের সাক্ষরতা পরিস্থিতির উদ্বেগজনক অবস্থা, শিক্ষা, শিক্ষাজীবন, জীবিকা ও বয়স্ক নিরক্ষরদের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। শিক্ষা ও জীবিকা পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলে উল্লেখ করে নিরক্ষরতাকে উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করে তা দূরীকরণে জোর প্রয়াস নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

মানবসম্পদ উন্নয়নে অব্যাহত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দিবসটি সারা বিশ্বের মতো যথাযোগ্য মর্যাদায় আমাদের দেশেও নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে (র্যালি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা সভা) দিবসটি পালিত হচ্ছে। ইউনেস্কো পরবর্তী বছর থেকে সারা বিশ্বে জনগণের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালানোর জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। সাক্ষরতা হলো সব ধরনের সফলতার মূলনীতি। প্রতি বছরের মতো এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ষরঃবৎধপু রহ ধ ফরমরঃধষ ড়িৎষফ. সাক্ষরতার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনের জন্য ইউনেস্কো প্রাণপণ চেষ্টা করলেও, এরপরেও বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা নিরক্ষর (নারীদের মধ্যে বেশি)। এশিয়া ও আফ্রিকায় রয়েছে আটটি দেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশও একটি। পৃথিবীর অনেক পিছিয়ে থাকা দেশ অভিযান আকারে সাক্ষরতা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, নিকারাগুয়া, লাওস ও ভিয়েতনামে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে স্বাক্ষর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগের ফলে আমাদের দেশেও পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

মানুষ সামাজিক ও শ্রেষ্ঠ জীব। সিগমন্ড ফ্রয়ডের তত্ত্ব মতে, প্রতিটি শিশুই জন্ম নেয় একটি পরিষ্কার শ্লেভ নিয়ে, যার ওপর দাগ পড়তে থাকে পরিবেশের প্রভাবে। এই পরিবেশ সাধারণত গড়ে ওঠে শিক্ষার ওপর ভিত্তি করেই। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই হলো শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগত জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হলো সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। অন্যভাবে বলা যায়, শিক্ষা হলো বিকশিত ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ। বাংলায় শিক্ষা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ শাস ধাতু থেকে, যার অর্থ হচ্ছে শাসন করা বা উপদেশ দান করা। শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ ঊফঁপধঃরড়হ. শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ঊফঁপধৎব বা ঊফঁপধঃরড়হ থেকে, যার অর্থ ঞড় ষবধফ ড়ঁঃ অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে নিয়ে আসা। পবিত্র কোরআনের (প্রথম বাণী পড়) ভাষ্য অনুযায়ী, আল্লাহ্ আদম (আ.)-কে সব জিনিসের নাম শেখানোর মাধ্যমে জ্ঞান বা শিক্ষার সূচনা করেন। তারপর সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিরও পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগের দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, ‘শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।’ অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করা হলো শিক্ষা।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের নায়ক ব্যারিস্টার অমিত রায় বলেন, ‘কমল- হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার। পাথরের ভার আছে, আলোর আছে দীপ্তি।’

মহাকবি আল্লামা ইকবালের মতে, ‘মানুষের খুদী বা রুহের উন্নয়ন ঘটানোর প্রক্রিয়ার নামই শিক্ষা।’ মহাকবি মিলটনের মতে, ‘দেহ, মন ও আত্মার সমন্বিত উন্নতি সাধনই শিক্ষা।’ জন ডিউইর মতে, ‘পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর যোগ্যতাই শিক্ষা। তাই শিক্ষার জন্য চাই অক্ষরজ্ঞান। অক্ষরজ্ঞান না থাকলে মানুষ পড়বে বা শিখবে কীভাবে বা জ্ঞান অর্জন করবে কীভাবে? বাস্তববাদী ও যুক্তিবাদী প্রাণী মানুষ অন্যের কাছে শোনার চেয়ে বা জানার চেয়ে নিজের চোখে পড়তে বা জানতে বা শিখতে বেশি পছন্দ করে। প্রতিটি মানুষ শতভাগ নিজেকে বিশ্বাস করে।

এক সমীক্ষায় জানা যায়, তিন ঘণ্টা পর মনে থাকে— দেখে ৭২ শতাংশ, শুনে ৭০ শতাংশ, দেখে ও শুনে ৮৫ শতাংশ। আবার একই তথ্য তিন দিন পর মনে থাকে- দেখে ২৫ শতাংশ, শুনে ১০ শতাংশ, দেখে ও শুনে ৬৫ শতাংশ। এই সমীক্ষায় সহজেই অনুমান করা যায়, মানুষ দেখে ও শুনে বেশি মনে রাখতে পারে। আর এজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো মানুষকে দেখতে, পড়তে উৎসাহিত বা অনুপ্রাণিত করা। গভীর বিশ্বাসের জন্য প্রয়োজনে প্রতিটি মানুষকে বাধ্যতামূলক অক্ষরজ্ঞান দেওয়া জরুরি। ১৯৭১ সালে এদেশে শিক্ষার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০০১ সালের মার্চ মাসে আদমশুমারির রিপোর্ট অনুযায়ী শিক্ষার হার ছিল ৫১ দশমিক ৮ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৪৫ শতাংশ, ২০০৬ সালে ৪৪ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ, বর্তমানে ২০১৮ সালে ৭২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এই হার আরো বাড়াতে হবে। নিরক্ষরতা একটি জটিল ও ভয়াবহ সমস্যা। কোনো জাতির উন্নতির জন্য প্রথম এবং প্রধান উপকরণ হচ্ছে শিক্ষা বা অক্ষরজ্ঞান। নিরক্ষর লোকেরা ভালোমন্দ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তাই দেশের উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে। তারা ব্যক্তি জীবন ও জাতীয় জীবনেও অভিশপ্ত। এ অভিশাপ থেকে তাদের মুক্ত করতে না পারলে জাতীয় অগ্রগতি কিছুতেই সম্ভব নয়। নিরক্ষর লোকদের অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করে তোলার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বর্তমান সরকার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক এবং উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু করেছে। উদ্দেশ্য হলো— সারা দেশের মানুষকে আলোকিত করা। স্কুল ও কলেজের বাইরে পাহাড়ি এলাকা, দূরবর্তী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাওর, বাঁওড়, চর, প্রাকৃতিক বিপর্যস্ত এলাকা, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, পথশিশু, অতিবঞ্চিত শিশু, শ্রমিক, ঝরেপড়া, পিতৃ পরিচয়হীন সন্তান, হরিজন বা নিচুবর্ণের শিশু- এদের শিক্ষার জন্য ওয়ার্ড, এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্প বা হোস্টেল নির্মাণ করে শিক্ষার দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে। যারা বয়স্ক ও বিধবা ভাতা গ্রহণ করছেন, তাদেরও কাছাকাছি ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে স্বাক্ষর জ্ঞানের জন্য ছাত্র, শিক্ষক, সমাজকর্মী, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে জোটবদ্ধ কমিটি গঠন করে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের মানুষকে শিক্ষার উপকারিতা বোঝাতে হবে। সমাজের যে কোনো অংশের নাগরিকদের বাইরে রেখে দেশের উন্নয়ন হয় না। সরকারি বা বেসরকারি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের ঘুমন্ত বিবেককে জাগাতে হবে। বর্তমান সরকার বৃত্তিমূলক, কারিগরি এবং কর্মমুখী শিক্ষা (হাতে কলমে প্রশিক্ষিত) অর্থাৎ আত্মপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক শিক্ষা চালু করেছে। এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে সাধারণ শিক্ষার দ্বারা মানসিক বিকাশ ঘটলেও কর্ম ও জীবিকার নিশ্চয়তা থাকে না।

কর্মমুখী শিক্ষা সেই নিশ্চয়তা বিধান করে জীবনকে হতাশামুক্ত করে। প্রয়োজনের তুলনায় তা অতি সামান্য, বর্তমানে এ শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে এবং জনগণকে সচেতন করতে হবে। বিশ্ববাসী জানে আমরা বাঙালিরা ধ্বংসের মধ্যেও সৃষ্টি করতে পারি। ২০১৪ সালের এই দিনে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নারী ও কন্যাশিশুদের শিক্ষার প্রসারে সরকারপ্রধানের ভূমিকার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘সাহসী নারী’ আখ্যা দেন ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকাভা। শিক্ষা প্রসারের স্বীকৃতি বা বিশেষ অবদান রাখার জন্য ইউনেস্কোর দেওয়া স্মারক ঞৎবব ড়ভ চবধপব বা ‘শান্তি বৃক্ষ’ লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন তিনি এই শান্তি বৃক্ষ বিশ্বের সব নারী ও শিশুদের প্রতি উৎসর্গ করেন। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে আমি মনে করি, অক্ষর বা বর্ণমালার মাধ্যমে অর্জিত হয় শিক্ষা, শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব, বিপ্লব ঘটায় মুক্তি। অর্থাৎ জ্ঞানই শক্তি বা শিক্ষাই শক্তি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads