• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
কফি হাউজের আড্ডাটা আজ আর নেই

প্রয়াত কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে কণ্ঠে গানটি খ্যাতিলাভ করেছিল

আর্ট : রাকিব

মতামত

কফি হাউজের আড্ডাটা আজ আর নেই

  • প্রকাশিত ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মযহারুল ইসলাম বাবলা

বাংলা গানের প্রখ্যাত গীতিকবি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এবং মান্না দে’র গাওয়া জনপ্রিয় ‘কফি হাউজের আড্ডাটা আজ আর নেই...’ গানটির কল্যাণে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজের নাম-পরিচয় এবং কফি হাউজ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়েছিল বাংলাভাষী দুই বাংলার মানুষ। কলকাতার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় কফি হাউজের গুরুত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে উচ্চ ধারণাই জন্মেছিল জনমনে। বাস্তবে আশির দশক পর্যন্ত কফি হাউজ ছিল বাঙালি উঠতি তরুণ লেখক, গবেষক, কবি, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মী হতে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিবেদিতদের প্রাণকেন্দ্র। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার নিশ্চয় তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গানটি রচনা করেছিলেন। অপর দিকে গানটিতে কণ্ঠ দেওয়া বাংলা গানের প্রয়াত কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে অকপটে স্বীকার করেছেন, তিনি কখনো কফি হাউজে যাননি। অথচ তার কণ্ঠেই গানটি খ্যাতিলাভ করেছিল।

মান্না দে তরুণ বয়সেই বাংলা গানের শিল্পী না হয়ে সর্বভারতীয় প্রচার-প্রতিষ্ঠায় তার কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে’র সঙ্গে বোম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন। বোম্বের হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছেন, সুর দিয়েছেন। কিন্তু বোম্বের প্রতিষ্ঠিত গায়কদের অতিক্রম না করতে পেরে ফিরে এসেছিলেন বাংলা গানে। মাইকেল মধুসূদনের আদলে। মধুসূদন দত্ত ইংরেজি সাহিত্য রচনা ত্যাগ করে মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনা করে অমরত্ব লাভ করেছেন। মান্না দে পরিণত বয়সে তাই তার আক্ষেপের কথাগুলো গোপন না করে বলেছেন, ‘একমাত্র বাঙালি বলেই আমার হিন্দি উচ্চারণ মোহাম্মদ রফি, মুকেশদের ন্যায় হতে পারেনি।’ শ্লেষে আরো বলেছেন, ‘হিন্দি গানের ভুবনে আই ওয়াজ অ্যান আউট সাইডার।’ প্রত্যেক মানুষের পক্ষে তাৎক্ষণিক ধর্ম পরিবর্তন সহজ-সম্ভব হলেও জাতীয়তার পরিবর্তন অসম্ভব। জাতীয়তার ভিত্তি স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয়। জাতীয়তার ভিত্তিমূলেই ভাষা-সংস্কৃতি। যেটির পরিবর্তন অসম্ভব।

আশির দশকে কফি হাউজে গিয়েছিলাম, ওই গানের টানেই। কফি হাউজের বেয়ারাদের সবার অভিন্ন পোশাক মাথায় পাগড়ি। ঔপনিবেশিক আমলের খানসামাদের আদলে। পরিপাটি কফি হাউজ, হল্লা নেই, তবে গুঞ্জন আছে। টেবিলে টেবিলে বসা আগতরা মার্টন কাটলেট, মাখন মাখানো পাউরুটি ইত্যাদির সঙ্গে কফি পান করছেন। পরস্পরের সঙ্গে গুরুগম্ভীর আলোচনায় মগ্ন। এদিক-ওদিক তাকাবারও ফুরসত কারো নেই। সবাই আলাপে-বিতর্কে মশগুল। উঁচু ছাদ। দোতলা পুরোটা এবং তিনতলার প্রায় অর্ধেক এবং দু’পাশে লম্বা বেলকনি নিয়ে কফি হাউজ। উচ্চৈঃস্বরে কথা কেউ বলছে না বটে, তবে পরস্পরের সঙ্গে গম্ভীর আলাপ-বিতর্কের চাপা গুঞ্জন শোনা যেত। ব্যস্ত বেয়ারাদের নিঃশব্দ ছোটাছুটি, খাবার পরিবেশন সবই ছিল আকর্ষণীয়। অতীতের কফি হাউজের ধারাবাহিকতা আশির দশকের তরুণদের বহন করতে দেখেছি।

আমার দেখা সেই কফি হাউজ যে এতটা বদলে যেতে পারে সেটা কল্পনাও করিনি। অতি সম্প্রতি কলকাতা গিয়ে ভ্রমণসঙ্গীদের চাপে কফি হাউজে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো, সেটা এক কথায় ভয়াবহ। বদলে গেছে কফি হাউজ একশ’ আশি ডিগ্রিতে। কফি হাউজের কাঠামো নয়। বদলে গেছে কফি হাউজের পরিবেশ। নিচতলার গেটে ঢুকতেই দেখি নকশালবাড়ী আন্দোলনকারীদের স্মরণে পোস্টার দেয়ালে সাঁটা। এখনো আত্মত্যাগী আন্দোলনকারীদের স্মরণে রেখেছে দেখে ভালো লেগেছিল। চারু মজুমদার, কানু স্যান্নাল, জঙ্গল সাঁওতাল প্রমুখ নকশালবাড়ী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের স্মরণে পোস্টার এবং পোস্টারের বক্তব্যগুলো পড়ে এক ধরনের তৃপ্তি পেয়েছি। কফি হাউজের সিঁড়িতে ওঠার ডানপাশে সিগারেটের একমাত্র ছোট্ট দোকানটি ঘিরে তরুণ-তরুণীদের জটলা। পাটের মোটা দড়ির আগুন থেকে সবাই একে একে সিগারেট জ্বালাচ্ছে। তরুণীরা বোম্বেটে মার্কা বিজাতীয় পোশাকে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। কফি হাউজে ঢোকার পূর্বে নিচে তরুণ-তরুণীদের জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে উপরে ওঠা দেখে কিছুটা আঁচ করেছিলাম; তবে আমার জন্য যে আরো ভয়ানক চমক উপরে অপেক্ষা করছে সেটা বুঝতে পারিনি। দোতলায় উঠে কফি হাউজে ঢুকে দেখি কফি হাউজ সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। গেটের ডান পাশে কিছু মাঝ বয়সী নারী-পুরুষ বসে আছে আর বাম পাশের বিশাল অংশে বসে তরুণ-তরুণীরা অবিরাম সিগারেট ফুঁকছে। সেই ধোঁয়ায় কফি হাউজ আচ্ছন্ন। প্রায় প্রত্যেকে কাছে থাকা মোবাইল ফোন টিপছে, পরস্পর সেলফি তুলছে। খোশগল্প করছে পরস্পর। কফি হাউজ অবাধ ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থানে পরিণত। অথচ কলকাতাসহ সারা ভারতে পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ। আইনটির কঠোর প্রয়োগের কারণে ভারতে যত্রতত্র ধূমপান বহুপূর্বেই বন্ধ হয়েছে। অথচ কফি হাউজের চিত্রটি ঠিক বিপরীত। কাউন্টারের দেয়ালে ‘ধূমপান নিষিদ্ধ’ কাগজ সাঁটানো দেখেছি, কিন্তু সেটা কেউই তোয়াক্কা করছে না। তিনতলার বেলকনিতে যুগল তরুণ-তরুণীদের প্রকাশ্য বেলেল্লাপনা দেখেও হতাশ হয়েছি। কফি হাউজের তিনতলার অংশটি যেন সাক্ষাৎ নষ্টা বৃন্দাবন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃত কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, মেডিকেল কলেজ প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যবর্তী কফি হাউজ। পশ্চিম বাংলার সব প্রকাশনা সংস্থা এবং বই বিপণিগুলো কলেজ স্ট্রিট জুড়ে অবস্থিত। কলকাতার মুক্তবুদ্ধি চর্চা, জ্ঞানের চর্চা, প্রগতিশীল এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য কফি হাউজ ঐতিহ্যের স্মারক। তার বর্তমান দশা সর্বোপরি তারুণ্যের অবক্ষয় ও অপচয়ের চিত্রটিতে ফুটে উঠেছে কলকাতার সমাজ, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের দিকটি। যা পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বর্তমান বিপর্যয়েরই ইঙ্গিত বহন করে।

পশ্চিম বাংলার মধ্যবিত্তদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাটি হচ্ছে সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠা। সেই প্রতিষ্ঠালাভে বাঙালি মধ্যবিত্তের সনাতনী বলয়ে আটকে থাকলে সম্ভব হবে না। তাই জাতিগত ভাষা-সংস্কৃতি ত্যাগ করে সর্বভারতীয় হিন্দি-ইংরেজি রপ্ত করা চাই। ভারতীয় শাসক শ্রেণির নির্ধারিত পথেই বাঙালি মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীরা নিজেদের গড়ে তুলছে ওই পথ অবলম্বনে। জাতীয়তা ত্যাগে সর্বভারতীয় হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণের হিড়িক পড়েছে। আর পড়বে না কেন! রাজ্য সরকারের চাকরির দ্বিগুণ বেতন, ভাতা, বোনাস। এমনকি সপ্তাহে এক দিনের স্থলে দুদিন ছুটি। সে তো আকৃষ্ট করবেই। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি পাওয়ার সব যোগ্যতার প্রধান যোগ্যতা হচ্ছে হিন্দি ও ইংরেজিতে পারদর্শী হওয়া। সেটা ব্যতীত কোনো যোগ্যতাই বিবেচ্য বলে গণ্য হয় না।

সাতচল্লিশের স্বাধীনতায় ভারতের শাসকরা বুর্জোয়াদের বাসনা পুরোপুরি পূরণ করেছিল হিন্দি ভাষাকে ভারতীয় জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে। এতে যে বহু ভাষাভাষীর ভারতে অসন্তোষের ঘটনা ঘটেনি বা ঘটছে না তা কিন্তু নয়। জাতিগত ক্ষোভ-বিক্ষোভ, সংগ্রামকে কঠোরহস্তে দমন করছে বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিধায়। প্রত্যেক জাতির জাতিসত্তার ভিত্তিমূলেই ভাষা-সংস্কৃতি। সেই ভাষা ও সংস্কৃতি পরিত্যাগে নানা কৌশল, শঠতা, বল প্রয়োগ, প্রচার-প্রচারণা, সুযোগ-সুবিধা প্রদানে শাসকগোষ্ঠী সফল যে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। পার্থিব লোভ-লালসায় মধ্যবিত্তরা প্রতিষ্ঠার ইঁদুর দৌড়ে একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পরিত্যাগ করেছে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে, পুঁজিবাদী মোহে।

বহুজাতির ভারতকে এক জাতিতে পরিণত করার প্রবণতা ভারতের পুঁজিপতিদের স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা শাসকগোষ্ঠী ষোলো আনা পূরণ করেছে। তবু জাতিগত চেতনা-শ্রেণি সংগ্রাম সম্পূর্ণ রূপে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি বলেই বিচ্ছিন্নভাবে সেটার প্রকাশ ঘটছে অহিংস ও সহিংস দুই পথেই। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াবার মানুষ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। আর এটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় জনগণের জন্য আশাবাদ।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads