• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বর্ষা মৌসুমের চলনবিল

বর্ষায় চলনবিল

সংগৃহীত ছবি

মতামত

বর্ষা মৌসুমের চলনবিল

  • প্রকাশিত ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মোহাম্মদ অঙ্কন

আমার বাড়ি বৃহত্তর চলনবিলে। সুযোগ পেলেই বর্ষা মৌসুমে নৌকাযোগে চলনবিল ঘুরে-ফিরে দেখি। এবার কোরবানির ঈদের ছুটিতে এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু এবার চলনবিলের সৌন্দর্য দেখে যতটা আনন্দ পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি ব্যথিত হয়েছি চলনবিলের পানিশূন্যতা দেখে। যে চলনবিলে বাঁশের লগির নাগাল পাওয়া কষ্টকর হয়ে যায়, সেখানে এবার নৌকা ঠেকে যাওয়ার উপক্রম! কোথাও কোথাও নৌকা ঠেকে যাওয়ার জন্য পর্যটকরা বিপাকে পড়েছে। ভরা বর্ষা মৌসুমে চলনবিলে পর্যাপ্ত পানি নেই। এই পানিশূন্যতা বড় শঙ্কার বিষয়। এ বিলের ওপর নির্ভর করে একটি বিশাল জনপদ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। চলনবিলের পানিতে বেড়ে ওঠে হাজারো কৃষকের স্বপ্নের আমন ধান। কিন্তু পর্যাপ্ত পানি না থাকলে আমন ধানের প্রজননের আগেই বিলের পানি শুকিয়ে যাবে। তখন পানির অভাবে রোপণকৃত আমন ধানগুলো সঠিকভাবে প্রজনন করতে পারবে না এবং সেসব অপ্রজননকৃত ধান শুধু গরু-মহিষের খাদ্যে পরিণত হবে। বিগত কয়েকটি বছরে এমন ঘটনার নজির পাওয়া গেছে। এমন খবরও মিলেছে, কৃষকরা তাদের শত শত বিঘা জমির সোনালি আঁশ পাট জাগ দেওয়ার পর্যাপ্ত পানি পর্যন্ত পায়নি। নদী ও বিল আগেই পানিশূন্য হয়ে গেছে। সে কী হাহাকার! চলনবিলে বর্ষা মৌসুমে পানির স্রোতে পলি মাটি জমতে থাকে। এতে জমিগুলো উর্বর হয়।

এ ছাড়া কৃষকরা শুধু চলনবিলের পানি দিয়ে সেচকাজ চালিয়ে বোরো মৌসুমে ধান চাষ করতে পারে। কিন্তু সে সুযোগ আর এখন নেই। চলনবিলে পানির অপর্যাপ্ততায় যেমন কৃষিকাজ ব্যহূত হচ্ছে, তেমনি জীব-বৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। একটা সময় চলনবিলে প্রচুর শাপলা ফুল ফুটত, শামুক, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে বিলজুড়ে কোথাও শাপলার দেখা মেলে না। অতিরিক্ত দমন ও কীটনাশকের আগ্রাসনে বিল থেকে শামুক, কাঁকড়া, ব্যাঙসহ বিভিন্ন প্রজাতির জীব-জন্তু হারিয়ে গেছে। আর প্রজনন মৌসুমে মা মাছ ধরা ও পানি স্বল্পতার কারণে মাছের প্রজাতিগুলো হারিয়ে গেছে বটে এখন আর সেই আগের মতো মাছও চোখ পড়ে না। অথচ এক সময় এ বিলে প্রায় ৩৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। আজ জেলেরা হতাশ। মাছ ধরার সুযোগ হারিয়ে তারা পেশা পরিবর্তন করতে শহরমুখী হচ্ছে। নৌকা ও মাছ ধরার যন্ত্রপাতিগুলোও আর ব্যবহার করা হয় না। চলনবিল অঞ্চলে পাখি ও বন্যপ্রাণীরাও বিলুপ্তির পথে। শিকারিদের থাবায় তারাও কুপোকাত। সব মিলিয়ে চলনবিল এক মহাবিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। চলনবিলে পানি স্বল্পতাই এই সকল সমস্যার মূল কারণ।

কালের আবর্তে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন ও মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সারা বছর চলনবিলের এ নদনদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় তা এখন গোচারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার নদীগুলো দখল করে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ করাও এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া অনেকে ফসলি জমি খনন করে বিরাট বিরাট পুকুর তৈরি করছে। চলনবিলের কৃষি থেকে আহরণকৃত চাল দিয়ে দেশের প্রায় ৩০ ভাগ মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ হয়।

চলনবিলের পরিস্থিতি এখন বেহাল। বেশ কয়েক বছর হলো মারাত্মক মরুকরণ শুরু হয়েছে। এবারের বর্ষায় বিলের অধিকাংশ এলাকায় পানির দেখা মেলেনি। নদীগুলোর পাড় অবধি পানিও নেই। স্রোতপ্রবাহ নেই বলে মাছের দেখা মিলছে না।

তবে চলনবিলে বৃষ্টি না হওয়াসহ প্রাকৃতিক নানান কারণের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট কিছু কারণে বর্ষাকালে পর্যাপ্ত পানি নেই, এ কথা চিরন্তন সত্য বলে মেনে নিতেই হবে। বলা চলে, চলনবিলের মাঝে অসংখ্য বাঁধ, পুকুর ও সড়ক নির্মাণের কারণে পানি প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। বিলের যেসব নদীপথ দিয়ে পানি প্রবেশ করে, তার বেশিরভাগ মুখ বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিলের মাঝ বরাবর অসংখ্য রাস্তা ও সড়ক গড়ে উঠেছে। এগুলো চলনবিলকে খণ্ড খণ্ড করতে শুরু করে দিয়েছে। এক পাশের পানি অন্য পাশে যেতে পারছে না। কৃষি ও মৎস্য সম্ভাবনার পাশাপাশি চলনবিল একাধারে একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে চলনবিল রক্ষার উদ্যোগ নিলে বর্ষা মৌসুমে চলনবিল হতে পারে অপার সম্ভাবনাময় এক পর্যটন এলাকা।

চলনবিল রক্ষার্থে পরিবেশবিদ, স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের এখনই ভাবতে হবে।

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads